চাকুরীর ইন্টারভিউ এর অভিজ্ঞতা সবারই থাকে, এ আর নতুন কি।  না আমার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাটা একটু অন্য রকমই মনে হয়।  আজ সেই অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তুলে ধরতে ইচ্ছে করছে।

Globalfoundries নামে একটি সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানি তে প্রায় দুই বছর এর পার্ট টাইম জব আর ইন্টার্নশীপ শেষ করার পর সেই কোম্পানিতেই শুরু করলাম মাস্টার থিসিস। থিসিস প্রায় শেষ পর্যায়ে।  নিয়মিত সিভি পাঠানো শুরু করলাম কোম্পানি গুলোতে। পাশাপাশি LinkedIn, মনস্টার, Xing ইত্যাদিতে প্রোফাইল আপডেট করা শুরু করলাম।  অক্টোবর ২০১৫ এর  শুরুর দিকে নেদারল্যান্ডস এর একটা রিক্রুটিং এজেন্সী থেকে ফোন আসলো।  তারা একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এর জন্য সেমিকন্ডাক্টর ফিল্ড এর উপর ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ার খুঁজছে।  আমার প্রোফাইল তারা মনস্টার এ পেয়েছে এবং তাদের পছন্দ হয়েছে।  এখন আমি যদি রাজি থাকি তাহলে ওই কোম্পানিতে আমার সিভি তারা ফরওয়ার্ড করবে।  আমার তো তখন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি অবস্থা, রাজি আবার না থাকি কিভাবে।  আমি এপ্লাই করছিলাম ছোট খাটো কোম্পানিগুলোতে ছোট খাটো পজিশন এর জন্য।  মাত্র গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করবো।  অত বড় কোম্পানিতে এপ্লিকেশন এর জন্য দুঃসাহস জোগাড় করতে পারছিলাম না।   সেই ক্ষেত্রে আমাকে যদি ওরা ইন্ট্রোডিউস করে দেয় তাহলে তো আর কথা থাকতে পারে না।  তাই হার্টবিট মারাত্তক ভাবে বেড়ে গেলো।

যাই হোক কিছু কাগজপত্রে দস্তখত করার পর ওরা জানালো ওরা আমার সিভি কোম্পানিতে ফরওয়ার্ড করবে আর কিছু জানলেই আমাকে জানাবো।  শুরু হলো অপেক্ষার পালা। প্রায় এক সপ্তাহ পর এজেন্সি থেকে ফোন আসলো। গ্রূপ ম্যানেজার আমার সিভি পছন্দ করেছে এবং আমার সাথে কথা বলতে চায়।  এখন ইন্টারভিউ এর ডেট ঠিক করার পালা।  ইন্টারভিউ এর ডেট ঠিক হলো এবং অক্টোবর এর ২৭ তারিখ গেলাম নেদারল্যান্ডস এর ছোট্ট কিন্তু, ফিলিপ্স এর শহর আইনডহবেন এ বৌকে সাথে নিয়ে।   ২৭ তারিখ দুপুরে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম কোম্পানি এর নির্দিষ্ট বিল্ডিং এ।  এখান থেকেই নাটক এর শুরু।

রিসেপশন এ এসে যখন ইনফর্ম করলাম আশ্চর্যজনক ভাবে জানতে পারলাম ওদের জানানো হয় নি আজ যে আমার ইন্টারভিউ।  ওরা ডিপার্টমেন্ট এ ফোন দিলো ম্যানেজার এর কাছে এবং জানতে পারলো ম্যানেজার অসুস্থতার কারণে ছুটিতে।  ম্যানেজার এর পার্সোনাল ফোন এ কল দিয়ে জানতে পারলো উনি ইনফর্ম করতে ভুলে গেছেন।  উনি একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার কে ফোন দিলেন আমার সাথে দেখা করার জন্য এবং প্রয়োজনীয় আলাপ সারার জন্য।  প্রায় আধা ঘন্টা অপেক্ষা করার পর সেই ইঞ্জিনিয়ার আসলেন আমাকে অফিস বিল্ডিং এ নিয়ে যেতে।  প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ তার সাথে কথা বার্তা হলো।  নানা বিষয় আলোচনা , আমার এডুকেশন, রিসার্চ এর অভিজ্ঞতা, থিসিস কিসের উপর করছি এই সব।  আমি আসলে আশা করছিলাম টেকনিকাল প্রশ্ন কারণ তাদের কাছে অলরেডি আমার সিভি আছে , কিন্তু জানতে পারলাম সে আমার সিভি আগে দেখেনি তাই আমার ব্যাপারে তার কোনো আইডিয়া নাই।  সো যা বলার আমাকেই বলতে হবে।  মামা ধরাতো এই জায়গাতেই  খাইলাম।  বুঝতে পারছিনা খালি কি নিজের প্রশংসা করবো যে আমি এই পারি, সেই পারি হাবিজাবি কত কিছু পারি , নাকি কি পারিনা সেটাও বলবো।  কারণ আমি জানি ইন্টারভিউতে এই ধরনের প্রশ্ন করেই থাকে।  যাই হোক হাবিজাবি আলাপের পর সে জানালো তার প্রশ্ন করা শেষ।  এখন সে ম্যানেজার এর সাথে আলোচনা করবে এবং আমার এজেন্সী কে জানিয়ে দিবে।  ধন্যবাদ দিয়ে চলে এলাম হোটেল এ।  এজেন্সী কে ফোন দিয়ে জানালাম ম্যানেজার ছিলোনা আর তারা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতও ছিল না।  কয়েকদিন এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করে চলে আসলাম ড্রেসডেন।

থিসিস এর কাজ শেষ, রিপোর্ট ও লিখা শেষ এখন ডিফেন্স এর ডেট পাওয়ার পালা।  ডিফেন্স এর ডেট পেলাম জানুয়ারী তে।  এদিকে তো আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা।  চাকুরীর এর কোনো খবর নাই।  এজেন্সী কে ফোন দিলে ওরা বলে কোম্পানি  কোনো খবর জানায় নাই।  দাঁত মুখ খিঁচে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় নাই।  মেজাজ গরম করে এজেন্সিকে বললাম আমার ট্রাভেল কস্ট রেইমবার্স করো।  বহুত টাকা খরচ হইছে এই ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে।  তারা সেই টাকাটা ফেরত পাঠালো।

জানুয়ারীতে থিসিস  ডিফেন্স করে ফেললাম এবং সম্পূর্ণ রূপে বেকার হয়ে আবার চাকুরী খুঁজতে মন দিলাম। আরো ৩ মাস পার হলো।  অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত দিন।  এপ্রিল এ এজেন্সী থেকে ফোন আসলো যে ম্যানেজার আমাকে আবার ডেকেছেন।  উনি দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত এবং আবার আমার সাথে কথা বলতে চান।  কি সব ম্যানেজমেন্ট রিলেটেড সমস্যার কারণে নিয়োগ স্থগিত হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এখন আবার নিয়োগ শুরু হয়েছে।  আবার ইন্টারভিউ এর ডেট পড়লো এপ্রিল এর শেষে।  ভয়ে আছি এপ্রিলফুল হতে যাচ্ছি নাতো?

