পূর্ববর্তী উপপর্বঃ ফ্লোরেন্স/ফিরেন্তসে

৮ই সেপ্টেম্বর সকাল ০৬টা ৩০ মিনিটে পৌঁছলাম রোমে, সেই রোম, যেটা বিগত তিন হাজার বছর যাবত ইতিহাসের নানা ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। ভেনিস এবং ফ্লোরেন্সে সব কিছু মোটামটি হাটা দূরত্বের হওয়ায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে তেমন একটা চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু রোম বিশাল শহর, এখানে হেটে সব যায়গায় যাওয়া সম্ভব না। সাশ্রয়ী হওয়ায় এবং ঝামেলা মুক্ত থাকার জন্যে তাবাক্কি খুঁজে বের করে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার সিটি পাস কিনে নিলাম যেটা রোমের যে কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই গ্রহণযোগ্য। ৪ রোমানের সহযোগিতায় বুঝে নিলাম হোস্টেলে যেতে হবে কিভাবে। উল্লেখ্য রোমেও ক্যাম্পিং ভিলেজের হোস্টেল ক্যাম্পিং ভিলেজ রোমায় আমার এবং বন্ধু হাসনাইনের জন্যে ২ বেডের একটা তাঁবু বুক করে রেখেছিলাম। যেহেতু আমাদের চেক ইনের সময় দুপুর ১টা তাই আপাতত হোস্টেলের লেফট লাগেজ রুমে আমাদের ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পরলাম রোম ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে।

ক্যাম্পিং ভিলেজের হোস্টেল ক্যাম্পিং ভিলেজ রোমায় আমাদের তাবু
ক্যাম্পিং ভিলেজের হোস্টেল ক্যাম্পিং ভিলেজ রোমায় আমাদের তাবু

রোমে যাবো আর ভ্যাটিকান সিটিতে যাবনা সেটা তো হতেই পারে না, তাই হোস্টেল তেকে বের হয়েই রওনা হলাম ভ্যাটিকানের উদ্দেশ্যে। সকালে তখনও নাস্তা করা হয়নি, তাই বাস স্টপে নেমে একটু খুঁজে বের করলাম ইতালীয় খাবারের দোকান। বেশ কিছু ইতালীয় খাবার দিয়ে বেশ ভারী একটা নাস্তা শেষ করে পা বাড়ালাম ভ্যাটিকান সিটির উদ্দেশ্যে।

ভ্যাটিকান মিউজিয়াম
ভ্যাটিকান মিউজিয়াম

ভ্যাটিকানের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ কিছু গল্পের বইয়ের মাধ্যমে, আর ড্যান ব্রাউনের হাত ধরেতো ঘুরে বেড়িয়েছি ভ্যাটিকানের আনাচে কানাচেতেও। তাই ভ্যাটিকানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ অনেকটা ইদানীং কালের ফেসবুকে প্রেমের পরে প্রেয়সীর সঙ্গে সামনাসামনি প্রথম সাক্ষাৎ এর মতো। তাই দেখা হওয়ার আগে থেকেই একটা উত্তেজনা ছিল, এমনকি সেইন্ট পিটার্স স্কয়ারের বিশাল লাইনও সেই উত্তেজনায় ভাটা আনতে পারেনি।

