জার্মানিতে ডুয়েল ভোকেশনাল কোর্স বা আউসবিল্ডুনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বছরে মাত্র ১২ সপ্তাহ বা ৩ মাস একাডেমিক ক্লাস হয়, তাও একটানা তিন মাস নয় । কখনও ৩ সপ্তাহ একটানা ক্লাস তার পর আবার মাস ২/৩ কাজ তার পর আবার হয়ত ৪ সপ্তাহ ক্লাস। আর এই ক্লাসগুলোতেও থাকে নানা ধরনের প্রজেক্ট, প্র্যাক্টিকেল ওয়ার্ক, স্টাডি ট্যুর, প্রেজেন্টেশন, ক্যারিয়ার ফেয়ার। তাই ক্লাস করার দিনগুলো বলতে গেলে ভালই কেটে যায়।

যেহেতু কোর্সের ভাষা পুরুটাই জার্মান ভাষায় তাই কোর্সের শুরুর দিনগুলো মোটেও ভাল ছিল না। আমি ছাড়া ক্লাসের বাকি ১৭ জনেরই মাতৃভাষা জার্মান ।ক্লাস ও সকল কার্যক্রম জার্মান ভাষায় হওয়াতে শুরুতে ভালই ঝামেলা পোহাতে হত। প্রথম ব্লক বা সেমিস্টারের পুরো সময়টাই তাই পার করতে হয়েছে ডিকশেনারী দিয়ে। এমনও হয়েছে ক্লাস শেষে হয়ত টিচারই লেকচারের ইংরেজি লেখচারের কপি হাতে ধরিয়ে দিয়েছে , কিংবা পরের দিনের লেখচারের কপি আগের দিনেই আমাকে দিয়ে দিয়েছে যাতে আমি বাসায় বসে সেগুলোকে ট্রান্সলেশন করে আইডিয়া নিতে পারি আর পরের দিন ক্লাসে বুঝতে সুবিধা হয়। এভাবে কোন রকমে প্রথম সেমিস্টার পার করে মাস তিনেক পর আবার দ্বিতীয় সেমিস্টারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসকে সামনে রেখে সারা স্কুলের প্রায় ২৪০০ স্টুডেন্টদেরকে পরিবেশ সম্পর্কিত প্রজেক্ট দেবার ঘোষনা দেয়া হল । যেহেতু বিসাগের জন্য টুকটাক কিছু করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামের বাচ্চাদের সোলার এনার্জি এর সাহায্য নিয়ে ডিজিটাল প্রাইমারি এডুকেশন দেবার জন্য লাইট অফ হোপ নামে একটা প্রজেক্টের সাথে সবে মাত্র কিছুদিন আগে ভলন্টিয়ার হয়ে কাজ করার চেষটা করছিলাম । আর তাদের প্রজেক্টটি ও পরিবেশ সম্পর্কিত ।আর এ নিয়ে তাদের বানানো ভিডিও ও প্রজেক্ট প্লান আমার হাতেই ছিল । তাই এই প্রজেক্টটাকে কম্পিটিশনের জন্য দিলে কেমন হয় তা নিয়ে আমাদের ক্লাস টিচারের সাথে কথা বলতেই তিনিই উল্টো আমার চেয়ে বেশি আগ্রহদেখিয়ে আমাকে লাইট অফ হোপের প্রজেক্টটাকে কম্পিটিশনে দেবার জন্য বলেছিল। কিন্তু সমস্যা হল লাইট অফ হোপের প্রজেক্ট প্ল্যান ও ভিডিওতো ইংরেজিতে ,আর কম্পিটিশনের সব কিছুই আমাকে দিতে হবে জার্মান ভাষায় । কিন্তু আমার জার্মান ভাষার যা অবস্তা তাতে এই কম্পিটিশনের প্রেজেন্টেশনতো দুরের কথা কম্পিটিশনের জন্য প্রজেক্ট সাবমিট করার চিন্তাও করতে পারি না। মুটামোটি পিছিয়ে যাব যখন ঠিকই করে ফেলেছি, তখন ক্লাস টিচার আমাকে সাহস যোগালেন বল্লেন আস্তে আস্তে কর ,তুমি পারবে। যেহেতু আমাদের ক্লাস ও স্কুলের সব কম্পিউটারে স্টুডেন্ট আর টিচারদের এক্সসেস লিমিটেশনের পার্থক্য রয়েছে । তাই আমার আইডি দিয়ে আমি স্কুলের কম্পিউটারে আমাদের প্রেজেন্টেশন আর ভিডিও প্লে করতে পারছিলাম না । তখন আবার ক্লাস টিচার তার আইডি আর পাসওয়ার্ড দিয়ে দিলেন আমাকে যাতে প্রজেক্টের জন্য কাজগুলো ভাল মত করতে পারি। এসবের পর আর পিছিয়ে আসতে পারলাম না। বাসায় বসে ইংরেজিতে করা লাইট অফ হোপের করা ভিডিও এর ইংরেজি সাবটাইটেলগুলোকে জার্মানিতে ট্রান্সলেট করে ফেললাম। কিন্তু তাতেও যেন মন ভরছিল না। কারন ভিডিও এর ভয়েস ছিল ইংরেজিতে । ভাবতেছিলাম ভয়েসটা যদি জার্মান ভাষায় করা যেত তা হলে আরো ভাল হত।

লাইট অফ হোপের ইংরেজি ভিডিওটি দেখতে পারেন এখান থেকে-

পরের দিন ক্লাসে ব্রেক টাইমে এক জার্মান ক্লাসমেটকে দিয়ে ভিডিও এর সাবটাইটেলগুলো ঠিক আছে কিনা তা চেক করিয়ে নিলাম । আর আর একজনকে মজা করে বল্লাম এক কাজ করতো তুমি এই সাব টাইটেলগুলো পরতো আমি রেকর্ট করে দেখি কেমন দেখায়। সাথে থাকা ল্যাপটপে ক্লাসে বসেই অনেকতা মজার চলে ২ জার্মান ক্লাসমেটকে দিয়ে ভিডিও এর

ভয়েসগুলোও জার্মান ভাষায় করে ফেল্লাম । জার্মান ভাষায় সেই ভিডিও টি দেখতে পারেন-

এমনকি ফাইনাল প্রজেন্টেশনের দিনেও তাদেরকে পাশে পেলাম জার্মান ভাষায় প্রজেক্টটাকে সবার সামনে প্রেজেন্ট করতে। ঠিকঠাক মত সব প্রসেস করে ফাইনাল প্রজেন্টেশন দিয়েও দিলাম। সব কিছুই কেমন সহজভাবে আর ঝামেলা ছাড়াই করে ফেললাম । আর যে সময়টাতে বারবার পিছিয়ে যেতে চাইতে ছিলাম সে সময়টাতে উৎসাহ দিয়ে আমাকে কনফিডেন্ট করেছে আমার ক্লাস টিচার আর ক্লাসমেটরা যাতে আমি পিছিয়ে না যাই।


এবার আবার ফিরে যাই বছর ২ আগের কথায় , যখন আমি ভিসা ইন্টারভিও এর আগে গিয়েছিলাম আমার এজেন্সি ভিসা ওয়াল্ড ওয়াইডে। চলুন সে কথা জানা যাকঃ

যাই হোক অবশেষে চলে এল সেই দিন। ভিসা ইন্টারভিও এর আগের দিন যথারীতি গেলাম ভিসা ওয়ার্ল্ড অফিসে ফাইনাল প্রস্তুতি ঝালাই করে নিতে। এর আগে তাদের দেয়া প্রশ্নের তালিকা থেকে জার্মানি কেমন, কেন পড়তে যাচ্ছি এই সব নিয়ে করা প্রশ্ন গুলো দেখে গেলাম। যাই হোক ওদের অফিসে যাবার পর আমার কাউন্সিলর এবার আমাকে তাদের ডিরেক্টরের রুমে নিয়ে গেল। আমার প্রস্রুতি কেমন হল তা দেখার জন্য আর একটা ডেমো ইন্টারভিও দেবার জন্য। মজার ব্যাপার হল, ডিরেক্টরের রুমে ঢুকার জন্য আমাকে মিনিট ২০ অপেক্ষা করতে হল। অবশেষে ডিরেক্টরের রুমে ঢোকার পর তিনি প্রশ্ন করছেন আমি উওর দিচ্ছি, শুরুর দিকে একটু নার্ভাস ছিলাম বলে কথার মধ্যে জড়তা চলে আস তেছিল, পড়ে যা কেটে যায়। আমি প্রশ্নের উওর দিচ্ছি আর ডিরেক্টরের মন্তব্য রিজেক্টেড। হবে না, বাদ। আর সাথে সাথে আমার কাউন্সিলরকে বকা দিচ্ছে কেন সে টেক কেয়ার করেনি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, গত ৪ বছর ধরে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশনে কাজ করছি যেখানে ইংরেজি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। অবশেষে ডিরেক্টরের মন্তব্য ইন্টার্ভিউ দিয়ে দেখ কী হয়। আর আমার কাউন্সিলরকে বলল কন্টাক্ট করে ফেলতে। এতক্ষণে বুঝতে পারছি কেন এতক্ষণ ডিরেক্টর সাহেব এই রকম মন্তব্য করতেছিলেন। আসলে এটা তাদের পলিসি, ভিসা ইন্টার্ভিউ এর আগের দিন ফাইনাল চেক করার নামে ডিরেক্টরের কাছে পাঠায় ফাইনালি ডিরেক্টর ফাও আরো কিছু টাকা নেবার পথ বের করতে। আপনি যত ভাল প্রস্তুতি নিয়েই তার রুমে যান না কেন সে আপনাকে বলবে আপনার প্রস্তুতি ভাল হয় নি। আপনি রিজেক্টেড হবেন। ভেবে দেখুন একটা ছেলে যে কিনা আগামীকাল ভিসা ইন্টার্ভিউ দিতে যাব কোথায় তাকে উৎসাহ দিবে তা না করে উল্টো সে রিজেক্টেড বলে তার যে কনফিডেন্স সেটুকু শেষ করে দিয়ে কফিনে শেষ পেরেকটা ঢুকিয়ে ফাইনালি ফাও যা নেওয়া যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু কন্টাক্ট জিনিস টা কী? ডিরেক্টরের রুম থেকে বেরিয়ে কাউন্সিলরের রুমে ঢুকে সেটা বুঝতে পারলাম। সে এক বিরাট ও কনফিডেনসিয়াল(গোপনীয়) বিষয়। যার সারমর্ম হলঃ এম্বেসিতে তাদের লোক আছে। যে কিনা ভিসা করিয়ে দেবে। তার জন্য ২-৩ হাজার ইউরো দিতে হবে। সিস্টেম কী? ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে লিখিত দেয়া হবে যে আপনি জার্মানিতে ভিসার জন্য কন্সাল্টেন্সি নিচ্ছেন ভিসা ওয়ার্ল্ড থেকে। ভিসা পেলে কন্সাল্টেন্সি ফি হিসেবে ”—-” ইউরো তাদের দিবেন। না দিলে তারা আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে আপনার বিরুদ্ধে। আর এটা রেখে দিবে তাদের কাছে।

