নারী দিবস ২০২১ উপলক্ষ্যে জার্মান প্রবাসের(জা প্র) পক্ষ থেকে জার্মানিতে বসবাসরত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের সাক্ষাৎকারের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখানে থাকল হ্যানোভারবাসী রন্ধনশিল্পী আয়েশা সিদ্দিকার একটি সাক্ষাৎকার। Aysha Siddika নামের ইউটিউবের স্বত্বাধিকারী তিনি যাতে আছে পনেরো লাখের বেশি গ্রাহক। লিংকঃ https://www.youtube.com/channel/UC5xIZOXLw-dd617GoPPDgbw

জা প্রঃ বাংলাদেশ থেকে জার্মানি আসার পরিকল্পনা, কিভাবে কখন আসা ইত্যাদি নিয়ে আমাদের বলবেন
আয়েশাঃ ২০১২ সালের মাঝামাঝি খালেদ (আমার স্বামী) মাস্টার্স করার জন্য জার্মানির হ্যানোফার শহরে আসে। এর বছর দেড়েক বাদে স্পাউস ভিসা নিয়ে আমিও আমার দুই বছরের শিশুপুত্র নিয়ে চলে আসি। সেই থেকে আজ অবধি আমরা হ্যানোফারেই আছি।

জা প্রঃ পাকা রাঁধুনি হওয়ার শখ কখন থেকে হল, এক্ষেত্রে কেউ কি অনুপ্রেরণা আছে?
আয়েশাঃ রান্না বান্না নিয়ে তেমন একটা আগ্রহ আমার কখনোই ছিলোনা। ঈদে, মেহমানদারিতে বা কোনো অনুষ্ঠানে টুকটাক শখের স্নাক্স বা ডেজার্ট বানানো ছাড়া দেশে থাকতে খুব একটা রান্নাবান্না করতেও হয়নি। তাই পাকা রাঁধুনি তো দূরের কথা, রাঁধুনি হবার কোনো লক্ষ্যণও আমার মধ্যে ছিল না। যেটা শিখেছি সেটা ঠেলায় পড়ে শেখা হয়েছে।
প্রতিদিনকার ভাত-মাছ-ডাল রান্নার জন্য ফোন করে পদ্ধতি জেনে নিতাম মা ও শাশুড়ীর কাছ থেকে।
প্রবাসে আসার পর দেশীয় খাবারগুলো খুব মিস করতাম, বিশেষ করে রাস্তার ধারের ফুচকা, সিঙ্গারা, পুরি, প্যাটিস, দেশি মিষ্টি ইত্যাদি। যেহেতু শ’খানেক ইউরো খরচ করলেও এখানে বসে মুখরোচক ঐসব খাবারের কণাটিও মিলবে না, তাই ঠিক করলাম নিজেই বানানোর চেষ্টা করবো। দেশে থাকতেও আমি টুকটাক স্নাক্স বানাতাম তাই কিছুটা আইডিয়া তো ছিলোই। ওগুলোই পুঁজি করে মাঝেমধ্যেই একেক দিন বিকেলে দেশি স্ন্যাক্স গুলো বানাতে শুরু করি। সেই সাথে বিদেশী বন্ধুদের কাছ থেকে তাদের খাবার গুলোও একটু একটু করে বানানো শিখতে লাগলাম। প্রথম প্রথম খুব যে পারফেক্ট হতো তা নয়, কিন্তু আমি হাল ছাড়তাম না যতক্ষণ সেটা আমার মনের মতো হচ্ছে। আর আমার ওই সমস্ত খাবারের স্বাদ নেবার জন্য গিনিপিগ ছিল খালেদ। এবং সে খুব আগ্রহ করেই সেগুলো খেত দেখে বুঝতে পারতাম খাবারগুলো খুব একটা খারাপ হচ্ছে না।
একদিন দই বানালাম, সে খেয়ে বললো হুবুহু বগুড়ার দই। তাতে আগ্রহ বাড়লো। একদিন ওর কিছু বাংলাদেশি বন্ধু আসলো, সিঙ্গারা আর ডালপুরি খাওয়ালাম। খেয়ে তারা বললো মনে হচ্ছে ঢাকার চায়ের দোকানে বসে সিঙ্গারা ডালপুরি খাচ্ছি। শুনে আগ্রহ আরো বাড়লো। এইভাবেই আস্তে আস্তে আগ্রহটা কখন যে নেশায় পরিণত হলো তা বুঝতেই পারিনি। আর সেখান থেকেই আমার রান্নার জগতে প্রবেশ। সেই হিসেবে আমি বলতে পারি আমার অনুপ্রেরণা আমার স্বামী সেই সাথে সে আমার কাজের সবচেয়ে বড় সমর্থক।

