ছোট বেলা থেকেই পড়াশুনার চেয়ে খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ ছিল বেশী। পড়ার টেবিলের চেয়ে মাঠেই দিন কাটত বেশী। SSC সাইন্স থেকে দেই ২০০৯ এ কোনরকমভাবে টেনেটুনে পাশ করি। অংক ভালো লাগতোনা, পারতাম না যে এমন না, প্র‍্যাক্টিস করতাম না, ধৈর্য্য ছিল কম। তাই সবার অংক মিললেও আমার অংক মেলে না। কলেজে ভর্তি ফর্ম কেনার সময় অনেক কষ্টে ঠেলেঠুলে ব্যাংকে ঢুকে সাইন্সের বিশাল লাইন দেখে মানবিক এর ফর্ম কিনি ( এটা আমার জীবনের একটা রিগ্রেট, সাইন্সে থাকলেই ভালো করতে পারতাম আরো)। অংক করতে হবে না আর, শুধু থিওরি পড়লেই হবে। মানবিকে অর্থনীতি ছিল, প্রথম টার্ম পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম ২ নাম্বারের জন্যে, পরে আবার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এরপর আর ফেল করা লাগেনি। HSC পাশ করার পর আমার অতিমানবিক রেজাল্ট নিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে শুরু করলাম। ঢাকায় হয়নি, সারা বাংলাদেশ চষে ফেলা শেষ প্রায় তখন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেরিটে চান্স পাই। মেরিটে কিভাবে সেটা চিন্তার বিষয়।

ভর্তি হই Economics এ ( ইচ্ছা ছিল English এ পড়ার কিন্তু সিট ছিল না, অর্থনীতির সিট আমার পাওয়ার কথা না তবে ভাগ্যক্রমে আমি শেষ থেকে ৩য়)। এর পর পড়াশোনা শুরু বলতে প্রথম এক বছর হাওয়া খেয়ে আড্ডা, গল্প, খেলাধুলা, সংগঠন, কালচার বুঝতে বুঝতে শেষ। তারপর ৮ মাস ডিপ্রেশনে ক্যাম্পাসে যাইনি, আমি যে স্টুডেন্ট এটা আমি নিজেই ভুলে গেছিলাম। অনেক কারণের মাঝে ডিপ্রেশনের আরেকটা কারণ হল অংক, ক্যালকুলাস, ম্যাট্রিক্স, ভেক্টর এগুলা উচ্চ-মাধ্যমিকে ছিল যা আমার করা ছিল না। ভার্সিটির পড়াশুনার পাশাপাশি আমাকে উচ্চ-মাধ্যমিকের অংক শেখা লাগসে, প্যাথেটিক অবস্থা ছিল আমার। তারপর আবারো নিয়মিত হই ক্যাম্পাসে, নিজেকে গুছিয়ে নেই। ঠিক তখনি আরেকটা ভুল করে বসি, বেশি খুশিতে বীন বাজিয়ে আমার অর্গানাইজড সেটেল্ড লাইফে নাগিন নিয়ে আসি। যেটার জন্যে আমাকে প্রচুর সাফার করতে হইসে পরবর্তীতে। যাই হোক, কোনোরকমে BSS শেষ করি, ২.৯৫, লজ্জায় মাথা কাটা যাবার মত অবস্থা।

