কথা হলেই তিনি মৃত্যুর কথা বলতেন, বলতেন কবে যে চলে যাই, সময় তো ফুরিয়ে এলো। জন্মের থেকে মৃত্যুই তো অধিক সত্য, মৃত্যু আমরা অনুভব করি। মৃত্যুর চেয়ে সত্য তো আর কিছু নেই। কিন্তু অবধারিত মৃত্যুই যেন সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত। বলছি ভাষাবিদ জাহান আরার কথা। বার্লিনের বাবুল ভাই কল দিয়ে খবরটা দিলেন, আমাদের সকলের দিদি আর বেঁচে নেই। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও আমাকে কল করেছিলেন, ব্যস্ততার অকেজো অজুহাতে কথা বলতে পারিনি, পরেও আর কল করিনি। শেষ কথা আর হল না। পঁচাশি বছরের দীর্ঘ জীবন সাঙ্গ করে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে, হামবুর্গ শহরে, ঘুমের মাঝেই ১১ মে সকাল বেলায়। শেষ কথা না হওয়ার এই যন্ত্রণা চিরকাল আমি বয়ে বেড়াবো।
বেগম জাহান আরাঃ জন্ম ১৯৩৭, রাজশাহীতে
বাঙ্গালির একটু বয়স হলেই বদ্ধ ঘরে জানালায় বসে মৃত্যুর কথা স্মরণ করে আফসোস করার ঝোঁক রয়েছে। কিন্তু দিদি অন্যরকম ছিলেন। বয়স তাঁকে কাবু করতে পারেনি মোটেই। শেষ সময় পর্যন্ত বাংলা ভাষার ব্যাকরণের সংস্কার নিয়ে কাজ করেছেন, প্রতিনিয়ত সোশ্যাল মিডিয়া ও পত্রিকায় লিখেছেন। ফেসবুকে বেশ সক্রিয় ছিলেন। আমার সাথে পরিচয় সেখানেই, মার্চ ২০১৯ এ। এর আগে আমি বারবারা দাশগুপ্তের একটা ইন্টার্ভিউ করেছিলাম। সেটি পড়ে জাহান আরা দিদি (তিনি নারী পুরুষ সবাইকে দিদি ডাকতেন, আমরাও তাঁকে দিদি ডেকেই অভ্যস্ত) আমার সাথে যোগাযোগ করেন। বার্লিনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, বারবারার সাথে দেখা করিয়ে দিতে অনুরোধ করেন।
২০১৯ সালের ৪ঠা জুলাই তিনি হামবুর্গে বড় ছেলের বাসা থেকে বার্লিন আসলেন, আমি স্টেশন থেকে তাঁকে নিয়ে গেলাম বারবারার বাসায়। দুজনেই সাহিত্যিক, দিদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার প্রফেসর ছিলেন, সত্তুরের দশকের শেষ দিকে ভারত থেকে পিএইচডি করেছেন, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক, বারবারাও বাংলা ভাষাবিদ, ষাটের দশকে হুমবোল্ট বিশ্ব্যবিদ্যালয়ে পড়েছেন ভারতীয় ভাষা সংস্কৃতি দর্শন ও সাহিত্য নিয়ে। আমি একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁদের আলাপচারিতা শুনেছিলাম, তাঁদের সাহিত্যজ্ঞান, ভাষাপ্রয়োগ আর বিনয়ভাবী আচরণ দেখে নিজেকে ঋদ্ধ করেছি।
পরবর্তীতে আমি জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিনের জন্য দিদির সাক্ষাৎকার করেছিলাম। কেউ পড়তে চাইলে এই লিংকে দেখতে পারেনঃ https://www.germanprobashe.com/archives/20127
তাঁর পরিবারের প্রায় দশজন সদস্য জার্মানিতে থাকেন। একারণে বাংলাদেশ থেকে প্রায়ই তিনি জার্মানিতে আসতেন। দেশে থাকতেও কথা হত প্রায়ই। রাজশাহীর অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও পঞ্চাশের দশকে বাবার প্রশ্রয়ে শিখেছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত। সঙ্গীতের উপর ধর্মীয় আঘাত তখনো এতটা প্রকট হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিলেন। ছিলেন বেতার ও টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী। পুরনো দিনের কথা বলতেন বারবার। বলতেন মুক্তি সংগ্রামের কথা, বঙ্গবন্ধুর কথা বলে আজকের বাংলাদেশ নিয়ে আফসোস করতেন। ঘৃণা করতে অসততা, চৌর্যবৃত্তি আর প্রবঞ্চনাকে।
মূল্যহীন আর ক্ষুদ্র এই জীবনে আমি যত মানুষকে ধীশক্তি সম্পন্ন জেনেছি, জ্ঞান আর বিনয়ের মিশ্রণ দেখেছি, চিন্তায় ধর্মনিরপেক্ষ অথচ মননে ধার্মিক, সৎ জীবন যাপন করতে দেখেছি, দিদি তাঁদের মাঝে শ্রেষ্ঠ। তাঁর সাথে ক্ষণিকের পরিচয় আমি আমার জীবনের মণিহার করে রেখে দিলাম।
জাহিদ কবীর হিমন
জার্মান প্রবাসের সম্পাদক
বার্লিন থেকে