ধান ভানতে শিবের গীত গাইতে আসিনি। কারণ, যেকথা বলতে এসেছি এটি ধান ভানার মত মামুলি ঘটনা নয়। বরং এটি বহু তরুণের জীবনে প্রপঞ্চক রাষ্ট্রের সীমাহীন অন্যায় আর নিপীড়নের হৃদয়গ্রাহী ঘটনা। ঘটনার পর ঘটনা ঘটে বাংলাদেশে। একটা ভুলে গিয়ে আরেকটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। তবু কিছু ঘটনা থাকে, বহুমানুষের কাছে যা মূল্যহীন, বহু মানুষের কাছে আবার অসীম বেদনার। হ্যাঁ, আমি হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিলিয়ে যাওয়া কোটা আর আমাদের নষ্ট হৃদয়ে বিবেকের হুল ফুটিয়ে দেয়া কিশোর আন্দোলনের পর গ্রেফতারকৃত তরুণ–তরুণীদের কথা বলছি, যাদের সবাই গুজব রটনাকারী নয়, যাদের অনেকেই তাঁদের হৃদয়নিংড়ানো ভালবাসা ঢেলে দিয়ে ঘুণে ধরা নষ্টের চূড়ান্ত একটি বেহায়া সমাজব্যবস্থাকে জাতে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল।
তত্ত্ব আর তথ্যের প্রণয় ঘটিয়ে এ নিয়ে বিস্তর লেখা সম্ভব। সেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞা আমার নেই। নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ আমি যার হৃদয়ে এই অনুজদের প্রতি রয়েছে গভীর মমতাবোধ। সেই মমতাবোধ থেকে প্রতিবাদ ও তাঁদের মুক্তির দাবীতে এই আমার লেখা। দু‘দিন পর ঈদ। আমাদের বহুজনের আনন্দের সীমা নাই। কিন্তু এই তরুণের মায়েরা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম শহরে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে ঈদের আগে প্রিয় সন্তান নিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে। একজন মানুষ হিসেবে আরেকজন মানুষের দুর্দশা দেখে যে হৃদয় হু হু করে উঠেনা সে হৃদয় পাথরের। আমার ধারণা, পৃথিবীতে এমন একটি হৃদয়ও নেই কোটা আন্দোলনের নেতা রাশেদের মায়ের যন্ত্রণায় কাতরানো দেখে স্থির থাকতে পারে।
দুগ্ধপোষ্য শিশু হরদম কাঁদে, বৃদ্ধ মানুষ কাঁদে প্রার্থনায়, কিন্তু পুলিশ ভ্যানে তরতাজা তরুণের কান্না অসহনীয়। সেই ছবি আমি এই লেখায় সংযুক্ত করেছি বটে, কিন্তু ছবির দিকে তাকিয়ে থাকার সাহস হয় না আমার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে–বাইরে‘ উপন্যাস থেকে সত্যজিৎ রায় একই নামে ছবি করেছিলেন। সিনেমার শুরুতেই নায়িকা বিমলার প্রথম উক্তি, ‘আমি আগুনের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। যেটুকু পুড়বার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আর যেটুকু বাকি আছে তার আর মরণ নেই।’ আমি নিশ্চিত বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে জন্মানো তরুণেরা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত বঞ্চিত শোষিত আর সভ্যতার নিম্নতম বল্গাহীন অশ্লীল রাষ্ট্রীয় প্রবঞ্চার শিকার।
একটি সমাজের সবচেয়ে করুণ অবস্থা কখন হয়? যখন জেনেও সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলা যায় না, সাদাকে সাদা বলা যায় না, দুর্নিবার অন্যায়কে মুখে কুলুপ এঁটে মেনে নিতে হয় অনাচার, দুরাচার। ওদিকে সুস্থ মানুষ আর সমাজের একটি দারুণ বৈশিষ্ট্য হল– যেকোন অবস্থায়, যেকোন স্থানে, যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক না কেন অন্তত সামান্যে হলেও প্রতিবাদটুকু জারি রাখা। আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে একারণে নয় যে ওই তরুণদের আমাদের প্রয়োজন, বরং আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে কারণ ওরা পাপহীন। যত প্রিয় সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, প্রতিবাদ সরকারের কর্ণকুহরে প্রবেশ করুক আর না করুক, তবু প্রতিবাদ না করে আমাদের চুপ থাকা ক্ষমাহীন অপরাধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত। সাহিত্যে নোবেলজয়ী জার্মান কবি গুন্টার গ্রাস ইসরাইলের অন্যায় দেখেও নির্লজ্জের মত পশ্চিমাদের নিশ্চুপ থাকা নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন, ‘যে কথা বলতেই হবে’ (What Must Be Said)। এরপর ইহুদীবিদ্বেষের ধুয়া তুলে তাঁকে ইসরাইল সরকার নিষিদ্ধ করেছিল। শত অত্যাচারের মধ্যে থেকেও আমাদেরও এই প্রতিবাদের কথা বলে যেতেই হবে।
বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ছিল বাংলাদশের সমান। তাঁর কন্যা সমুদ্রসীমা জয় করার মাধ্যমে জলভাগসহ বাংলাদেশের আয়তন দ্বিগুণ করেছেন। আপনার হৃদয়ও অসীম। আপনার থেকে বাংলাদেশের মানুষ প্রজ্ঞার রাজনীতি প্রত্যাশা করে।
***সমাপ্ত***
জাহিদ কবীর হিমন
শত্রুশহর আখেন থেকে
১৮ আগস্ট ২০১৮