সবই তখন বিসিএস, ব্যাংক এগুলি নিয়ে ব্যাস্ত। আমার ইচ্ছা কর্পোরেট জব, বিসিএস আমাকে দিয়ে হবে না কারন আমার ধৈর্য্য আর কন্সেন্ট্রেশন হার্টবিট মনিটরে ওই লাইনের মত উঠানামা করে। তবুও ভাবলাম একবছর প্রিপারেশন নেই বিসিএস এর সেই সাথে মাস্টার্সটা করে ফেলি। ইচ্ছা ছিল মাস্টার্সে ফাটায়ে পড়ে ভালো রেজাল্ট করব। আমার মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের ২ পরীক্ষার আগে আমার বাসায় একটা ঝামেলা হয়, পারিবারিক এই প্রব্লেমে ওই পরীক্ষায় ফেল করি, আমি মাথা ঠিক রাখতে পারতেসিলাম না, কন্সেন্ট্রেশন ছিল না। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা আমার জন্যে ট্রমা পর্যায়ে চলে যায়। তারপরেও কোনভাবে মাস্টার্স শেষ করি, ২.৮৮ নিয়ে। ঢাকায় ব্যাক করি ২০১৮ মার্চে। জব খুজতেসি, সিজি ভালো না, বাসার পরিবেশ ফ্রেন্ডলি না, অইদিকে জাগতিক যত সব ঝামেলা নিজের ঘাড়ে নিয়ে ফ্রাস্ট্রেটেড ডিপ্রেসড ট্রমাটাইজ হয়ে আস্তে আস্তে নিজের লাইফে একটা ফুলস্টপ দেওয়ার প্ল্যান ঠিক করে ফেলি, উপযুক্ত তারিখ, এপিটাফে কি লিখা থাকতে পারে, কেউ টাকা পয়সা পায় কিনা আমার কাছে সেটা ফেরত দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রচুর নামায পড়তাম তখন, হয়ত আল্লাহ আমার কথা শুনে আমার প্ল্যান প্রোগ্রামে পানি ঢেলে একটা অসাধারণ চমৎকার ভালো বন্ধু পাঠান আমার জীবনে। তার কাছে আমি কতটা ঋনী, কতটা কৃতজ্ঞ সেটা আমি বলে বোঝাতে পারব না। সে না থাকলে আজকে আমি এগুলা লিখতে পারতাম না। আসলে আমি স্বপ্ন দেখাই ভুলে গিয়েছিলাম, সে আমাকে আবারো শিখিয়েছে কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়, সেটা নিয়ে কাজ করতে হয়, নিজের জীবনে এগিয়ে যাবার প্রেরণা আর আত্মবিশ্বাস এই মানুষটা আমাকে দিয়েছে। পাশে থেকে গাইড করেছে শক্ত হাতে, মোটিভেশান লেটার, কাগজপত্র, পাসপোর্ট, আইএলটিএস সব যায়গায় সে আমাকে লিড করেছে শক্ত ভাবে। সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হিসাবে নিজেকে তৈরি করার জন্যে গাইডেন্স, স্পেস, ভুল গুলি খুঁজে তা নিয়ে কাজ করা, কর্মঠ হওয়া….. এককথায় আজকে আমি যা, সেটা তার নিজ হাতে গড়া। ২টা জব ও পাই তার মাধ্যমে,তাকে আমার জীবনের পরশপাথর বলা হলে ভুল হবে না। তাকে মেনশন করব না, Treasures are always kept as Secret.

IELTS দিলাম, প্রথম বসায় ৬.৫। যতগুলি এজেন্সি তে গেছি নিজেকে ইভালুয়েট করতে সবাই এক বাক্যে বলেছে “জার্মানিতে আপনার হবে না”। চেষ্টা ছাড়িনি, ১৩ টা রিজেকশন আমার জার্মানি বাদে। তবুও চেষ্টা করলাম। এই সময়টায় ঘুমাতে যেতাম সকাল ৯ টায়, উঠতাম ৪-৫ টায় বিকালে। ইনসম্নিয়া আর প্রেশার, সাথে অনিশ্চয়তা, ব্রেন নিতে পারত না, শুধু বলতাম আরেকটু আরেকটু। ২০২০ এর মে এর ৫ তারিখ Friedrich-Schiller University of Jena থেকে অফার লেটার পাই। টাকা ব্লক করি তার পরের সপ্তাহেই তুমুল লকডাউন এর মাঝে। লকডাউনে এম্ব্যাসি বন্ধ, আবারো অপেক্ষা। জুলাই ৫ এ ভিসার এপয়েন্টমেন্ট নেই, তারপর আবারো অপেক্ষা, রাতগুলি কিভাবে গেছে সেটা আমি জানি আর আল্লাহ জানেন। এর মাঝে অনলাইনে সেমিস্টার শুরু করি অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে। ডক সাবমিশনের মেইল পাই ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ এ। তারপর ২৮ ফেব্রুয়ারি ভাইভা, ৩ মার্চ আবারো ভাইভা ( ২য় ভাইভাটা র‍্যান্ডমলি ক্যান্ডিডেট চুজ করে ডাকে, এম্ব্যাসি রুল। শুধু দেখে যাদের তারা ভিসা দিচ্ছে তারা ভ্যালিড কিনা, ইংরেজিতে কথা বলতে পারে কিনা এবং পড়াশুনা করার মেন্টালিটি আছে কিনা)। ভিসা পাওয়ার কথা ছিল ২৫-২৮ মার্চ কিন্তু ভিসা পাই ১৩ এপ্রিল। ভিসা শুরু ডেট দেওয়া ১ এপ্রিল থেকে, ৩ মাসের ভিসার ১৩ দিন এম্ব্যাসি খেয়ে দিসে, এর মাঝে ১৪ তারিখ থেকে লকডাউন আবারো। পড়লাম আটাকা, প্লেন অফ। এক একটা দিন যায়, ভিসা মেয়াদ কমে। হাইপারটেনশন আরো বেশী জাঁকিয়ে বসে। কোনমতে ২৮ তারিখের কাতার এয়ারলাইন্স এর একটা টিকেট ম্যানেজ করি। প্লেন উড়ার আগে পর্যন্ত আমি শিওর ছিলাম না যে আমি যাচ্ছি। ২৯ তারিখে Frankfurt নামি, তারপর একা একা ট্রেনে করে Jena ( উচ্চারণে য়েনা)। ডর্মে উঠি, কোয়ারান্টাইন করে, নিজে নিজে ডর্মের পেপার, সিটি রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করি। আরো কিছু কাজ বাকি এখনো। করব ধীরে ধীরে। খুব ছোট একটা শহর য়েনা, কিন্তু আমার ২য় জীবন শুরু করার জন্যে পার্ফেক্ট।

