ধর্মের দোহাই দিয়ে খুনীদের পক্ষ নেওয়া শুধু বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই ঘটেছে। ধর্মতন্ত্রে বিশ্বাসী (ধর্মীয় রাজনীতি) ধর্মান্ধ মানুষ মাত্রই অত্যাচারীর পক্ষাবলম্বন করবে এটি মোটা দাগে পৃথিবীব্যাপী অবধারিত। তবে আজকের লেখা শুধু জার্মানদের নিয়ে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জনসাধারণের অনেকে শুধুমাত্র ধর্মের অজুহাতে কিভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যার কুশীলবদের পক্ষ নিয়েছিল, আজকে লেখা সেটি নিয়েই। লেখাটি মূলত ১লা জুন ২০২১ সালে ডয়চে ভেলে-তে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের অনুবাদ, সাথে আমার মতামত জুড়ে দিয়েছি স্থানে স্থানে।

মিউনিখ শহর থেকে ৩৫ মাইল দূরের একটি ছোট্ট শহর লান্ডসবার্গ। ১৯৫১ সালে সেখানে বাসিন্দা ছিল বারো হাজারের মত। এর প্রায় এক তৃতীয়াংশ জানুয়ারির ৭ তারিখে জড়ো হলেন শহরের কেন্দ্রে। সময়টা তখন ২য় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ছয় বছর পর, জার্মানি তখন কেবল যুদ্ধের ক্ষতি আর পরাজয়ের গ্লানি কাঠিয়ে উঠে অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। 

বিক্ষোভকারীদের ছিল একটি “খ্রিস্টীয়” দাবি। তারা আমেরিকার কাছে দাবি করেছিল যে ল্যান্ডসবার্গের কারাগারে বন্দী ২৮ জন গনহত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড যেন স্থগিত করা হয়। সেখানে ল্যান্ডসবার্গের মেয়র, সিটি কাউন্সিলর এবং সংসদ সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন।

অসওয়াল্ড পোল, বিক্ষোভ সত্ত্বেও ১৯৫১ সালের জুনে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল, হোলোকাস্ট চালানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি

শহরবাসীর এই সংহতি শুধুমাত্র কোনো সাধারণ বন্দীর জন্যে ছিল না। মানব ইতিহাসের কিছু জঘন্য অপরাধীর পক্ষে এরা দাঁড়িয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, অসওয়াল্ড পোল ছিলেন নাৎসিদের এসএস আধাসামরিক ইউনিটের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রধান এবং গণহত্যা চালানোর ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

এরপরে অটো ওলেনডর্ফ যিনি এসএস টাস্ক ফোর্সের কমান্ডার হিসাবে ৯০,০০০ বেশি বেসামরিক লোককে হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পর উক্ত দুই ব্যক্তি পোল এবং ওলেনডর্ফকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং অন্যান্য শত শত বন্দীর মতোই তাদেরকে ল্যান্ডসবার্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন “যুদ্ধাপরাধী কারাগার নং ১”-এ বন্দী করে রাখা হয়েছিল। 

অটো ওলেনডর্ফ, যিনি ৯০,০০০ এরও বেশি বেসামরিক হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন, প্রতিবাদ সত্ত্বেও ১৯৫১ সালের জুনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল

বিশ শতকের প্রথম দিকে ল্যান্ডসবার্গের একটি ঘটনাবহুল ইতিহাস রয়েছে। ১৯২৪ সালে, অ্যাডলফ হিটলার তার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পরে এখানে বন্দী হন এবং তার কুখ্যাত ইহুদি বিরোধী বই “মাইন কাম্পফ” লিখেছিলেন এখানে বসেই৷ ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসার পর জার্মান অস্ত্র শিল্পের জন্য এখানে ২৩০০০ মানুষকে ব্যবহার করে একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল৷ তাদের অধিকাংশই ছিল পূর্ব ইউরোপের ইহুদি। শ্রমিক মোতায়েন হতো ইহুদি নিধনের নাৎসি পরিকল্পনা অনুসারে যার মোটো ছিল “শ্রমের মাধ্যমে নির্মূল।”

জানুয়ারী ৭, ১৯৫১ তে গণহত্যাকারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে জনসমাবেশের খবর পেয়ে হোলোকাস্টের শিকার মানুষরা এসেও বিক্ষোভ প্রদর্শন করে এবং তাঁরা প্রত্যক্ষ করে যে খোদ প্রশাসন ও সরকারের বিভিন্ন পদে আসীন দায়িত্বশীলরাই গনহত্যাকারীদের রক্ষার্থে সমাবশে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাঁরা ‘ইহুদিদের বের করে দাও!’ অথবা ‘ফিলিস্তিনে যাও’- এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করছে। 

