সেবার আমাদের ম্যাগাজিন জার্মান প্রবাসের ২য় বর্ষপূর্তি সংখ্যার প্রস্তুতি চলছে। জানুয়ারি ২০১৬। বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ধন্যমান্য কারো শুভেচ্ছাবার্তা থাকলে বহুগুণ তার মর্যাদাবৃদ্ধি হয়। এরই মাঝে মাথায় এলো হান্স হার্ডারের কথা যিনি ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় ‘চৈতন্যে সাহিত্যের প্রভাব’ নিয়ে ঝরঝরে পরিষ্কার বাংলায় বক্তৃতা করে তাক লাগিয়ে দেন। সেখানেই তিনি উল্লেখ করেন জার্মান সাহিত্যিক গোয়েথের ধ্রুপদী রচনা ‘তরুণ ভের্টারের দুঃখগাথা’ (ইংরেজিঃ The Sorrows of Young Werther, জার্মানঃ Die Leiden des jungen Werthers) বইটির কথা, যে বই পড়ে ইউরোপের তরুণরা গভীর বেদনাবোধ থেকে আত্মহত্যা শুরু করেছিল। সে ভিন্ন ইতিহাস। এখানে তাঁর বক্তৃতা দেখা যেতে পারেঃ https://www.youtube.com/watch?v=SxOa0a8SsF4
আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য তাঁর থেকে একটু শুভেচ্ছাবার্তা কী করে সংগ্রহ করে ম্যাগাজিনকে জাতে উঠানো যায় সে নিয়ে ভেবে খোঁজ করা শুরু করলাম। খোঁজ নিয়ে যা পেলাম তা দেখে বাঙ্গালি হিসেবে গর্বে বুকটা ভরে না গিয়ে উপায় থাকল না।
জার্মানির ঐতিহ্যবাহী হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউট’-এর ভাষাতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডক্টর হান্স হার্ডারের শ্রীমদ্ভগবৎগীতা, চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডারী সঙ্গীত, উনিশ শতকের বাংলাসাহিত্য নিয়ে বহু গবেষণা আর বিস্তর পাণ্ডিত্য রয়েছে। তাঁর তরফ হতে কোন প্রকারের উত্তর না পাওয়ার ঝুঁকি স্বত্বেও তাঁকে একটি ইমেইল করে অনুরোধ করলাম আমাদের ম্যাগাজিনের জন্য একটি নিবেদন লিখে দিতে। আমি ইংরেজিতে লিখেছিলাম, কিন্তু অন্যকে চমকে দেয়ার ধাত জার্মানদের রক্তে। ডক্টর হান্স আমাকে পরিষ্কার বাংলায় ধন্যবাদ দিয়ে জানালেন লেখা পাঠাবেন। পরিশেষে লিখলেন ‘ইতি আপনার হান্স হার্ডার’, সাবেকী ঢঙে বাঙ্গালি যেভাবে পত্রলেখা সমাপ্ত করতো। আমি ধান্দা লেগে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম ‘ইতি আপনার হান্স হার্ডার’ শব্দগুলোর দিকে।
বিলম্বের মাধ্যমে আমাকে অস্থির না করেই তিনি লেখা পাঠালেন। পাঠকের জন্য সেই পূর্ণাঙ্গ ইমেইল এখানে দিলামঃ
****
প্রিয় জাহিদ কবির ,
এই যে ছোট্ট একটা নিবেদন পাঠাচ্ছি। googlemail –এ বাংলা হরফে লেখা যায় বলে আমি এই একাউন্ট থেকে লিখছি। সাধারণত এটা কিন্তু কম–ই ব্যবহার করি।
নিবেদনটি চলবে কি না জানাবেন। আমার বাংলাটা যে–যেখানে দরকার ঠিক করে দেবেন।
অনেক শুভেচ্ছা সহ
হান্স হার্ডার
***
নিবেদন
“জার্মান প্রবাসে” পত্রিকাটি ক‘মাস হলো প্রথম দেখতে পেলাম। ওটা উল্টে–পাল্টে পড়তে–পড়তে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারি নি। “জার্মান প্রবাসে” এই জার্মানির ভিতরে নানা বাঙালি ছাত্র–ছাত্রীর মেধা ও সৃজনশীলতার একটা সুন্দর যোগফল। জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সময় ওঁরা এদেশের ইউনিভার্সিটি, শহর, মানুষ, ইতিহাসকে কেমন দেখছেন পত্রিকাটি তার একটা মূল্যবান দলিল। লেখা, ডিজাইন, layout – সব অনেক যত্নের কাজ। “জার্মান প্রবাসে” পত্রিকা একচোটে জার্মানিবাসী বাঙালি ছাত্রদের বন্ধন দৃঢ করে এবং বাংলাদেশের আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এবং আগ্রহী সাধারণ পাঠকের কাছে বাংলা ভাষার মাধ্যমেই এই জার্মান প্রবাসী জীবনের একটা বিস্তারিত ছবি এঁকে দেয়।
সম্পাদকদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন। “জার্মান প্রবাসে” যেন দীর্ঘজীবি হয়!
হান্স হার্ডার
আধুনিক ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউট
হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়
****
জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিন – জানুয়ারি ২০১৬ – “মুক্ত করো ভয়” সংখ্যাতে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। আপনারা চাইলে ম্যাগাজিন পড়তে বা ডাউনলোড করতে পারেন এখান থেকে www.GermanProbashe.com/archives/9746
তাঁর বিনয়সমৃদ্ধ উত্তর দেখে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল, সে আমার নির্ঘাত মনে আছে। ম্যাগাজিনে সেই নিবেদনটি প্রকাশ করে পিডিএফ ফাইলটি যোগ করে তাঁকে ফিরতি ইমেইলে আমি যা লিখেছিলাম সেটিও এখানে উল্লেখ করে দিলামঃ
***
শ্রদ্ধেয় হান্স হার্ডার,
আমরা আপনার নিবেদনটি প্রকাশ করতে পেরে গর্বিত। এই ইমেইলে পিডিএফটি সংযোগ করে দিয়েছি। সময় করে চোখ বুলাবেন। কখনো যদি এমন মনে করেন যে আমাদের কোথাও ভ্রান্তি হচ্ছে, তবে আপনার সুপরামর্শ দিতে ভুলবেন না। অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
আপনার,
জাহিদ কবীর
***
এরপরেও তাঁর সাথে খুব হালকা বার্তা আদান প্রদান হয়েছে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারীর এই ক্ষণে তাঁর মত একজন বাংলা ভাষা ও বাংলাপ্রেমী ভিনদেশি যিনি বহুকাল অব্দি বাংলাকে বিশ্বদরবারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, ইউরোপের চোখ দিয়ে বাংলাকে দেখার সুযোগ করে দিয়ে চলেছেন, তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করতে রাজি নই। একুশ অমর হোক!