সেইণ্ট পিটার্স স্কয়ার
সেইণ্ট পিটার্স স্কয়ার

যারা ভ্যাটিকান সম্পর্কে খুব বেশী জানেন না তাদের জন্যে বলে রাখি, ভ্যাটিকান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পৃথিবীর সবথেকে ছোটো স্বাধীন রাষ্ট্র এবং সম্ভবত একমাত্র দেশ যেটা অন্য একটি দেশের মধ্যখানে অবস্থিত। এই কারণে রোম কে অনেকেই একইসঙ্গে দুটি দেশের রাজধানী বলে থাকেন। ভ্যাটিকান শাসন করে থাকেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সর্বচ্চ ধর্মীয় গুরু পোপ। ক্যাথলিক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম পুণ্যভূমিও এই ভ্যাটিকান। মূলত খ্রিস্টান ধর্মের উত্থানের সঙ্গে রোম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিস্তারিত বলার মত জ্ঞান আমার নেই, তবে খুব অল্প কথায় একটু বলার চেষ্টা করতে পারি। ৭৫৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এক হাজার বছরের বেশী সময় ধরে ইতালিয়ের বেশ কিছুটা অংশ নিয়ে প্যাপাল স্টেট ছিল যেটা পোপ কর্তৃক শাসন করা খ্রিস্টান ধর্ম ভিত্তিক সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি রাষ্ট্র ছিল। খ্রিস্টান ধর্ম বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ কে বেগবান করতে এই রাষ্ট্র এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দে এই রাষ্ট্রকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। তবে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিনি ভ্যাটিকান কে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বকৃত দেন এবং এর শাসনভার প্যাপাল স্টেটের মত পোপের হাতে ন্যস্ত করেন।

সেইণ্ট পিটার্স বাজলিকা
সেইণ্ট পিটার্স বাজলিকা

যারা ভবিষ্যতে ভ্যাটিকান যেতে চান তাদের জন্যে আমার কিছু পরামর্শ আছে। খরচ একটু বেশী হলেও চেষ্টা করবেন গাইডেড ট্যুরের প্যাকেজ নিতে। প্রথম কারণ আপনাকে কোথাও দীর্ঘ লাইনে দাড়াতে হবেনা, তবে এর থেকেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ কারণ অভিজ্ঞ গাইডের ধারাবর্ণনা। ভ্যাটিকানের সব কিছুর সঙ্গেই ইতিহাস জড়িত তবে সব কিছু সম্পর্কে লেখা নেই, এছাড়া অনেক জিনিস আছে যেগুলো এমনিতে হয়ত চোখে পড়েনা কেউ বলে না দিলে, যেমন সিস্টিন চ্যাপেলের ছাদের দিকে না তাকালে মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর এক অনিন্দ্য সুন্দর কীর্তি মিস করতে হবে। কিন্তু আপনি কোন একজন গাইডের সঙ্গে থাকলে এই ব্যাপারগুলো মিস হবেনা। যদি গাইডেড ট্যুর নিতে না চান তাহলেও ১৬ ইউরো দিয়ে টিকেট করতে পারেন ভ্যাটিকান মিউজিয়ামের গেট থেকে, সেক্ষেত্রে গাইডেড ট্যুরে যেসব যায়গায় নিয়ে যেত সেই যায়গাগুলোতে যেতে পারবেন তবে যেতে হবে নিজে নিজে এবং লাইনেও দাড়াতে হবে। আর যদি একদমই এই-বাবদ খরচ করতে না চান তাহলেও ব্যবস্থা আছে। সেইন্ট পিটার্স স্কয়ার এবং সেইন্ট পিটার্স বাজিলিকা তে প্রবেশ করতে পারবেন বিনামূল্যে। অপশন যেটাই নির্বাচন করেন না কেন সময়টা হওয়া উচিত দুপুর ২টা থেকে ৩টা। এর কারণ দুপুরে চাপ তেমন একটা থাকেনা বললেই চলে, তাই সকালে যেই গাইডেড ট্যুর ৫৫ ইউরো দুপুরে সেটাকে দরদাম করে ৩০ ইউরোতে নামিয়ে আনা সম্ভব, আর বাকি ২টা অপশনের ক্ষেত্রে ঐ টাইমে ভিড় কম থাকায় লাইনে দাঁড়ানোর ঝামেলা নেই।

সেইণ্ট পিটার্স বাজলিকা এর সামনে সেইণ্ট পিটার্স স্কয়ারে আমরা দুজন
সেইণ্ট পিটার্স বাজলিকা এর সামনে সেইণ্ট পিটার্স স্কয়ারে আমরা দুজন

ভ্যাটিকান থেকে বের হয়ে পথে দেখলাম একজন বাঙ্গালী খাবারের দোকানের লিফলেট বিতরণ করছে। রাইস জাতীয় খাবারের ছবি আছে মনে হল একনজর দেখে, তাই চেয়ে নিলাম একটা। হাতে নিয়ে দেখি বিরিয়ানি, খাবারটা আমার অত্যন্ত প্রিয়, হাসনাইন কে জিজ্ঞেস করতে সে তো দুই পায়ে রাজী। খুঁজে বের করে দেখি বাঙ্গালী রেস্টুরেন্ট। ওনাদের রিকমেন্ডেশন অনুযায়ী বীফ বিরিয়ানি দিয়ে বেশ আয়েশ করে দুপুরের খাবার খেলাম।

ওখান থেকে হোস্টেলে ফিরলাম বিকাল ৫টায়। প্ল্যান ছিল সাড়ে ছটা নাগাদ আবার বের হব। হাসনাইন রুমে যেয়েই ঘুম, আমি এটার সঙ্গে অভ্যস্ত, ও ৫ মিনিটের বিরতি পেলেও ৩০ সেকেন্ডের মাথায় নাক ডাকা শুরু করে, আবার ৫ মিনিট পরে ডাক দিলে সঙ্গে সঙ্গে উঠে রেডি হয়ে যায়। ভাবলাম এই সুযোগে আমি একটু ফেসবুকিং করে নেই। ট্যাব নিয়ে শুয়ে পরলাম, আর এই শোয়াটাই কাল হল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও জানিনা। ঘুম ভাঙল রাত সাড়ে দশটায়। টয়লেট থেকে ঘুরে এসে আবারো ঘুম একবারে পরদিন সকাল পর্যন্ত।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে গেলাম চিরকো মাসসিমো ট্রেন স্টেশনে। কাউচ সার্ফিং এ একটা ইভেন্ট দেখেছিলাম ফ্রি ওয়াকিং ট্যুর, মূলত সেই ইভেন্টটাতে অংশগ্রহণ করার জন্যেই চিরকো মাসসিমোতে যাওয়া। পরবর্তী সাড়ে তিন ঘণ্টা হাটতে হবে বিধায় নাস্তাটা হাল্কা করার জন্য শুধু স্যান্ডুইচ আর এস্প্রেসো কফি দিয়ে শেষ করলাম। নাস্তা শেষ করে যখন ইভেন্টের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলাম ততক্ষণে ৪/৫ জন পৌঁছে গেছে। যেয়ে পরিচিত হলাম আমাদের গাইড লাউরা, জার্মানির ইলিয়োনা, কলাম্বিয়ার রিকার্ডো এবং আর দুজনের সঙ্গে। দেখতে দেখতে আমরা ১৭ জনের একটা দল হয়ে আমাদের ট্যুর শুরু করলাম।

প্যালাটিনো এর ওপর নির্মিত দমুস আগুস্তি।
প্যালাটিনো এর ওপর নির্মিত দমুস আগুস্তি।

আমাদের ট্যুরটা শুরু হল রোমের জন্ম নিয়ে এক পৌরাণিক গল্প দিয়ে। জনশ্রুত ভাই রেমুস কে হত্যা করে রোমুলুস দলবল নিয়ে প্যালাটিনো বা প্যালাটিন হিলে প্রাসাদ নির্মাণ করার মাধ্যমে রোমের গোড়াপত্তন করে। কিন্তু তারা বর্বর ও অত্যন্ত নোংরা হওয়ায় কেউ তাদের কাছে মেয়ে বিয়ে দিত না। তাই তারা একবার চক্রান্ত করে আশেপাশের সকল গ্রামের সবাইকে সপরিবারে দাওয়াত দেয় পর্যাপ্ত মাংস ও মদিরার লোভ দেখিয়ে। রাতে যখন দাওয়াত প্রাপ্ত পুরুষেরা মদিরার নেশায় বুঁদ তখন রোমানরা সবার মেয়েকে অপহরণ করে। পরদিন সকালে মদিরার নেশা কাটার পরে যখন যুদ্ধ বাধার উপক্রম তখন মেয়েরা রোমানদের সঙ্গেই থেকে যাওয়ার সম্মতি দেয় এবং এভাবেই বিকাশ পায় রোমান সভ্যতা। এই প্যালাটিনোর পাশেই চিরকো মাসসিমো যেটা একটি রথ প্রতিযোগিতার ময়দান ছিল।

ফ্রি ওয়াকিং ট্যুরে তোলা আমাদের গ্রপ ছবি
ফ্রি ওয়াকিং ট্যুরে তোলা আমাদের গ্রপ ছবি

এরপরের গন্তব্য রজেতো কমুনালে বা গোলাপ বাগান। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আনা প্রায় ১১০০ প্রজাতির গোলাপ গাছ আছে এখানে। বর্তমানে এটাকে রোমের অন্যতম রোমান্টিক যায়গা বলা হলেও এর পূর্ব ইতিহাস সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রায় তিনশো বছর ইহুদীদের অস্পৃশ্য মনে করে শুধু এই যায়গাতেই ইহুদীদের কবর দেওয়ার অনুমতি ছিল, যেই কবরগুলোকে পরবর্তীতে সাধারণ কবরস্থানে স্থানান্তর করে সেখানে গোলাপ বাগান করা হয়। এরপরের গন্তব্য কোল্লে আভেন্তিনো বা অ্যাভেন্টাইন হিল। জনশ্রুত জনৈক রোমান সম্রাট (নাম ভুলে গেছি) তার প্রাসাদ বর্ধনের জন্যে প্যালাটিনোতে বসবাসরত রোমের সম্পদশালী ব্যাক্তীগনকে তাদের বাসস্থান ত্যাগ করতে বলেন। তখন সম্পদশালী ব্যাক্তীগন কোল্লে আভেন্তিনোতে তাদের নতুন বাসস্থান নির্মাণ করেন। একটি বিতর্কিত প্রবাদ, ইতালির প্রথম কমলা চাষ এই কোল্লে আভেন্তিনোতেই করা হয়েছে।

কোল্লে আভেন্তিনো বা অ্যাভেন্টাইন হিল
কোল্লে আভেন্তিনো বা অ্যাভেন্টাইন হিল

সেখান থেকে গেলাম সবথেকে প্রাচীন যিশু খ্রিস্টের ছবি দেখতে বাজিলিকা দি সান্তা সাবিনা আল্লাভেন্তিনোতে। সাবিনা, একজন বিধবা রোমান গৃহকর্তী। তাকে রোমান সম্রাট ভেস্পাসিয়ান হত্যা করার আদেশ দেন কারণ তিনি খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাকে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করেছিলো তারই ভৃত্য সেরাপিয়া। এই সেরাপিয়া যিশু খ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্যের একটি ছবি বানিয়ে ছিলেন এবং বিতর্কিত প্রবাদ, ক্রুসিফিকেশনের সেটাই প্রথম ছবি। পরবর্তীতে সাবিনার বাসভবনের ওপর একটি গির্জা নির্মাণ করা হয় বাজিলিকা দি সান্তা সাবিনা আল্লাভেন্তিনো যেটা এখন পর্যন্ত টিকে থাকা সবচেয়ে প্রাচীন রোমান বাজিলিকা।

দরজাতে খোদাই করা ক্রসিফিকেশনের প্রথম ছবি
দরজাতে খোদাই করা ক্রসিফিকেশনের প্রথম ছবি

এখনো অস্তিত্ব আছে ক্রসেডারদের তেমনি একটি সংগঠনের প্রধান কার্যালয় আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল। মজার ব্যাপার এই ক্রুসেডারেরাও সার্বভৌম। এই ক্রসেডার সংগঠন শুরু থেকেই অন্য ক্রুসেডারের মত যুদ্ধ না করে বরং গরীব ও অসুস্থদেরকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছে যেটা এখনো চলমান। এরপরে আগালাম ফরো বোয়ারিউম এর দিকে যেটা প্রাচীন রোমের গবাদি পশুর বাজার ছিল। তেম্পিও দি এরকোলে ভিঞ্চিতরে বা হারকিউলিসের মন্দির এই বাজারটার পাশেই অবস্থিত। প্রবাদমতে হারকিউলিসের দশম চ্যালেঞ্জ ছিল ইউরেস্থিয়াসের জন্যে দানব জেরিয়ানের গবাদিপশু উদ্ধার করে নিয়ে আসতে হবে। চ্যালেঞ্জ শেষ করে এসে হারকিউলিস যে যায়গায় বসে বিশ্রাম নিয়েছিলো সেখানেই মন্দিরটা বানানো হয়েছে।

