বলা হয়ে থাকে জার্মানীতে সবচেয়ে সময় সাপেক্ষ ভিসা হচ্ছে ফ্যামিলি রিইউনিয়ন ভিসা। এম্বাসির ওয়েবসাইট অনুযায়ী মিনিমাম ১২ সপ্তাহ ও আমার এক ফ্রেন্ডের প্রায় ৫ মাস পর ডিসিশন আসা দেখে শুরুতেই কিছুটা ঘাবড়ে গেছিলাম। যাহোক, প্রসিডিউর শুরু করার পর অবশ্য তেমন কোনো ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় নি।

টাইমলাইন:
ভিসা ইন্টারভিউ- ০৪ মার্চ ২০১৯
বিডি ভেরিফিকেশন কমপ্লিট- ০৯ মার্চ ২০১৯
স্পাউস ই-মেইল পায়- ১০ এপ্রিল ২০১৯
সে ডকুমেন্ট জমা দেয়- ১১ এপ্রিল ২০১৯
আমাকে এম্বাসি থেকে মেইল দেয়- ১৪ এপ্রিল ২০১৯
পাসপোর্ট কালেক্ট করি-১৭ এপ্রিল ২০১৯

আমি চেষ্টা করবো এই পোস্টে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে ডিটেইল প্রসিডিউর টা বর্ণনা করতে।

এপ্লাই করার পুর্বেঃ
বিয়ের পরপরই যেহেতু আমার বরের জব ও সিটি পরিবর্তন করতে হয়েছিলো তাই আমাদের হাতে কিছু সময় ছিলো। তাই আমি শুরুতেই গ্যুটে ইন্সটিটিউটে এ১ কোর্সে ভর্তি হয়ে যাই। এদিকে ও বার্লিন ছেড়ে মিউনিখ শিফট করলো আর আমিও নিয়মিত ক্লাস করতে থাকলাম। মিউনিখে যারা থাকেন তারা হয়তো জেনে থাকবেন ওখানে বাসা পাওয়া কতটা কঠিন। এদিকে আমার কোর্সও প্রায় শেষ ততদিনেও একটা রিকোয়ারমেন্ট (এম্বাসী উল্লেখিত) অনুযায়ী বাসা ম্যানেজ করতে না পারায় ৪ মাসের মাথায় আবার জব চেঞ্জ করে নতুন জব নিয়ে ড্রেসডেন শহরে শিফট করে। ও যেদিন বাসার কনফার্মেশন পেলো আমি সেদিনই ডি-টাইপ ভিসার ইন্টার্ভিউ ডেট নেই এম্বাসির ওয়েবসাইট থেকে। প্রথমে ডেট পেয়েছিলাম মার্চ এর ২৪ তারিখ আর সাথে সাথে নিয়ে ফেললাম। উল্লেখ্য তখন সামার সেমিস্টারের এডমিশন এর কারণে এম্বাসীতে খুব প্রেশার ছিলো। তারপর প্রায় প্রতিদিন ই আমার বর ও আমি এম্বাসির ওয়েবসাইট ভিজিট করতাম কোনো স্লট ফাঁকা হয়েছে কিনা দেখার জন্য। একদিন হুট করেই খুব সম্ভবত ১৩ ফেব্রুয়ারি আমার বর আমাকে ফোন করে বললো যে তাড়াতাড়ি ওয়েবসাইট চেক করো, স্লট ফাঁকা হয়েছে। আমি বাইরে ছিলাম বলে তাড়াতাড়ি পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে একটা কফির অর্ডার দিয়ে ওয়াইফাই কানেক্ট করলাম।প্রথমেই আগের যে এপয়েন্টমেন্ট ছিলো সেটা ক্যান্সেল করে নতুন করে এপোয়েন্টমেন্ট নিতে গিয়ে দেখলাম মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে ২টা ফাঁকা স্লট পূরণ হয়ে গেছে। কি আর করা তারপর যেটা সবচেয়ে আগের ৪ মার্চ বুক করে ফেললাম।