Job

যথাসময়ে আইনডহবেন এসে উপস্থিত হলাম। ইন্টারভিউ সময় সকাল ৯ টা। এই বার মনে হলো পুরো ডিপার্টমেন্ট ইন্টারভিউ নিতে চলে আসছে।  মোট মিলিয়ে ৬ জন।  ২ ধাপে ইন্টারভিউ।  প্রথমে টেকনিকাল আলোচনা।  বুঝতে পারলাম আমাকে খেঁচা দিতে তারা আমার সিভি আগা টু গোড়া মুখস্ত করে এসেছে।  ১ ঘন্টা ঝড় গেলো আমার উপর দিয়ে।  এই বার পরবর্তী ধাপ।  শুরু HR  রিলেটেড ইন্টারভিউ।  স্বয়ং ম্যানেজার উপস্থিত সাথে টীম লিড, প্রজেক্ট লিড ইত্যাদি ইত্যাদি। ২ ঘন্টার পানিশমেন্ট শেষে ম্যানেজার সাহেব আমাকে দাওয়াত করলেন উনার সাথে দুপুরের খাওয়ার খেতে।  এই সুযোগ তো মিস করা যায় না।  এতো বড় কোম্পানিতে চাকুরী না পাই অন্তত খাওয়ার সুযোগ তো মিস করা যায় না আর এই তো সুযোগ ম্যানেজার এর কাছে নিজেকে মেলে ধরার।  আমি জার্মানি কেন আসছি, কেন জার্মানি পছন্দ করি।  একটু তেল মারার চেষ্টা আরকি।  বলতে ভুলে গেছি ম্যানেজার সাহেব কিন্তু জার্মান, বাড়ি Wuppertal এ।  সব শেষে ম্যানেজার বললেন তিনি ২, ১ দিনের মধ্যেই ডিসিশন জানিয়ে দিবেন।  এই বার আর দেরি হবে না এবং আগের বারের জন্য সরি হলেন।  আমি চাকুরী না হওয়ার আশা নিয়ে চলে আসলাম ড্রেসডেন।  এই চাকুরী এর চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম মাথা থেকে।  আমার মতো ছোট দেশের ছোট মানুষকে কি আর নিয়োগ দিবে এই পসিশন এ। তাছাড়া মাত্র মাস্টার্স শেষ করেছি , নাই পিএইচডি অথচ এই পজিশন এর রেকুইরেমেন্টস হচ্ছে পিএইচডি। আর যখন এই পজিশন এর জন্য ডাচ, ইন্ডিয়ান, ইউরোপিয়ানরা যুদ্ধ করছে।  এতো বড় কোম্পানি বলে কথা।  কিন্তু না যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতার দাম সব জায়গাতেই আছে। এর কিছুদিন পর তা টের পেলাম।  চলে আসার ২ দিন পর আসলো এজেন্সী থেকে কল।  সকাল বেলার আরামের ঘুমটা দিচ্ছিলাম মাত্র।  আধো ঘুম জড়ানো অবস্থায় শুনতে পেলাম ওপাশ থেকে ভদ্র মহিলা বলছে ‘ওই মিয়া ঘুম বাদ দাও, গাট্টি গোস্তা বাধো, আর আইনডহবেন  চলে এস।  তোমার চাকুরী কন্ফার্ম ‘। দিলো তো ঘুম টা হারাম করে।

কথা গুলো অনেকটা সহজ ভাবে হয়ে গেলো , কিন্তু মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের যোগ্যতার উপর কখনো আস্থা হারানো যাবে না।  আমার যা আছে তাই নিয়ে আমি অনেক শক্তিশালী। শুধু মাত্র সিভি টাকে যদি যথাযোগ্য ভাবে উপস্থাপন করা যায় আর ইন্টারভিউতে নিজেকে সঠিক ভাবে, কনফিডেন্স সহকারে মেলে ধরা যায় তাহলে সফলতা কেউ আটকাতে পারে না।

আজ এই পর্যন্তই। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।


আরো পড়তে পারেনঃ

বাংলাদেশে থেকে জার্মান ব্লু কার্ড এবং ভিসা পেতে হলে

জার্মান সিভি/লেবেন্সলাউফ/CV/Lebenslauf – ২০ টি উদাহরণ – (১৫-২০)

ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের বেতন এবং চাকরির খবর – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ৪

চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ০০ – এপ্লিকেশন প্রিপারেশন (১০টি টিপস)

জার্মানিতে চাকরি – কিছু অভিজ্ঞতা, কিছু পরামর্শ (তানভীর হুসেইন)

ইউরোপে সামার ইন্টার্নশিপঃ অভিজ্ঞতা এবং বাস্তবতা

mm

By Shawn Nipun

This is Shawn. Graduated from TU Dresden in Nanoelectronics Systems. Currently, working as a Design Engineer in ASML, Eindhoven Netherlands.

Leave a Reply