আমার জীবনের গল্প এটা, আপনাদেরটা ভিন্ন, তবে ইচ্ছা যদি জার্মানি হয় তবে আমি বলব চেষ্টা করেন। আমি মোটিভেশান এর আগে ডিমোরালাইজড হইসি, সিজি ভালো না, সবাই বলসে হবে না কিন্তু এখন সেই জার্মানিতে বসেই আমি লিখতেসি এসব। কারো কথায় কান দিয়েন না, চোখ কান খোলা রেখে ইনফরমেশন যোগার করবেন, বার বার ক্রসচেক করবেন ইনফরমেশন কারন ভুল ইনফরমেশনই বেশী পাবেন, কিংবা পার্শিয়াল ইনফর্মেশন পাবেন। DAAD এর ওয়েবসাইটে যান, খুঁজেন নিজের সাবজেক্ট, নিজে স্টাডি করেন। কেউ আপনাকে খাওয়ায়ে দিবে না, আপনার খুধা লাগলে আপনাকে যেমন নিজেরই খেতে হয় এই ব্যাপারটা ঠিক তেমনি। স্টাডি করেন, পছন্দের ইউনিভার্সিটির একটা লিস্ট তৈরী করেন, দেখেন কোনটায় ফ্রীতে এপ্লাই করা যায় কিনা (আমি ফ্রী-তে করসিলাম), IELTS রিকোয়ারমেন্ট দেখেন, ডেডলাইন দেখে আপনার পেপার্স গুছায়ে সুন্দর একটা মোটিভেশনাল লেটার লেখেন। অনেকেই অন্যেরটা চালায়ে দেন নিজের মোটিভেশনাল লেটার হিসাবে, এটা করবেন না, অন্যেরটা দেখেন তারপর নিজের মত করে নিজের কথা গুলি গুছায়ে লিখেন। হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ, আশা হারায়েন না। আমি যেহেতু পারসি, আপনিও পারবেন। আল্লাহ আপনাদের চেষ্টা আর আশায় বরকত দান করুক।

ধন্যবাদ বেস্টফ্রেন্ড, পাশে থাকার জন্যে, সময়ে অসময়ে অনেক ভুল করে জ্বালানোর জন্যে স্যরি, তুমি না থাকলে আজকে কোনকিছুই সম্ভব হত না।

আমার জন্যে দোয়া করবেন, যেন ভালো করে পড়াশুনা করতে পারি এইবার।

Educational Profile:

SSC : University Laboratory School and College, Dhaka, 2009. GPA : 4.50 (Science)

HSC : Bir Shreshtha Noor Mohammad Rifles Public College, Dhaka, 2011. GPA : 4.20 (Humanities)

BSS : Shahjalal University of Science and Technology, Sylhet. 2012-2016. GPA : 2.95

MSS : Shahjalal University of Science and Technology, Sylhet. 2012-2016. GPA : 2.88

IELTS : 6.5 ( L:7, R:6.5, W:6, S:6.5 )

MSc : Friedrich-Schiller University of Jena, Germany. 2020 – Ongoing

বিঃদ্রঃ এম্ব্যাসি রিসেন্টলি IELTS এর রিকোয়ারমেন্ট নিয়ে ঝামেলা করতেসে, ৫.৫ এম্ব্যাসি চাইলেও ওভার-অল ৬ থাকলে আপনি সেফ, এই ব্যাপারটা মাথায় রেখে প্রিপারেশন নেন। আর IELTS ছাড়া জার্মানিতে আসার ট্রাই করবেন এটা মাথায় রাইখেন না প্লিজ। আপনি পড়াশুনা করতে আসবেন, নিজের পজিশন এর একটা সম্মান তো আছে তাই না। IELTS ছাড়া আসা যায় না এমন না, যায়, কিন্তু আপনি যদি IELTS দিয়ে আসেন তাহলে আপনার একটা স্ট্রং প্রফাইল থাকবে, সেই সম্মানটাও পাবেন।

One thought on “লো সিজিপিএ আর আমার জার্মান স্বপ্ন”

Leave a Reply