কাগজপত্রঃ অতি অবশ্যই ওয়েবসাইট এর রিসেন্ট চেকলিস্ট ফলো করতে হবে। আমি যেসব ডকুমেন্টস গুছিয়েছিলাম-

বরের পাঠানো সব স্ক্যান কপিঃ
১) পাসপোর্টের ডাটা পেইজ সহ সকল পৃষ্ঠার ফটোকপি
২) লাস্ট ৩ মাসের স্যালারি স্টেটমেন্ট
৩) জব কন্ট্রাক্ট
৪) হাউজ কন্ট্রাক্ট
৫) সিটি রেজিস্ট্রেশন (সব ডকুমেন্টস ২ কপি করে)

১) ২টা ভিসা এপ্লিকেশন ফর্ম
২) সিগনেচার সহ জার্মান স্ট্যান্ডার্ডে (৩৫/৪৫মিমি) তোলা ছবি ৩ কপি (২ কপি ভিসা ফর্মে ও ১ কপি পাসপোর্টের ভিতর)
৩) এ১ সার্টিফিকেট
৪) আমার পাসপোর্টের ডাটা পেইজ এর ফটোকপি (৩কপি)
৫)নিকাহনামা বাঙ্গলা+ইংরেজি (৩ কপি)। এখানে উল্লেখ্য, কাজীর সিগ্নেচার সম্বলিত নিকাহনামাতে নামের বানান থেকে বাসার ঠিকানা অবধি সব যেনো পাসপোর্টের সাথে মিল থাকে ইভেন বাবা-মায়ের নামের বানান ও। আমার কাজী আমাদের পরিচিত ছিলো বিধায় সে আমাকে ফর্ম দিয়ে বললো তুমি নিজেই ফিলাপ করে দাও।আরো একটি ব্যাপার হচ্ছে আপনি যে ওয়ার্ডে থাকেন সেখানকার কাজীকে দিয়ে বিয়ে পরানো ভালো এবং বিয়ের মোহরানা, দিন-তারিখ সব ডিটেইল্গুলা যেনো মাথায় থাকে।কারণ ইন্টার্ভিউতে এসব নিয়ে বারকয়েক জিজ্ঞেস করে কনফিউজ করার চেষ্টা করে।
৬)ম্যারেজ সার্টিফিকেট – ইংরেজিতে। যিনি বিবাহ রেজিস্টেশন করবেন তার সিগনেচার সহ।
৭) বিয়ের ছবি- পরিবারের লোকজনের সাথে বিয়ের ছবি। আমাদের যখন কাজী বিয়ে পড়াচ্ছিলো তখনকার ২-৩ টা ছবি ছিলো আর ২ ফ্যামিলির লোকজনের সাথে মিলিয়ে মোট ৫ কপি নিয়েছিলো।
৮) স্কেচ ম্যাপ- ২জনের পাসপোর্টে উল্লেখিত বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ও কাজী অফিসের হাতে আঁকা ম্যাপ। তেমন কঠিন কিছু না, গুগল ম্যাপ দেখে একটা মেইন পয়েন্ট টার্গেট করে সেখান থেকে গন্তব্য পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো চিহ্নিত করে দূরত্বসহ আঁকতে হবে। কাজী অফিসের ম্যাপে আমি কাজী সাহেবের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছিলাম।