আমার কাছে এটা ধান্দাবাজি ছাড়া আর কিছুই না। একক্টু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখুন, আপনি ভিসা ইন্টার্ভিউ দিয়ে ভিসা পাবার পর তাদেরকে এই টাকা দিবেন। তার মানে আপননি ভিসা পেলে তাদের লাভ, আর ভিসা না পেলেও তাদের ক্ষতি নেই। একটু টেকনিক করে আপনার সাথে ককন্টাক্ট করে নিতে পারলেই হল। ফ্রাইবুর্গে আসা ২৫ জনের মধ্যে ১৮-২০ জন এমন কন্টাক্ট করে এসেছে। আর তাদের মধ্যে সে কন্টাক্টের টাকার পরিমাণ ১৫০০ ইউরো থেকে ৩০০০ ইউরোও আছে। মানে ১.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ পর্যন্ত। তার মানে ফাও ফাও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া। খালি একটু টেকনিক্যালি ফাঁদে ফেলতে পারলেই হল। যে টাকা দিয়ে হয়ত ১ বছরের খরচ চালিয়ে নেয়া যেত জার্মানিতে সেই টাকা শুধু ভিসা পাবার শর্তে অনেকেই দিচ্ছে বা দিয়ে যাচ্ছে। আর সু্যোগ সন্ধানী এজেন্সিগুলোও এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে।


এবার আসি আমাদের প্রজেক্টের রেজাল্টের দিকে। যাইহোক দিন শেষে সময় হল আমাদের স্কুলের পরিবেশ দিবসের প্রজেক্ট কম্পিটিশনের রেজাল্ট পাবার। যেই আমি জার্মান ভাষার দক্ষতা না থাকার কারনে প্রজেক্টটা জমা দিতে চাইছিলাম । কিন্তু ক্লাস টিচার আর কিছু ক্লাসফ্রেন্ডের দেয়া সাপোর্টের কারনে আমাদের দেয়া লাইট অফ হোপের সে প্রজেক্ট তৃতীয় হয়। পুরস্কারের টাকার চেয়েও সবচেয়ে বড় যে জিনিসটি আমি পেয়েছি তা হল কনফিডেন্স আর সার্থহীন কিছু মানুষের সংস্পর্শ যাদের সাথে আমার ভাষা, ধর্ম, বর্ন , সমাজ ব্যবস্তা কোন কিছুরই মিল নেই। তার পরের ও প্রাইজ মানির সম্পুর্ন টাকাটা যখন লাইত অফ হোপকে দিয়ে দেবার প্রস্তাব দিলাম ক্লাসের সেই ফ্রেন্ডগুলো ভাগ চাওয়াতো দুরের কথা কোন ধরনের আপত্তিই করল না। আর আমরা ক্লাসটিচার জুরি বোর্ডের সদস্যদের সাথে নিজে এসে আমাকে অভিনন্দন জানালো পুরস্কার পাবার জন্য।

এজেন্সি নামক প্রতারকদের ব্যবহার আর জার্মানদের ঠিক উল্টো এই ব্যবহারকে কি বলব ?

mm

By Anis

Vice-President (Media & Marketing) Overall moderation, group, page, website, magazine. Responsible for learn German for FREE movement.

2 thoughts on “এজেন্সি- স্বপ্ন ও বাস্তবতা (পর্ব ১২ ) – স্পেশ্যাল কনট্রাক্ট”
  1. ১৩ নম্বর এর অপেক্ষায়,,,,, তবে জার্মানপ্রবাসে আর বিসাগের কল্যানে যে কিছু না বোঝে সেও কিছু না কিছু বুঝবে জার্মানিতে ভর্তির A to Z সম্পর্কে

Leave a Reply