জার্মান প্রবাসের বিশেষ ব্যক্তিত্ব অংশে আমরা চেষ্টা করি বাংলাদেশীদের সাফল্য এবং সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে। এমন কিছু কাজ, কিছু গল্প যা তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখতে দেখাবে। এমন কিছু আলোর মিছিল যা এগিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের আগামী দিনের সম্ভাবনার দিকে। আমরাই হব পৃথিবীর বুকে এক টুকরো বাংলাদেশ।

“আমি বাংলায় গান গাই- আমি বাংলার গান গাই
আমি আমার আমিকে চিরদিন এই বাংলায় খুঁজে পাই
আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন, আমি বাংলায় বাধি সুর

বাংলা আমার দৃপ্ত স্লোগান, ক্ষিপ্ত তীর ধনুক
আমি একবার দেখি, বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ”

বাংলা ভাষা ভাষীদের জীবন বদলে যাচ্ছে, সেই সাথে বদলাচ্ছে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম।বিশ্বের অনেক দেশেই বাংলাদেশী বংশদ্ভূত পরিবার কাজের, জীবিকার তাগিদে বসবাস করছেন। তাদের পরিবারে ধীরেধীরে যোগ হচ্ছে নতুন প্রজন্ম যাদের জীবনধারা, চিন্তা ভাবনা এবং সংস্কৃতি নিয়ে ধ্যানধারনা সবই বদলাচ্ছে সময় এবং পরিবেশের তাগিদে। কখনো বিদেশীদের মুখে শুনি বাংলাদেশীরা নাকি অন্যদের থেকে জলদি খাপ খাইয়ে নেয় নতুন পরিবেশের সাথে। হবেইনা বা কেন? বেশিরভাগ বিদেশে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী বাবা-মা গর্বের সাথে সন্তানদের বিদেশী ভাষায় বলে এটা কর, ওটা করনা। বিদেশের কথা নাহয় বাদই দেই, কত ছেলেমেয়ের সাথে বাবা মায়েরা দেশে বসে ইংরেজিতেই কথা বলে তার কথা নতুন বলবার প্রয়োজন পরে না। আজকাল বাবা মায়েরা যখন ছোটছোট শিশুদের সাথে বিদেশী ভাষায় কথা বলে, আমার মনে প্রশ্ন জাগে এমন যদি আমার ছোটবেলা হত তবে আজকে আমি কে বা কি পরিচয়ে পরিচিত হতাম!আমার ছেলেবেলা কেটেছে বিদেশের মাটিতে যেখানে আমার ভাষা-সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে আমার বাবা-মা। তখন যদি আমার বাবা-মা আমার সাথে বাংলায় কথা না বলত, আমার সংস্কৃতির সাথে যদি না পরচিয় করিয়ে দিত আমি নিজের পরিচয়ই হয়ত জানতাম না। গোপালভার-বীরবলের কাহিনী, ঠাকুরমার ঝুলি, রাক্ষস-খোক্ষস এর গল্প আর সেই সাথে ইউরোপীয় রুপকথা সবকিছুই পড়ার সুযোগ হয়েছে যা থেকে ছোট্টবেলার কল্পনার জগত গড়ে উঠেছিল।

1498060_1065122073518628_2275142033204062697_oইউরোপে বহু বাংলা ভাষাভাষীর বাস থাকলেও বাংলাভাষা শিক্ষার জন্যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা আয়োজন ঠিক তেমন একটা চোখে পরে না আর এখানে জন্মানো ছেলে-মেয়েদের মুখেও খুব কমই শুদ্ধ বাংলা শোনা যায়। এরমাঝে কেউ কেউ কিন্তু ঠিকই ভাবছে আমার সন্তান বড় হচ্ছে কিন্তু সে তার মাতৃভাষা জানেনা, তার পরিচয় জানেনা; এ মেনে নেয়া যায় না। একসাথে নানান অনুষ্ঠানে বসে কিছু টুকিটাকি অনুষ্ঠান করা, খাওয়া দাওয়া করাই কেবল বাঙালি ঐতিহ্য না সাথে জানার এবং শেখার আছে অনেক কিছু। “আমার সন্তান বড় হচ্ছে কিন্তু তার পরিচয় থেকে দুরে আছে। তারা জানেনা কোনো ঐতিহ্য এবং তার মর্ম। এই বিষয়টি আমাকে খুব বেশি ভাবিয়ে তুলেছিল আমার মেয়ের জন্মের পরে।” এমন কথাটিই বলেন গোথেনবার্গ এর নাজ খান। আসলেই! বাবা মায়ের কাছ থেকে অনেক কিছু শেখার পরেও কোথায় যেন কিছুটা ফাকি-ঝুকি রয়ে যায়। এই অপুর্নতা পূরন করা যায় কেবলমাত্র পাঠশালায় গিয়ে।

12985562_1145443282153173_5560545392198930607_nবারবার পরিবারগুলোর মাঝে এমন আলাপ-আলোচনা চলাতে অনেকেই সামিল হয়ে যায় এই বিষয়টি নিয়ে ভাববার জন্যে। যার ফলশ্রুতিতে ২০১৫ সালের অক্টোবরে শুরু হয় “বাংলা স্কুল”। সুইডেনের রেগুলার স্কুলের পাশাপাশি নিয়ম করে প্রতিমাসের শেষ সপ্তাহের শনিবার বিকেলে নিয়ম করে ক্লাস করা হয়। ছয়জন পড়ানো এবং অনুষ্ঠানের আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছেন। অক্ষরের হাতেখড়ি, ছবি আঁকা, নাচ-গান, কবিতা সবই শেখানো হয় পালা করে। এটি সম্পূর্ণভাবে অলাভজনক একটি পদক্ষেপ নিজেদের সন্তানদের জন্যে। বাংলা স্কুলের সব ব্যায়ভার ও অভিভাবকদেরই। জনপ্রতি খুব সামান্য সম্মানী নির্ধারন করা হয়েছে অভিভাবকদের কাছ থেকে যা ২ সন্তানের জন্যে প্রযোজ্য। যদি একই পরিবারের তৃতীয় কোন শিশু থাকে, তার জন্যে কোনো প্রকার সম্মানী ধরা হয় না। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বসন্ত উত্সব, বিজয় দিবস সবই ঘটা করে পালন করা হচ্ছে। শিশুরা অংশ নিচ্ছে, জানছে নিজের পরিচয় এবং মাথা তুলে দাড়াতে শিখছে নিজগুনে গর্বিত মানুষ হিসেবে।

14203441_1264845026862056_293468181_oএই স্কুলের কথা বলতে গেলে গোথেনবার্গের সমগ্র বাংলাদেশী কমুনিটিকেই ধন্যবাদ দিতে হয় কেননা প্রতিটি সামাজিক পদক্ষেপ পরিপূর্ণভাবে স্বার্থক হ
য় সবার সহযোগিতা এবং অংগ্রহনের মাধ্যমে। তবুও বিশেষ কিছু নাম না বললে লেখাটি অপূর্ণ থেকে যাবে তা হলো শিক্ষকদের নাম। যেহেতু সবাই তাদের ডাক নামেই বেশি চেনা তাই সেই নামেই উল্ল্যেখ করা হলো, যাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি তাদের আমার চেনা নামগুলোই ব্যবহার করলাম; এই ধৃষ্টতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্ঠিতে দেখবার জন্যে অনুরোধ রইলো।

14139129_1264847310195161_252477267_oনাজ ভাবি-অক্ষর জ্ঞান শিল্পকর্মের মাধ্যমে “খেলতে-খেলতে শেখা”
লিপা আপু-চারুকলা
পিঙ্কি এবং লিপা অপু- নাচ
সায়মা আপা এবং মুন্নি ভাবি- গান
পলাশ ভাই- কবিতা আবৃতি
বিদ্যুতদা এবং পলাশ ভাই- বাদ্যযন্ত্রের দ্বায়িত্বে
শারমিন আপা- ক্লাস এবং অনুষ্ঠানের জায়গার ব্যবস্থা করার দ্বায়িত্ব নিয়েছেন
শার্লি- ছবি তোলা, ভিডিও করে রাখা এবং মুহূর্তগুলোকে আর্কাইভ করে রাখার দ্বায়িত্বে আছে
তনুজা ভাবি- সার্বিক ব্যবস্থাপনায়

13233142_1164807370216764_3130922697281830255_n ২০১০ সালে গোথেনবার্গ এ দীর্ঘ এক বছর এবং এক মাস বসবাসের মধ্য দিয়ে আমার ইউরোপের জীবনের শুরু। এই স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকে আমি খুব অল্প বয়সে কোলে তুলে নিয়েছি এবং তাদের বাবা-মা আমার সুহৃদ বন্ধুতুল্য আপনজন। এই নতুন প্রজন্ম আমাদের সংস্কৃতিকে জেনে বড় হয়ে উঠবে- তা ভাবতে গেলে গর্বে বুকটা ভরে উঠছে। অভিভাবকদের সাধুবাদ জানাই এমন কাজের জন্যে এবং নতুন প্রজন্মের জন্যে রইলো অনেক আদর ও আশির্বাদ। আমি স্বপ্ন দেখি- নতুন প্রজন্ম যেন বর হয়ে ওঠে আমাদেরই চেতনা এবং ভালোবাসাকে সাথে নিয়ে…

“আমি একবার দেখি -বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ
আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলার কথা কই

আমি বাংলায় ভালবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি
আমি তারি হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি
আমি যা কিছু মহান বর্ণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায়…
বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমক
আমি একবার দেখি- বারবার দেখি, দেখি বাংলার মুখ”

46830_10150251325210632_5646399_n
আমার স্মৃতির পাতা থেকে নেয়া ২০১০ সালের কিছু ছবি সেইসব শিশুদের যারা আজ এই স্কুলের শিক্ষার্থী।  পুরোনো এলবাম ঘাটতে ঘাটতে খুঁজে বের করা সেই ছোট্ট শিশুদের দল যারা পৃথিবীর বুকে তাদের বাবা-মায়ের উদ্যোগের ফলশ্রুতিতে হয়ে উঠবে এক টুকরো বাংলাদেশ।

mm

By Tanzia Islam

Tanzia Islam is an admin of BSAAG, learn german and Germanprobashe.com this is a volunteer work from her side for the Bangladeshi community. She is also an admin of Free Advice Berlin. Her volunteer activities are related to educational development, city development and environmental protection. Tanzia is a freelance writer and researcher. Currently she is a doctoral researcher at Technical University of Berlin.

2 thoughts on “বাংলা স্কুল, সুইডেনের গথেনবার্গে নতুন প্রজন্মের ঠিকানা”
  1. বাংলা ভাষাকে সমুন্নত রাখতে উনাদের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আশা করি বাঙালি এই বন্ধন আমাদের দেশের সংস্কৃতি বিদেশ বিভূঁয়ে প্রচারে সহায়ক হিবে।

Leave a Reply