ইন্টার্ভিউঃ
নির্ধারিত সময়ে এম্বাসিতে পৌছানোর পর সকল চেকিং এর ফর্মালিটি পেরিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমার কলের। তখন একজন লেডি নতুন আরেকটা চেকলিস্ট ধরিয়ে দিয়ে বললো এই চেকলিস্ট অনুযায়ী সাজান। চেকলিস্ট দেখে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়! 
কারণ বাসা থেকে ওয়েবসাইট দেখে যেভাবে সাজিয়েছিলাম তার পুরাই বিপরীত। যাহোক, যেহেতু হাতে বেশ খানিকটা সময় ছিলো তাই ঝটপট গুছিয়ে ফেললাম চেকলিস্ট দেখে। অবশেষে ডাক পরলো ৬ নাম্বার কাউন্টারে। ভিসা অফিসার একজন ভদ্রমহিলা ছিলো এবং শুরুতেই উনি আমার সব ডকুমেন্টস চেক করলো। বিপত্তি বাধলো বরের পাসপোর্টের ১ কপিতে ডাটাপেইজটাই মিসিং ছিলো, আমিতো পুরাই লজ্জায় শ্যাষ। এতো সাবধানে সব গোছাইলাম তাও কিভাবে! যাহোক, ভিসা অফিসার মুচকি হেসে বললো, ইটস ওকে। মাঝেমধ্যে এমনটা হয়ে যায় বলে পাশে থাকা ফটোকপি মেশিনে ফটোকপি করে নিয়ে আসে। ২০-২৫ মিনিট বেশ ইজিলি আমাদের বিয়ে ও ওর জব নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করলো। তারপর ভিসা ফি+ভেরিফিকেশন ফি (২৪০০০টাকা+৭৫ইউরো ) জমা করতে বললো। আমি একজনের থেকে ভুল ইনফো পেয়ে ব্যাগ বাইরে রেখে শুধু ডকুমেন্টস নিয়ে ভিতরে ঢুকছিলাম বলায় ম্যাম আমাকে ১০ মিনিটের সময় দিলো। আমি ফি জমা দেয়ার পর শুভকামনা জানিয়ে বিদায় দিলো।

ভেরিফিকেশন(বাংলাদেশ) পর্বঃ
সাধারণত অন্যদের বেলায় শুনেছি ভেরিফিকেশনে প্রায় মাস দেড়েক সময় লাগে। আমার ক্ষেত্রে সেটা ৩দিনের মাথায় হয়ে যাওয়াতে বেশ অবাক হয়েছিলাম। প্রথমে আমার শ্বশুরবাড়িতে যায় এবং কথায় কথায় শ্বাশুড়ী জেনে নেয় যে তারপর দিন আমাদের বাসায় আসবে। ঠিকই পরদিন আমাদের বাসায় আসেন এবং কাজী অফিস যেহেতু আমার বাসার পাশেই ছিলো তাই সেদিনই কাজী অফিস ও ভিজিট করেন। পরে শুনেছি বাসার আশপাশে লোকদের কাছে আমাদের ছবি দেখিয়ে এটা-সেটা জানতে চেয়েছিলো।

জার্মান পর্বঃ
১০ এপ্রিল সকালে আমার স্পাউস ইমেইল পায় লাস্ট ২ মাসের স্যালারি স্টেটমেন্ট মেইল করার জন্য। ও অবশ্য ১১ এপ্রিল সকালে ডকুমেন্ট নিয়ে সরাসরি গিয়ে জমা দিয়ে আসছিলো।

ভিসা ডিসিশনঃ
১৪ তারিখ দুপুরে এম্বাসি থেকে আমাকে মেইল দেয় যে, আমার ভিসা ডিসিশন নেয়া হয়ে গেছে। যেদিন থেকে ট্রাভেল করতে চাই ঐদিন থেকে ১৪ দিনের ট্রাভেল হেলথ ইন্সুরেন্স নিয়ে যেতে। আমি গ্রীন ডেল্টা, গুলশান-২ সার্কেল থেকে করেছিলাম। এম্বাসির নিয়মানুযায়ী ১৪ দিন বললে আসলে ২৯ দিন আর ১ মাস বললে ৪৫ দিনের করে দেয়। আমার ১৪=২৯ দিনের জন্য টাকা লেগেছিলো ২৩০৭ টাকা। অতঃপর, হেলথ ইন্সুরেন্স জমা দেয়ার পরদিন এম্বাসি থেকে কল দেয় পাসপোর্ট কালেক্ট করার জন্য।

এই ছিলো আমার মোটামুটি ৪১ দিনের জার্নি। কাগজপত্র সব এম্বাসির রিকোয়ারমেন্ট অনুযায়ী নিজে নিজে গুছাতে পারলে কোনো ঝামেলা হওয়ার কথা না।

Leave a Reply