জার্মানিতে আসার পর শুরুর দিকে যে জিনিসগুলু মিস করতার তার মধ্যে অন্যতম ছিল বাংলাদেশি খাবার। গরম ভাত এর সাথে ঝাল দিয়ে রান্না করা যে কোন তরকারি। তাইতো ফ্রাইবুর্গে আমারা যে কয়জন ছিলাম প্রতি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে কারো না কারো বাসায় বাঙ্গালী খাবরের পার্টি হতো আর আমরা সারা সপ্তাহ অপেক্ষায় থাকতাম করে সবাই মিলে একসাথে মজা করে একটা খাওয়া দিব। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে রোটেশন করে একে একে জনের বাসায় বাঙ্গালী খাবারের পার্টি হত। শুরুতে আমরা ৪ জন ছিলাম বলে ব্যাপারটা তেমন জটিল কিছু ছিল না। আস্তে সে সংখ্যা ৭-৮ করে ১২ তে গিয়ে ঠেকল । মাঝে মাঝে আমাদের সাথে খাবার টেবেলি যোগ হত স্টুডেন্ট ভোনহাইমের অন্যান্য জার্মানরা ও। আমাদের সবাই নতুন রাধুনি হওয়ায় প্রায়ই লবন বেশি হত , মরিচের ঝালের তীব্রতা নতুন করে উপলব্ধি হত। সে সময় মায়ের হাতের বাঙ্গালী রান্নার সে স্বাদকে প্রচন্ড রকম মিস করতাম । একেক দিন একেক জনের নতুন রেসিপির কাছে বাঙালি রান্নার রেসিপি যখন প্রায় হারিয়েই যেতে বসেছিল সে সময় আমাদের মাঝে বাঙ্গালী স্বাদের খাবারে সে সে চির চেনা আসল স্বাদ নিয়ে আবির্ভাব হল আলো আপা ( ছদ্ধনাম ) । আমাদের ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের টোটাল ২৫ জনের মধ্যে একমাত্র নারী । সেদিন ক্লাস শেষে স্কুলে পরিচয় ,অনেকটা অবাক হয়েছি যে বয়সে একজন বাঙ্গালী নারী ঘর সংসার নিয়ে ব্যাস্ত থাকার কথা , সে সময়ে তিনি জার্মানিতে এসেছেন মাস্টার্স করতে তাও আবার জার্মান ল্যাঙ্গুয়েজে । তাও দেশে থেকে মাস্টার্স শেষ করে একটা ব্যাংক এ ভাল পজিশনের জব রেখে । ব্যাক্তিগত ব্যাপার হওয়ায় এ বিশয়গুলু নিয়ে প্রশ্ন করি নি কক্ষনও তার চেয়ে বরং আমাদের সবাই যার যার অবস্থান থেকে সাধ্য মত সাহায্য করার চেস্টা করতাম । সে জন্যই আমাদের সবার আগে ওনার জন্য কাজের ব্যবস্তাও আমাদের এক পার্টিতে বসেই করা হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই একই এজেন্সি আর একই স্কুল হওয়ায় বাঙালিগুপ ক্রিয়েট হতে সময় লাগল না। দিন যত যেতে লাগল আমাদের সবার ব্যস্ততা বাড়ার সাথে সাথে সবার মাঝের দুরত্বও বাড়তে লাগল। আগের মত আর পার্টির বদলে ছুটির দিনে কাজ করা বা অন্য কাজে ব্যস্ততাই অনেকের কাছে মুখ্য হয়ে গেল । স্কুলের ক্লাস শেষে বা ফেসবুকে বা কোন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া আর তেমন কারো সাথে দেখা বা কথা বলাও তেমন একটা হয়না। আস্তে সবাই এখান কার লাইফের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেস্টা করছে । যে যার মত অবস্তান থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেয়ায় ব্যাস্ত। এরই মাঝে বাসা, কাজ , ল্যাঙ্গুয়েজ আর দেশে টাকা পাঠানো কমন কিছু ইস্যু । তার চেয়ে ও বড় চিন্তা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন। যেহেতু সবারই কন্ডিশনাল অফার লেটার , আর কয়েক মাস ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করেই সবার মোটামুটি কমেন্ট একটাই আর যাই হোক ৯ মাসে ল্যাঙ্গুয়েজ শেয করে ইউনি এডমিশন তাদের ধারা সম্ভব না। আলো আপা ও তাদের একজন । দেশে থেকে যে কাজগুলু করার কথা ছিল তা এখন করছে এখানে এসে,তাও উপায় না দেখে । এজেন্সি যা বুজিয়েছে তাই বুঝে চলে এসে এখন আসল বিশয়টা বুঝেও লাভ নেই। কিন্তু যত যাই হোক উপায়তো একটা বের করতে হবে।

সময়ের আবর্তনে একেক জন একেক জায়গায় চলে গেছে আর ব্যাস্ত হয়েগেছে নিজেদের ভুবনে। এরই মাঝে কেটে গেছে বছর খানেকের ও বেশি সময় । আর আমাদের মাঝের যোগাযোগ ও এখন ফেসবুকে হায় হ্যালো এর পর্যায়ে চলে গেছে। গত এক লেখায় ফ্রান্সে আমাদেরই ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুলের এক ফ্রেন্ড এর চলে যাওয়া ও তার অবস্তানের কথা লিখেছিলাম । তার কিছুদিন পরই ফেসবুকে একটা মেসেজ পেলাম আমার সেই ফেন্ড এর কি অবস্তা, আর তার সম্পর্কে আরো আনুসাঙ্গিক প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্নের ধরনের দেখে আমি যতটানা বিশ্মিত তার চেয়ে বেশি বিস্মিত প্রশ্নকর্তাকে নিয়ে । আমি তাকে কোনভাবেই চিন্তেই পারছিনা। নাম , ঠিকানা , প্রোফাইল পিকচার স্ট্যাটাস কোন কিছু দিয়েই তাকে চিনতে না পেরে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম তিনি আমাদের সেই আলো আপা। তার পর তার কাছ থেকে তার অবস্তার সম্পর্কে যা জানতে পারলাম তা এমন …

আমাদের এক বাঙালি খাবার এর সাপ্তাহিক পার্টিতে আমরা তাকে যে কাজটা ঠিক করেদিয়েছিলাম তা এক পাকিস্তানি মহিলার ফার্মে কাজ । সেইদিন সে মহিলাও ছিল আমাদের পার্টিতে আমাদেরই এক বড়ভাই এর পরিচিত হিসেবে এসেছিলেন তিনি। যাই হোক তার কাজ ভালই চলছিল আর কাজের পরিধিও বাড়তেছি, সাথে সাথে ইঙ্কাম.আর আমাদের ও এডিয়ে চলতেন তিনি তখন .আর আস্তে আস্তে স্কুলের ক্লাসে উপস্তিতিও কমতেছিল । যার ফল একই কোর্স বার বার রিপিট। এখানে বলে রাখা ভাল সবাই কিন্তু তাদের ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স এর মেয়াদ যতদিন ততদিনের ভিসা পায়। তার বেলাও তার ব্যাতিক্রম হয়নি । ৯ মাসের ভিসা পেয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন যেহেতু এখন হাতে কাজ আছে ৯ মাসের কোর্স শেষ হয়ে গেলে আবার ১ হাজার বা ১২০০ ইউরো দিয়ে যে কোন একটা ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স নতুন করে করবেন আর এই পেপার্স দিয়ে ভিসা নেবেন নতুন করে । সে ভেবেই ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স এ ও ঠিকমত মনো্যোগ দিলেন না। কিন্তু সব কিছুতো আর নিজের ইচ্ছার মত হয় না। পাকিস্তানি মহিলার আন্ডারে যে কাজ করতেনা তার কোন লিগ্যাল পেপার্স ছিল না। আর সে সুযোগ এর সৎ ব্যবহার করেছেন সেই মহিলার । মাসের পর মাস আলো আপার কাজের টাকা বাকী জমতে শুরু করল। তিনি যখন শেষ পর্যন্ত দেখলেন যে অবস্তা খারাপের দিকে যাচ্ছে তক্ষণ তার কাছে টাকা চাইতেই মহিলা এবার তার আসল রুপ প্রকাশ করলেন । যার ফলাফল হল তাকে পুলিশের ভয় প্লাস কাজ থেকে অপসারন। যেহেতু আমাদের সাথে ইতিমধ্যের আলো আপার অনেটা দুরত্ব যেটা তারই সৃষ্টি করা তাই সে সময় তার কিছুই করার ছিল না। আমরাও একেক জন একেক জায়গায় চলে যাওয়ায় তার সে অবস্তার কথা কেউ জানতাম না। আর যারা সে সময় সে বিষয়টা জেনেছিল তারাও কিছু করার ছিল না, আর করেও নি। যাই হোক মুটামুটি কাজ নেই. নতুন কাজ ট্রাই করেছেন কিছুদিন। ইতিমধ্যে ভিসা ও শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে… পরিকল্পনা মত নতুন করে ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স করবেন তার জন্যওতো টাকা লাগবে, আর তার সব টাকাতো বাকীই রয়ে গেছে। তার পরও ভিসা বাড়াতে গেলেন। এবার ভিসা অফিস থেকে একাউন্ট ৮ হাজার ইউরো দেখাতে বলল আর ৩ মাস এর টেম্পোরারি ভিসা দিল । যেখানে ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স এর ১ হাজার ইউরোই নেই সেখানে ৮ হাজার ইউরো ? আর বাকী বাঙালিদের কাছে যে ধার চাইবেন সে সম্পর্ক্টাও তিনি রাখেন নি সে সময় তিনি।