জার্মানিতে এখনো বর্তমান ইহুদি-বিদ্বেষ ছাড়া আর এমন কী কারণ হাজার হাজার জার্মান নাগরিককে গণহত্যাকারীদের সাথে তাদের একাত্ম হতে উদ্বুদ্ধ করেছিল? কারণ অনেক। ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানিতে তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধবোধের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করার প্রবণতা ব্যাপক ছিল। সেই সময়ে অনেক লোকের কাছে আমেরিকানরা তখনও দখলদার ছিল, যদিও ফেডারেল রিপাবলিক ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং তাদের চিন্তাধারায়, একজন জার্মান যুদ্ধাপরাধীর মূল্য একজন আমেরিকান দখলদারের চেয়েও বেশি।

যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের সহানুভূতিতে বেশিরভাগের খ্রিস্টান ধর্ম হতে উৎসারিত আবেগ-অনুভূতি কাজ করেছিল। ৭ই জানুয়ারী, ১৯৫১ সালের সেই সমাবেশে বিশিষ্ট বক্তাদের একজন, ডঃ রিচার্ড ইয়াগার ২৮ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডকে “অ-খ্রিস্টান” বলে বর্ণনা করে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড রহিত করার দাবি করেছিলেন, তিনি এই বিচারকে খ্রিস্টান ধর্মের বিরুদ্ধাচারণ বলে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর পরেই তিনি বিচার মন্ত্রী নিয়োজিত হয়ে জার্মান আইনে মৃত্যুদণ্ড পুনঃপ্রবর্তনে উদ্যোগী হয়ে নিজের জন্য একটি ডাকনাম তৈরি করেছিলেন, মুণ্ডুপাতের ইয়াগার (Kopf-Ab-Jaeger)।

রিচার্ড ইয়াগার, ল্যান্ডসবার্গ বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান বক্তা, ২৮ জন নাৎসি অপরাধীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডকে ‘অ-খ্রিস্টান’ বলে বর্ণনা করেছেন।

প্রায় ৮০ বছর পরও ওই খ্রিস্টীয় উগ্র আবেগ আজও অনুরণিত হয়। তা না হলে AfD এর মত রাজনৈতিক দলের নব্য নাৎসিরা কীভাবে সেই নাৎসি যুগে ফিরে যাওয়ার স্লোগান দেয়! জনসংখ্যার অন্তত ২০% এখনও এই অযৌক্তিক আবেগকে আঁকড়ে আছে।

৭০ বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের জন্য জার্মান খ্রিস্টানবাদীদের ওই আন্দোলন সফল হয়েছিল। ২৮টি মৃত্যুদণ্ডের মধ্যে, ১৯৫১ সালের জুন মাসে মাত্র সাতটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল – তাদের মধ্যে পোল এবং ওলেনডর্ফ ছিল। জার্মানির মাটিতে যুদ্ধাপরাধের দায়ে এটিই ছিল শেষ মৃত্যুদণ্ড।

স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। শত্রু এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর থেকে জার্মানরা মিত্র। এবং পরবর্তী বছরগুলিতে, এই পরিবর্তনের ফলে অনেক প্রাক্তন নাৎসি উদীয়মান পশ্চিম জার্মান প্রজাতন্ত্রের রাজনীতি এবং ব্যবসার বিশেষ পদগুলিতে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছিল। সংক্ষেপে একটি কথা উল্লেখ না করে লেখাটির সমাপ্তি টানা যাচ্ছে না। ষাটের দশকে জার্মানির অর্থনীতি যখন তরতরিয়ে উপড়ে উঠছে তখন তরুণ প্রজন্ম লক্ষ্য করতে সক্ষম হল যে, প্রশাসন ও রাজনীতিতে নাৎসিরা, যুদ্ধাপরাধীর সহযোগীরা। ক্ষুব্ধ সচেতন তরুণ সমাজ তখন নতুন সমাজ বিনির্মাণে আন্দোলন গড়ে তোলে, এমনকি যাঁদের পরিবারে নাৎসি ছিল, নিজস্ব ঐচিত্তবোধ আর নৈতিক সততার স্থান হতে তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।  

বাঙ্গালি সচেতন পাঠকসমাজ যদি যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি কতিপয় জার্মানদের সহানুভূতি দেখে বর্তমান বাংলাদেশকে কল্পনা করেন, তাঁদের দোষ দেয়া যায় না। লাখো মানুষের রক্তে বাংলাদেশের জন্ম। সেইসব আত্মত্যাগী শহীদ, ধর্ষিত নারী আর অবর্ণনীয় অনাচারের শিকার শিশুদের প্রতি ন্যুনতম সম্মান আর আবেগ না রেখে শুধুমাত্র ধর্মের কারণে যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি আর প্রেমবোধ কাজ করলে বুঝতে হবে, এই সমাজ এই দেশ এই রাষ্ট্র গভীর অসুখে আক্রান্ত। 

১৮ আগস্ট ২০২৩
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply