কালচারাল শক দেশে-পরবাসে
কালচারাল শক সাধারণত দেশে এবং পরবাসে দুবার করে হয়। যেমন ধরুন প্রথম বিদেশে এসে রাস্তা পার হতে গেলে আমি গাড়ি দেখে জেবরা ক্রসিংয়ে এসেও দৌড়ে পার হতাম। অনেকদিন লেগেছে এটা মাথায় ঢুকাতে যে জেবরা ক্রসিং এ পা দিলে গাড়ি থেমে যায়। প্রথম দিকে গাড়ি গুলো দেখে থেমে যেতাম কিন্তু গাড়িও আমাকে দেখে থেমে গিয়ে হাতে ইশারা করতো যাও, আমিও বিভ্রান্ত সেই সাথে তারাও! অনেক সাধ্য সাধনার পরে একদিন মস্তিষ্ক এটা মেনে নেয় যে গাড়ি থেমে যাবে। কিন্তু দেশে গিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়ে আবার জেবরা ক্রসিং এ এসে মস্তিষ্ক বিভ্রাট ঘটে! এর পার জীবন হাতে নিয়ে আবার দৌড় দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হয়।
শব্দ! প্রথম এখানে এসে যখন সকালে ঘুম ভেঙেছে মনে হচ্ছিলো আমি ছাড়া এই দেশে কি আর কেউ বেচে আছে! কোন শব্দ নেই, এরপর দেশে ঘুম ভাঙে, ফেরিওয়ালার ডাকে, এই ঝাড়ু, টুং টাং, ঠক ঠক, ড্রাম, গড়ড়ড়, প্যাঁ।।আর এরপর মনে হচ্ছিলো দেশে সবাই অনেক জোরে জোরে কথা বলে কোন কারণ ছাড়াই। বিশেষ করে গাড়ির হর্ন, পাড়ায় পাড়ায় ওয়াজ এইগুলোর কোন নিয়মনীতি নেই!
প্রথম প্লেনে ওঠা থেকেই দেখা যায় এইসব দেশে বাথরুম শুকনো খটখটে ক্ষেত্র বিশেষে বাথরুমে কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া থাকে। শাওয়ার এর জন্য বাথটাব বা পর্দা দেওয়া ছোট্ট জায়গাটা দেখে ধাক্কা লাগে। আমাদের দেশে পুরো বাথরুম জুড়ে পানি ভিজিয়ে আমাদের অভ্যাস। কিন্তু কিছুদিন পরে এরকম অনুধাবন হয় যে শুকনো বাথরুমের কত সুবিধে, পা পিছলে পড়ার ভয় নেই আবার শীতকালে মুজো পরে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু দেশে গিয়ে এবার সেই সারাক্ষণ পানিতে ভেজা বাথরুম খুব অস্বস্তি লাগে।
সকালে নিজে নিজে কিছু একটা খেয়ে নেওয়া যায়, ব্রেড বাটার বা ওটমিল ইয়োগার্ট দশ মিনিটে সব শেষ! দেশে সেই সকালে মায়েদের রান্না শুরু হয় রুটি, ভাজি, ডিম , মানুষ বেশী হলে দুই তিন ঘণ্টার ধাক্কা! একবার আমি আর আমার এক ফ্রেঞ্চ বান্ধবী দুজনে মিলে সকালে একসাথে ব্রেকফাস্ট শুরু করেছিলাম। সে ওটমিল আর ইয়োগার্ট দিয়ে মেখে শেষ। আমি আবার চুলা জেলেছি ডিমের পোঁচ বানিয়েছি ব্রেড সেঁকে নিয়েছি তো আমার মিনিট দশেক লেগেছে। দেশের সেই রুটির আটা মাখা রুটি বেলা সেকা, ভাজি ডিম এর কাছে এ কিছুইনা।
ফ্রেঞ্চ মেয়েটা বলল, তুমি সকালেও রান্না কর? আমাদের দেশে আমরা সকালে চুলা জালায়না!
আমি একটু বিভ্রান্ত জিগ্যেস করলাম, কি রান্না দেখলে?
সে বলল, এই যে ডিম লবণ দিয়ে রান্না (ডিমের পোঁচ)।
আমি তাকে দেশে আমাদের বাড়িতে সকালের রান্নার বর্ণনা দিলাম, সাথে কুরবানির ঈদে মেয়েরা কি কি করে কিভাবে সবাই মাংস কাটে এবং ভুঁড়ি রান্না করে সেই ফিরিস্তি দিলাম, এবার সে বিভ্রান্ত! পাকিস্তানী দোকানে গিয়েছি বিরিয়ানি আর নেহারি খেতে, নেহারির দাম দেখে চোখ কপালে তুলেছি তো এরা বলল নেহারি রান্না হতে লাগে বার ঘণ্টা আর বিরিয়ানি চার ঘণ্টা। এই শুনে এসে ইলেকট্রিক প্রেশারকুকারে চড়িয়ে দিলাম নেহারি এক ঘণ্টায় রেডি! ঈশ এই ইলেকট্রিক প্রেশার-কুকার যদি মায়েদের দেশে থাকতো ঈদে তাহলে চাপ একটু কম হতো! এই শুধু রান্নার জন্য আমাদের দেশে মেয়েরা পড়াশোনা করেও কেউ কেউ সার্টিফিকেট আলমারিতে ভালো করে অতি যত্নে তুলে রেখে দিয়ে প্রতিদিন পাঁচ-ছয় ঘণ্টা করে রান্নাঘরে থাকে। এই মেয়েগুলো কেউ ডাক্তারি পড়েছিল কেউ আবার বুয়েটে পড়েছিল আবার কেউ ক্লাসে বা ভার্সিটিতে ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। কি কষ্ট না করেছে সেই সব এসএসসি, এইচএসসি এবং ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্টের দিন গুলোতে বা ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়?শুধু বিয়ের আগে পাত্র পক্ষের কাছে এবং নিজের বাড়ি এবং শশুরবাড়ির আত্মীয়দের কাছে প্রথম প্রথম আলোচনা হয় এরপর একে একে কাতান, বালুচুরি, বেনারসির ভাড়ে সেই সার্টিফিকেট আর খুলেও দেখা হয়না।
মেয়েরে এইসব দেশে চাকরি করে, কাজ করে, পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ করতে গিয়ে শাড়ি গহনা আর মেকআপ চুল এইসব নিয়ে ভাবার কথা ভুলে গিয়েছে হতে পারে। কেননা উনিশ শতকের শুরুতে এইসব দেশেও মেয়েরা চুলের খোঁপা, পা পর্যন্ত গাউন, মেকআপ, কাজল পড়তো যা সেই সব পুরনো এলবামে দেখা যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পরে যখন অনেক মেয়েরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়ে ইউরোপ কিছুটা পুরুষ শূন্য হয়ে পরে তখন এই মেয়েরা সব গাউন, বড় চুলের খোপা ফেলে দিয়ে কেবল জিনস টিশার্ট পড়ে কাজে বেরিয়েছে যে সেই আজো সেটা চলছে। এদের এতো শক্তি যে মেয়েরা আর ছেলেরা সমানে ইন্ডাস্ট্রি গুলোতেও হেভি ওয়েট কাজ করে।ইদানীং আম্মাদের এতো বড় একটা শাড়ী পরে সাঁতার কাটা এবং ঘুমানো কিভাবে সম্ভব সেটা ভেবে কিছুটা বিস্ময় লাগে। বড়জোর সারাদিনে শাড়ি পরে নেওয়া যায়, কিন্তু সাঁতার আর ঘুম আয়ত্ত করা সে একটা সত্যি অনেক সাধনার ফল।
তুমি ড্রাইভিং শেখোনি?
না, আমাদের দেশে গাড়িতে ড্রাইভার থাকে, সেই গাড়ি চালায় আর সবাইকে একে একে বাড়ি থেকে তুলে স্কুলে বা অফিস পৌঁছে দেয়।
আর যাদের গাড়ী নেই? রিকশা!
আমি স্কুলে থাকতে হেটে না গিয়ে রিকশায় যেতাম, কলেজেও রিকশা, ইউনিভার্সিটিতেও সেই, টিএসসি কলাভবন সব রিকশা করে। অফিস যাবো বিটিভির পিছনে বাসা সেও রিকশা করে।। হাটতে গেলে পায়ে ব্যথা লাগতো! সেই আমি বিদেশে এসে প্রথম যেটা শক ছিল রিকশা নেই এইসব দেশে রিকশা নেই কারো, সবাই সাইকেলে চড়ে। ছেলে-মেয়ে বুড়ো, বাচ্চারা সবাই। আমি তো সাইকেল চালাতে পারিনা এই শুনে সবাই অবাক কেন?
কেন তুমি সাইকেল চালানো শেখোনি?
ভারতীয় মেয়েরা তো খুব ভালো সাইকেল চালাতে পারে।
আমি খুব বিব্রত অবস্থায় বললাম, আমাদের দেশে তো আগে মেয়েরা ড্রাইভিং করতো না, সাইকেল চালাতও না আমি আবার জন্মেছি রিয়াদে, সৌদি আরব।দেশে কিছু কিছু মেয়েরা সাইকেল চালায় কিন্তু আমার বাবামা সদ্য হজ করে এসেছেন তখন আমাদের বাড়ির মেয়েদের এইসব চল নেই।
ওরা এরপর চোখ কপালে তুলে বলল তো তুমি স্কুল কলেজ কিভাবে গিয়েছ!!
আমি এবার আরও বিভ্রান্ত হয়ে বললাম আমাদের দেশের সাইকেলের মত তিনচাকার রিকসা আছে সেখানে এদের টাকা দিলে স্কুলে দিয়ে আসে। কলেজে আবার বাবামা থাকতো সাথে।
ওরা ঃ সে কি একজন মানুষ তোমাকে পেশী শক্তি দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যেতো ! এইসব দেশে অনেক আগে গরু, ঘোড়া এইসব করতো কিন্তু দিন বদলের পরে ইঞ্জিন এসেছে এখন গরু এবং ঘোড়াও করেনা।
![](https://www.germanprobashe.com/wp-content/uploads/2018/08/kolkata-rickshaw-pullers-17.jpg)
The future of about 18,000 rickshaw pullers in the city, earning an avarage daily wages of about 100 rupees ($2.5)
is unclear as they call for a compensation package to help them rehabilitate into alternative jobs.
এরপরে এরা রিকসা কিরকম দেখতে চাইলো ইন্টারনেটে খুঁজে দেখি কলকাতার রাস্তায় রিকশায় সামনে চাকা নেই মানুষ টেনে নিয়ে যাচ্ছে তীব্র রোদে, পানিতে ভিজে, আর দুজন -তিন জন বসে আছে! এই ছবি দেখাতে গিয়ে নিজের চোখ ভিজে গেলো, লজ্জা লাগছিলো রিকশা চড়ার কথা ভেবে।
রাশা বিনতে মহিউদ্দিন
সেপ্টেম্বর, স্টূটগার্ট।