ইতিহাস আমাদের বলে, একটি বিপ্লবের সাফল্য শুধুমাত্র পুরাতন শাসন ব্যবস্থার পতনে নয়, বরং একটি নতুন, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে নিহিত। যেকোন সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক পরিবর্তন সময় সাপেক্ষ, যুক্তিশীল মানুষমাত্রই তা জানে, কিন্তু সকালের সূর্য্য দেখে কিছুটা হলেও দিন কেমন যাবে তা অন্তত অনুমান করা যায়। নিজেদের তাঁরা তত্ত্বাবধায়ক বললেও আহ্লাদ করে আমি বিপ্লবী বলতে চাই, তাঁদের বহু কাজ দ্বারা তাঁরা ইতিমধ্যেই মানুষের মনে আশা জাগিয়েছে বটে, কিন্তু আঠারো কোটি মানুষের পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা একুশজন আসমানী ফেরেশতাকেও ব্যর্থ করে দিতে পারে।
ইতিহাসের পাতায় আমরা দেখতে পাই বহু বিপ্লব, যেগুলি তাদের মহৎ উদ্দেশ্য থাকা সত্ত্বেও, বিজয়ের পর ভেঙে পড়েছিল। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লব “স্বাধীনতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব” এর প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এটি রক্তপাত আর আতঙ্কের রাজত্বে পরিণত হয়েছিল। ১৯১৭ সালের রাশিয়ান বিপ্লবও সমতা আর ন্যায়বিচারের স্বপ্ন নিয়ে শুরু হলেও, এর পরিণতি ছিল অত্যাচারী শাসনের অধীনে কোটি মানুষের ভোগান্তি।
এই ইতিহাস আমাদের বাংলাদেশে চলমান বিপ্লবের জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে। বাংলা বিপ্লবের এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি হবে মানুষের প্রতি মানুষের মমতা (empathy)। বিপ্লবের পর অতি সহজেই পুরানো ক্রোধ কষ্ট আর প্রতিশোধের পাথরে আটকে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশকে সেই ফাঁদে পড়লে চলবেনা প্রকৃত বিপ্লব শুরু করতে হবে আমাদের হৃদয় পরিবর্তনের মাধ্যমে, পারস্পরিক সহানুভূতি হবে যার ভিত্তি।
পুরাতন শাসন ব্যবস্থার পতনের পর, নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব প্রতিটি নাগরিকের উপর এসে পড়ে। এখন শুধুমাত্র আমাদের নেতাদের থেকে পরিবর্তনের দাবি করাই যথেষ্ট নয়, আমাদের নিজেদের প্রতিটি পদক্ষেপে সেই পরিবর্তন আনতে হবে। এই বিপ্লব সাম্যের দাবিতে শুরু হয়েছিল, কিন্তু এই সাম্য শুধু বিশেষ কিছু মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সাম্য আর সহনশীলতা মানে হচ্ছে যারা আমাদের সাথে ভিন্ন মতামত রাখে, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, তাদের অধিকার রক্ষা করা।
এই বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করছে আমাদের একসাথে কাজ করার ক্ষমতার উপর, ব্যক্তিগত লাভের চেয়ে দেশের মঙ্গলকে অগ্রাধিকার দিতে পারার উপর, একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল ও দায়িত্বশীল থাকার উপর। আমাদের উচিত নিজেদেরকে নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করা—যাতে এই বিপ্লবের স্মৃতিগুলি শুধুমাত্র ইতিহাসে না থেকে, প্রতিদিনের জীবনে প্রতিফলিত হয়। এবং এভাবে বাংলাদেশ সত্যিকারের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়।
০৫.০৯.২০২৪
বার্লিন থেকে
জাহিদ কবীর হিমন