স্বামী সন্তান নিয়ে আয়েশার ছোট্ট সংসার

জা প্রঃ ইউটিউবে বর্তমানে আপনার চ্যানেল নিয়ে বলুন। কবে শুরু করলেন, প্রথম দিকে কেমন লেগেছে, গ্রাহকসংখ্যা কীভাবে বাড়লো, ভিডিও কোয়ালিটি ভাল করার জন্য কি কি করলেন?
আয়েশাঃ আমার রান্না গুলো যখন আশেপাশের মানুষ পছন্দ করতে শুরু করলো। তখন একদিন মনে হল কেন এগুলো আমি আরো মানুষের সাথে শেয়ার করছি না, বিশেষ করে যারা আমার মত আনাড়ি এবং প্রবাসে থাকে, নিশ্চয় তাদের কিছুটা উপকার হবে। সেই ভাবনাতেই ২০১৫ সালে একটা ফেসবুক পেজ খোলা, সেখান থেকে ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপ।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা বা যতটুকু আমি জানি সেগুলো লিখিত রেসিপি আকারে প্রকাশ করতে থাকলাম। সেইসাথে নিজের ভুল থেকে শেখা গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী কিছু টিপস যা নতুনদের জন্য খুবই উপকারী হতো।
সময় লেগেছিলো, শুরুতেই যে অনেক সাড়া পেয়েছি তা নয়। তবে আস্তে আস্তে লক্ষ্য করেছি দিনে দিনে পেইজ, ওয়েবসাইট ও অ্যাপে গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ আমার লেখা ও রান্নার ছবি পছন্দ করছে। অনেকেই আরো নতুন নতুন রেসিপির আবদার করছে, রান্না বিষয়ক তাঁদের সমস্যাগুলো আমার সাথে শেয়ার করছে এবং সমাধান চাচ্ছে। এই সমস্ত কিছু আমাকে খুব অনুপ্রেরণা যোগাতো রান্না নিয়ে আরো নতুন কিছু শেখার, আরো কিছু জানার।
টানা দুই বছর কোনো কিছু পাবার আশা না করে শুধুমাত্র শখ ও ভালোলাগা নিয়ে আমি লিখে লিখে সবার সাথে রেসিপি শেয়ার করেছি। একসময় তাদের কাছ থেকে অনুরোধ আসলো লিখিত রেসিপির পাশাপাশি তারা ভিডিও ও চায়। প্রথম প্রথম সাহস হয়নি, কিন্তু একসময় মনে হলো কেন পারবোনা!
২০১৬ সালের ২রা জানুয়ারি ১ মিনিট ৩ সেকেন্ডের(সিঙ্গারা ভাঁজ করা ) প্রথম একটা ভিডিও আমি আপলোড করি। এই ভাবে শখের বশে এবং পরীক্ষামূলকভাবে ১ বছরে (জানুয়ারি ২০১৭ পর্যন্ত) মোটমাট ৮/৯ টার মতো ভিডিও শেয়ার করি। তারপর ২৫ এপ্রিল, ২০১৭ তে ”ডোরাকেক” নামক ভিডিওটি দিয়ে ইউটিউব জগতে সত্যিকার অর্থে পা রাখি সিরিয়াস ভাবে, ১৩শ সাবস্ক্রাইবার নিয়ে, আর সেই থেকেই শুরু। পরবর্তী ৬ মাসে ১ লাখ গ্রাহক অর্জন করি।
গত সাড়ে ৩ বছরে শেয়ার করেছি প্রায় ৫৫০’র ও বেশি ভিডিও আর বিনিময়ে পেয়েছি অনেক অনেক ভালোবাসা, দোআ এবং সাড়ে ১৫ লাখ (১.৫ মিলিয়ন) সাপোর্টার। এছাড়াও আমার আরো ৩টি ইংলিশ চ্যানেল আছে যার একটিতে (চ্যানেলের নাম Tiffin Box) ইতিমধ্যেই ১ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার অতিক্রম করেছে।

শুরু থেকেই আমি চেষ্টা করেছি গতকালের থেকে আজকে আরো বেটার কিছু করার। নিজেই নিজের কাজকে কঠোরভাবে সমালোচনা করি এবং সেখান থেকে ভুল শুধরে পরেরবারে আরো ভালো করার চেষ্টা করি।

আমি এখনো মনে করি আমার কাজ আরো অনেক উন্নত করা বাকি আছে, তাই এখনো আমি প্রতিনিয়ত শিখে যাচ্ছি এবং আরো ভালোভাবে সবার সামনে সেগুলো সুন্দর করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি ।

জা প্রঃ একটা ভিডিও আপলোড করার পর যখন সবার প্রশংসা পান তখন কেমন অনুভূতি হয়?
আয়েশাঃ শুধু ভালো লাগে বললে ভুল হবে। ওই প্রশংসাগুলোই আমাকে আরো কাজ করার উদ্দীপনা যোগায়। যখন কেউ এসে বলে আপনার রেসিপি দেখে এটা সেটা রান্না করেছি, সবাই খুব পছন্দ করেছে তখন একেকটা ভিডিওর পেছনে দেয়া ৮-১০ ঘন্টা সময় ও শ্রম সত্যিই সার্থক মনে হয়।

জা প্রঃ এসব নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
আয়েশাঃ রান্না ও রেসিপি নিয়ে সামনে আমার বেশ বড়সড় পরিকল্পনা বা কিছু স্বপ্ন আছে যেগুলো নিয়ে আমরা দুজনে কাজ করে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ সময় আসলে এবং কাঠামোগত কিছু তৈরী হলেই আমরা সেগুলো সবার সাথে শেয়ার করবো।

জা প্রঃ যারা ভবিষ্যতে অনলাইনে ভিডিও কনটেন্ট বানাতে চায় তাঁদের প্রতি আপনার কোন পরামর্শ আছে?
আয়েশাঃ ইউটিউব থেকে ঘরে বসেই টাকা ইনকাম করার সুযোগ আছে ”…শুধুমাত্র এটাকে লক্ষ্য করে যদি কেউ একটা চ্যানেল খুলে বসে আমি বলবো সেটা যথেষ্ট বোকামি হবে। বা, অমুক রান্নার চ্যানেল খুলেছে আমিও খুলবো ভেবে খোলাও কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আগে খুঁজে বের করুন কিসে আপনার ভালোলাগা কাজ করে, কি করতে আপনি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। কোন কাজটা করার সময় আপনার কষ্ট বা সময়ের দিশা থাকে না। যেটাকে আমরা passion বলি। হতে পারে সেটা রান্না, গান, ছবি আঁকা, সেলাই বা এমনিতেই বসে গল্প করা। তবে এমন কিছু কন্টেন্ট বানাতে হবে যেটা থেকে দর্শক কিছুটা হলেও ইনফরমেশন পাবে। যখন কেউ আপনার থেকে সামান্য হলেও কিছু শিখতে পারবে তখন সে দ্বিতীয়বার আপনার কাছে আসবে।
আজগুবি শিরোনাম বা ভুলভাল থাম্বনেইল দিয়ে হয়তো আপনি সাময়িক কিছু ভিউ পেতে পারেন কিন্তু কোনোভাবেই সেটা স্থায়ী হবে না। সর্বোপরি সৎভাবে ধৈর্য্য সহকারে নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করতে থাকুন, একসময় যথাযথ মূল্যায়ন পাবেনই।

জা প্রঃ নারী দিবসে নারীদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি থাকবে? নিজে স্বাবলম্বী হয়ে স্বামীর পাশাপাশি যারা সংসারে ভূমিকা রাখতে চায়
আয়েশাঃ বর্তমানের ডিজিটাল যুগে সত্যিকার অর্থে কেউ যদি কিছু করতে চায় তার সামনে হাজারটা পথ খোলা থাকে। আগে যেমন ছিল, উপার্জন করতে হলে বাইরে বের হতে হবে, এখন কিন্তু তেমনটা আর নেই। নানারকম অনলাইন বিজনেসের কথা আমরা হরহামেশাই শুনতে পাই। শুধুমাত্র ফেসবুক ব্যবহার করেই অনেকে ব্যবসা করছেন যার বেশির ভাগই কিন্তু নারী। ভালো রান্না জানেন তো ক্যাটারিং বিজনেস শুরু করুন, ভালো কেক বানাতে পারেন তো অনলাইন একটা কেক শপ খুলে ফেলুন, যদি আরবি পড়াতে পারলে বাচ্চাদের অনলাইন টিউটোরিয়াল করান, প্রবাসী মেয়েদের জন্য অনলাইন বুটিক হাউস খুলুন বা দেশি পণ্যের অনলাইন শপ- এরকম হাজারটা পথ আছে।
ঘরে বসে টিভি বা ফেসবুকে অযথা সময় নষ্ট না করে নিজের একটা আলাদা জগৎ, আলাদা পরিচয় গড়ে তুলুন। যা এখন খুবই সহজ, শুধু নিজেকে আগে খুঁজে বের করতে হবে আপনি কি করতে চান। সে সম্পর্কে ভালো করে জানুন বুঝুন আর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে থাকুন। বাকিটা দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার সামনে সমস্ত পথ খুলে যাবে।

জা প্রঃ আপনাকে ধন্যবাদ
আয়েশাঃ আপনাকেও ধন্যবাদ আর জার্মান প্রবাসের পাঠকদের প্রতি রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জার্মান প্রবাসের সম্পাদক জাহিদ কবীর হিমন
ছবি ডিজাইনে সহায়তা করেছে আমাদের ম্যাগাজিনের গ্রাফিক্স ডিজাইনার নাঈম
৮ই মার্চ ২০২১

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply