আমি গত মাসের (এপ্রিল ২০১৮) ২৫ তারিখ জব নিয়ে জার্মানি এসেছি। এ ব্যাপারে নানা তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে জার্মানপ্রবাসে গ্রুপ। সে দায়বদ্ধতা থেকেই এই লেখা। এছাড়া ব্যক্তিগত পরিচয় থেকে সাব্বির ভাই, আসিফ ভাই, রিপন ভাই, রুহুল ভাই উনারা অনেক তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন, আমি উনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। ঘটনাক্রমে উনারা প্রত্যেকেই এই গ্রুপের সদস্য। এছাড়াও বিসাগ থেকেও অনেক তথ্য সহায়তা পেয়েছি। তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা।
ব্যাক স্টোরি
আমি প্রথম ইউরোপে আসি গত বছরের(২০১৭) সেপ্টেম্বরে। এর আগে কয়েকটি দেশ ভ্রমনের সুযোগ হলেও সেগুলি আমাকে তেমন আকর্ষন করেনি। ইউরোপের উন্নত জীবন দেখে আমার মনে একটা বাসনা জাগে আমাকে এখানে সেটেলড হতে হবে। কিন্তু তখন আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা ছিলো, তাই মনের বাসনা মনেই রেখে দিলাম। এর মধ্যে ২০১৮ এর জানুয়ারির ১২ তারিখে আমার কলিগ এবং বন্ধু আসিফ ভাই জানালেন, উনার জার্মানিতে ভিসা হয়ে গেছে, এবং উনি ঐ মাসেই জার্মানিতে পাড়ি জমান। এটা আমাকে মারাত্মকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। আমি সেই দিন থেকেই আবেদন করা শুরু করি। এর দুই মাসের মাথায় আমায় চাকুরি হয়ে যায়। চাকুরির হওয়ার পরের মাসে জার্মানিতে চলে আসি। দেশে আমি মোটামুটি ভালোই ছিলাম, দেশ ছাড়ার পেছনে এটা ছাড়াও আরো অনেকগুলো ব্যক্তিগত কারন ছিল।
আরো পড়তে পারেনঃ চাকরি এবং জার্মানি – Career advice from Asgar Hossain
চাকুরির আবেদন
আমার সিভি তৈরি করাই ছিল। আমি প্রথম দিনেই স্ট্যাক ওভারফ্লো এবং লিঙ্কডইন মিলে প্রায় ৩০ টি আবেদন করে ফেলি। সেই একই ঘটনা এখানে, একই সিভি এবং কভার লেটার দিয়ে সবগুলোতে আবেদন করি। এবং পরের ২–৩ দিনের মধ্যে দেখতে পাই প্রায় সবাই আমাকে না করে দিয়েছে। এটা আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা। কারন দেশে থাকতে আমি কখনো চাকুরির আবেদন করার পর না শুনি নি। এটলিস্ট সবাই ইন্টারভিউতে ডেকেছে, আর ৯৯% ইন্টারভিউয়ের পরেই আমি চাকুরির অফার পেয়েছি। সেখানে ইন্টারভিউতেই ডাক না পাওয়ায় আমি হতাশ হই।
এরপর এর কারন খুঁজতে বের হই, আর তখন আবিষ্কার করি, আসলে যত্ন করে এপ্লাই না করলে লাভ নেই। এরপর থেকে প্রত্যেকটা এপ্লাই করার আগেই সেই কোম্পানির ওয়েবসাইট, রিক্রুটার বা এইচআর এর প্রোফাইল ঘেটে কোন তথ্য খুজে পাওয়া যায় কিনা সেটা দেখতে থাকি। এবং সে অনুসারে কভার লেটার লিখি। একটা উদাহরন দেই, আমি একটা কোম্পানীর সিনিয়র পিএইচপি ডেভেলপার পদে এপ্লাই করার জন্য এইচআর এর প্রোফাইল দেখি। সেখানে দেখি সে পাবলিক হেলথ নিয়ে কাজ করেছে, যাতে আমারও আগ্রহ এবং কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। আমি কভার লেটার না লিখে তাতে লিখলাম, তোমার এই কাজটা আমি দেখেছি, আমার খুবই ইমপ্রেসিভ মনে হয়েছে। আমি কি তোমার সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা বলতে পারি? বাই দ্য ওয়ে, আমি দেখলাম তোমার কোম্পানী সিনিয়র সফটয়্যার ইঞ্জিনিয়ার পদে লোক নিচ্ছে। আমিও চাকরি খুজছি। তুমি চাইলে আমার সিভিটা দেখতে পারো। বলুন তো, রিপ্লাইয়ে আমি ইন্টারভিউয়ের ডাক পেয়েছিলাম কিনা? এ ধরনের পার্সোনাল টাচ যদি ইমেইলে দিতে পারেন, তাহলে অবশ্যই আপনি ইন্টারভিউতে ডাক পাবেন।
এপ্লাই করার সময় আমি কিছু ফিল্টার ব্যবহার করতাম, যেমন– ভিসা আর রিলোকেশন স্পন্সর করবে কিনা এসব। আর আমি শুধুমাত্র জার্মানি আর নেদারল্যান্ডসে এপ্লাই করেছি, অন্য কোন দেশে করি নি।
আর একটা বিষয়, যদি আপনার পরিচিত কেউ বাইরের কোন কোম্পানিতে থাকে তাহলে চেষ্টা করুন তার সাথে যোগাযোগ করে তার কোম্পানিতে কোন খালি পোস্টে এপ্লাই করতে। এতে করে আপনার ইন্টারভিউতে ডাক পাবার সম্ভাবনা শতগুন বেড়ে যাবে। আর যে ইন্টারভিউয়ের জন্য আপনাকে রেফার করবে তারও লাভ আছে। যেমন আমার কোম্পানীতে রেফারেল বোনাস ২০০০ ইউরো বা ২ দিনের ভ্যাকেশনের সমস্ত খরচ। অধিকাংশ কোম্পানিতেই রেফারেল সিস্টেম আছে, আর কিছু কিছু কোম্পানি আরো অনেক বেশি বোনাস দেয়। আমি শুনেছি, গুগলে রেফারেল বোনাস ৮০০০ ইউরো।
আরো পড়তে পারেনঃ জার্মানিতে রয়েছে স্কলারশিপ নিয়ে ইন্টার্নশীপ করার সুযোগ …
ইন্টারভিউ
এটা হচ্ছে জার্মানি আসার সবচেয়ে কঠিন ধাপ। প্রত্যেকটা কোম্পানি ৫–৭টা ইন্টারভিউ নিয়ে তবেই চাকুরি কনফার্ম করে। ইন্টারভিউয়ের মধ্যে স্কাইপ ইন্টারভিউ, হ্যাকারর্যাঙ্ক বা কোডালিটিতে কোডিং টেস্ট, লাইভ কোডিং টেস্ট থাকে। আমি এখন যেখানে কাজ করছি, তারা আমার ৬টা ইন্টারভিউ নিয়েছে। প্রথমে স্কাইপে এইচআরের সাথে ইন্টারভিউ, তারপর হ্যাকারর্যাঙ্কে প্রবলেম সলভিং। এরপরের দুইটা ইন্টারভিউ ছিল ভাইবা ইন্টারভিউ সিনিয়র টিম মেম্বারদের সাথে, প্রত্যেকটাই প্রায় ঘন্টাতিনেক করে। এরপর একটা লাইভ কোডিং টেস্ট, যেটা ছিল ৯ ঘন্টার। আমাকে অনলাইনে একদিন ওদের সাথে সারাদিন অফিস করতে হয়েছে। এরপর কোম্পানির সিটিওর সাথে ঘন্টাদুয়েকের একটা টেস্টের পর তারা আমাকে কনফার্ম করেছে।
আমি শুধু এই কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দেই নি। আরো অনেকগুলো কোম্পানীতে ইন্টারভিউ দিয়েছি, এদের মধ্যে প্রায় ১০ টা কোম্পানীতে ৪–৫টা করে ইন্টারভিউ দিয়েছি। একটা কোম্পানী তো ৭ টা ইন্টারভিউ নেয়ার পরে বলে আমি তাদের পোস্টের জন্য ওভার কোয়ালিফাইড, তাই আমাকে নেবে না। খুব হতাশ লাগতো। তবে শেষ পর্যন্ত ২টা কোম্পানী আমাকে অফার করেছে। এদের থেকে আমি একটা বেছে নিয়েছি। আমি সর্বমোট ৭০–৭৫ টি কোম্পানিতে এপ্লাই করি, যার মধ্যে মাত্র দুইটা জব হয়েছে। আপনি যখন জবের জন্য এপ্লাই করছেন, তখন আপনার মাত্র একটা জব দরকার। তাই, যদি ১০০ টা এপ্লাই করার পরে মাত্র ১টা তে জব হয়, তাতেও কোন সমস্যা নেই। আপনি চেষ্টা চালিয়ে যান, সফলতা আসবেই।
আর একটা কথা, আপনারা যখন সিভি পাঠাবেন, তখন অবশ্যই ট্যাবুলার ফরম্যাটে পাঠাবেন। এখানে এটা ছাড়া অন্য কিছু চলে না। একটু গুগল করলেই আপনারা এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। সিভিতে যেসব বিষয় খুব ভালো করে জানেন, শুধুমাত্র সেগুলোর কথা লিখবেন। কারন আপনার সিভি ধরে ধরেই ওরা আপনাকে প্রশ্ন করবে। ইন্টারভিউ নিয়ে আর বেশি কিছু বলার নেই। যারা ইতোমধ্যে কাজ করেন, বা ইন্টারভিউ দেয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তারা জানেন, ইন্টারভিউ কম–বেশি সব জায়গায় একই রকম হয়। আপনি সব প্রশ্নের উত্তর জানবেন না এটাই স্বাভাবিক। তবে পজেটিভ এটিচিউড ধরে রাখতে হবে।
আরো পড়তে পারেনঃ ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের বেতন এবং চাকরির খবর – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ৪
ভিসা
কনফার্মেশনের পর আপনাকে ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে। বাংলাদেশে জার্মান এম্বেসী নতুনবাজার মাদানী এভিনিউতে অবস্থিত। ভিসার জন্য অনলাইনে এপ্লিকেশন করে এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়। সাধারনত ১ মাসের আগে এপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায় না। তবে আপনার হাতে যদি এত সময় না থাকে, এপয়েন্টমেন্ট নেয়ার পরে আপনি এম্বেসীতে মেইল করতে পারেন। আমার ক্ষেত্রে তারা ৪৮ দিন পরে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিল। একটা মেইল করার পর তারা ১৩ দিন পরের একটা তারিখ দেয়। তাই এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ভিসা ফরম পূরন করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেলেই হয়। তবে সব কিছুর দুইকপি করে ফটোকপি নিয়ে যাবেন, আবেদনপত্রেরও। আর পুরো জার্মানিতে ছবির মাপ হচ্ছে ৩৫×৪৫ মিমি। তাই এই মাপের ছবি ভালো স্টুডিও থেকে তুললেই হবে। গুলশানে কিছু স্টুডিও আছে যাদের কাছে গিয়ে দেশের নাম বললেই ছবি তুলে দেয়। আমি তুলেছিলাম বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গেট থেকে। আর এ দেশে আসার আগে বেশি করে ছবি প্রিন্ট করে আনলে ভালো হয়। এখানে ৪ কপি ছবি তুলতে ৬ ইউরো লাগে। তাও নিজের ছবি নিজেকেই তুলতে হয়।
ভিসা ইন্টারভিউ খুবই সহজ হয়। আপনার কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাইবে। চাকুরি নিয়ে বড়জোড় দুই–চারটা প্রশ্ন করতে পারে। যেহেতু আপনি ইতোমধ্যে ইন্টারভিউ দিয়ে চাকুরি পেয়ে গেছেন, এসব আপনার কাছে ডাল–ভাত। একটু ভদ্রচিত পোশাক পড়ে গেলে ভালো হয়, এটলিস্ট হাফপ্যান্ট জাতীয় কিছু না পরে যাওয়াই ভাল। আমি জিন্স আর শার্ট পরে গিয়েছিলাম, সাথে স্যান্ডেল। আমি ইন করি না, তাই সেদিনও করি নি।
সব ঠিক থাকলে আপনি ১৫–৪৫ দিনের মধ্যে ভিসা পেয়ে যাবেন। আমার কোম্পানী আমার জন্য আগে থেকেই ফেডারেল এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সী থেকে অনুমোদন নিয়ে সেটা আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আমার জন্য সেটা ছিল খুবই কাজের। তারা আমার কোন কাগজই আর ভেরিফাই করার জন্য জার্মানি পাঠায় নি। আমি মাত্র ১ দিনের মাঝে ভিসা পেয়ে যাই। আপনিও আপনার কোম্পানির এইচআরের সাথে কথা বলে এটা যোগার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হবে।
আরো পড়তে পারেনঃ Praktikum – Abschlussarbeit(থিসিস) খোঁজার ইতিকথা
বিমানের টিকেট
আমি ভিসা পাবার পর বিমানের টিকেট কিনি। আপনার যদি ক্রেডিট কার্ড থেকে থাকে, বা অনলাইনে পেমেন্ট করার কোন অপশন থেকে থাকে, চেষ্টা করবেন সেটা ব্যবহার করে সরাসরি বিমান কোম্পানীর ওয়েবসাইট থেকে টিকেট কাটতে। এক্ষেত্রে এটা সবচেয়ে সস্তা পড়বে। আর কোন এয়ারলাইন্স সস্তা এ নিয়ে হাজারখানেক সাইট আছে ইন্টারনেটে। আমি সাধারন স্কাইস্ক্যানার আর কায়াক এই দুইটা সাইট ব্যবহার করি। আপনি যদি স্টুডেন্ট হন, তাহলে আপনার জন্য চমৎকার একটি অপশন হতে পারে স্টুডেন্ট ইউনিভার্স। এরা ছাত্রদের জন্য অনেক সস্তায় টিকেট দিয়ে থাকে। এ সম্পর্কিত কয়েকটা আর্টিকেল আপনি বিসাগ বা জার্মান প্রবাসে সাইটে পেয়ে যাবেন।
বিমান ভ্রমন
ঢাকা থেকে সরাসরি জার্মানির কোন ফ্লাইট নেই। আপনাকে সাধারনত মিডল ইস্টের কোন এক জায়গায় বিসান পরিবর্তনের জন্য থামতে হবে। অবশ্যই খেয়াল রাখবেন আপনার লাগেজের ওজন যাতে বিমানের নির্ধারিত ওজনের চেয়ে বেশি না হয়। বিমানবন্দরে গিয়ে ঝামেলায় পড়ার চেয়ে কিছু জিনিস কম নিয়ে যাওয়াই ভালো।
শেষ কথা
জার্মানি আসা নিয়ে আপনাদের যত প্রশ্ন আছে, তার সবগুলোর উত্তরই এই সাইটে পেয়ে যাবেন। আর প্রশ্ন করার জন্য ফেসবুক গ্রুপ তো আছেই। তারপরও যদি আমার কাছে কোন প্রশ্ন থাকে, আমাকে ইমেইল করলে আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবো।
আরো পড়তে পারেনঃ