আমি যখন এ কথা জানলাও তাও মাস খানেক পরের কথা। আমার ফ্রান্সের ফ্রেন্ড এর ব্যাপারে তাকে কিছু ইনফর্মেশন দিলাম আর জানতে চাইলাম আসলে তার পরিকল্পনা কি ? সে ও ফ্রান্সে যাবার পরিকপ্লনা করছে জানাল । অথচ সে তখন ফ্রান্সেই ছিল যেটা আমি আমার আরেক ফ্রেন্ড এর কাছে পরে জানতে পারলাম ।আরোও অনেক কথাই জানতে পারলাম আমদের অনান্য ফ্রেন্ডদের কাছে যা হয়ত লিখে বলা যাবে না।

তার ও কিছুদিন পরের কথা ..যেহেতু আমি ক্লাস করতে প্রায়ই ফ্রান্স এর সিমান্তে যাই আর ফ্রান্স এ ও যাওয়া হয় মাঝে মাঝে তাই আমার কাছে কাছে ফ্রান্স থেকে জার্মানিতে আসার সহজ আর নিরাপদ উপায় জানতে চেয়ে আলো আপার মেসেজ পেলাম ফেসবুকে।যেহেতু আমি জানি তিনি ফ্রান্সেই আছেন তাই আর প্রশ্ন করলাম না। যেহেতু এতদিনে তার ভিসা শেষ হয়েগেছে তাই ভয় পাচ্ছেন জার্মানিতে আসতে তাই নিরাপদে আসার ব্যাপারে জানতেই আমাকে ম্যাসেজ । কেন আসবেন আর কি করছে , কেমন আছেন জানতে চেয়েছিলাম …বিষয়গুলু কৌশলে এড়িয়ে গেলেন … আমিও আর কথা বাডালাম না। সহজ আর নিরাপদ উপায়টা বলে দিলাম। এ লেখাটা লেখার আগেও তাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলাম , কেমন আছে, কি অবস্তা জানতে চেয়ে।কিন্তু কোন উওর পাই নি। একজন বাঙ্গালী নারী যে সময় ঘর সংসার আর জব নিয়ে ব্যাস্ত থাকার কথা সে সময়ে মনের জোরে আর এজেন্সি এর মিথ্যা প্ররোবনের ফাদে পড়ে জার্মানিতে এসেছিল । আর শেষ পর্যন্ত এখানে টিকতে না পেরে দেশে দেশে দৌড়াচ্ছে একটু নিরাপদ আশ্রয় এর খুজে.. আর যাই হোক ভাল আছে তা বলা যায় না। জীবনের কঠিন বাস্তবতা আর নির্মমতার কষাঘাতে জর্জরিত অনিশ্চত এ জীবনে ভবি্য্যত কি? আলো আপার মত সহজ সরল একজন নারীর আজকের এ পরিনতিত জন্য কে দায়ী ? আর কি তার ভবিয্যতই বা কি ?

এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ১ )

এজেন্সি – স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব 2 ) – ফাঁদে পা দেয়া

এজেন্সি – স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ৩ ) -বিশ্বাস এখানে ও সেখানে

এজেন্সি – স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ৪)- খরচের আসল হিসাব

এজেন্সি – স্বপ্ন ও বাস্তবতা- (পর্ব ৫ )- ইনকাম এর হিসাব

এজেন্সি স্বপ্ন ও বাস্তবতা- পর্ব ৬ (ভুলের সূচনা)

এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ৭) -বন্ধুত্বতা

এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ৮ )- সম্মান আর ভালবাসা

এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ৯ )– নতুন আত্মপরিচয়

এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ১০ )- স্বপ্ন ভাঙ্গার প্রহর

 

mm

By Anis

Vice-President (Media & Marketing) Overall moderation, group, page, website, magazine. Responsible for learn German for FREE movement.

4 thoughts on “এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব১১ ) – বাংলাদেশি মেয়ের স্বপ্নভঙ্গ”
  1. পর্ব ১২ না দেখে হতাশ হলাম। জানতে চাই।
    পুনশ্চ- পর্বগুলো পড়ার সময় প্রকৃতির ডাকেও সাড়া দেইনি।
    বিনীত,
    বেনজির

Leave a Reply to Emon Shahriar Cancel reply