তেম্পিও দি এরকোলে ভিঞ্চিতরে
তেম্পিও দি এরকোলে ভিঞ্চিতরে

এরপরে দেখলাম মিথ্যাবাদী গৃহবধূ সনাক্ত করন যন্ত্র। বিশাল একটি গোলাকার মাথা যার মুখ বড়সড় হা করা। প্রাচীনকালে কন গৃহবধূ মিথ্যা বলছে এমন সন্দেহ হলে তার স্বামী তাকে নিয়ে এই মন্দিরে আসতো। তখন স্ত্রীকে সেই মুখের মধ্যে হাত দিয়ে যে প্রশ্ন করা হত তার উত্তর দিতে হত। যদি উত্তর মিথ্যা হত তাহলে মুখটি সেই হাত খেয়ে ফেলত। তবে জনৈক রমণীর ফাঁদে পা দিয়ে বোকা হয়ে রাগে/ক্ষোভে যন্ত্রটি বেশ কয়েকশো বছর হয়েছে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

মিথ্যাবাদী গৃহবধূ সনাক্ত করন যন্ত্র
মিথ্যাবাদী গৃহবধূ সনাক্ত করন যন্ত্র

এরপরে তেএত্রো দি মারচেল্লো বা থিয়েটার অফ মারসেল্লো, দুই হাজার বছরেরও বেশী বয়সের একটি মুক্ত মঞ্চ। নানা হাত ঘুরে ১৩শ শতক থেকে এটা সাভেল্লি পরিবারের সম্পত্তি যেখানে এখনো তাদের বংশধরেরা বসবাস করে। সেখান থেকে একটু আগালেই জুইশ ডিসট্রিক্ট শুরু। বেশ কয়েকশো বছর যেহেতু ইহুদীদেরকে অস্পৃশ্য মনে করা হত তাই তাদের শুধু রোমের এই এলাকাতেই থাকার অনুমতি ছিল, যেখানে তাদের কাটাতে হয়েছে অত্যন্ত মানবেতর জীবন। এই জুইশ ডিসট্রিক্টেই রয়েছে ফন্তানে দেল্লে তারতারুগে বা দা টারটেল ফাউন্টেন। এটা বানানোর সত্যি ইতিহাসটা আমাকে ততটা টানেনি যতটা টেনেছে এটা নিয়ে প্রচলিত রূপকথায়। বলা হয় প্রখ্যাত মাত্তেই পরিবারের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় এক ইহুদী যুবকের। কিন্তু বাগদানের আগেই কোন একটা কারণে মাত্তেই কর্তা বিয়েতে অমত জানান। তখন যুবক হবু শ্বশুর কে খুশী করার জন্যে একরাতের মধ্যে শ্বশুরের বাসার সামনে ফাউন্টেনটা বসানোর ব্যবস্থা করে। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফাউন্টেনটি দেখতে পেয়ে খুশী হয়ে মাত্তেই কর্তা বিয়েতে মত দেন। এবং এই গল্প দিয়েই শেষ হয় আমাদের সাড়ে তিন ঘণ্টার ওয়াকিং ট্রিপ। যদিও ট্রিপটা ফ্রি তবে গাইড ডোনেশন গ্রহণ করে, অসম্ভব ভালো গাইডিং করায় আমরা সবাই যারযার মত করে ডোনেট করে বিদায় নিলাম।

ফন্তানে দেল্লে তারতারুগে
ফন্তানে দেল্লে তারতারুগে

বিদায় নেওয়ার সময়ই আমাদের গ্রুপের ইতালিয়ান ছেলেটার কাছে জানতে পারলাম কাছেই রয়েছে বেশ সুস্বাদু ও বিখ্যাত এক ইতালিয়ান পিৎজারীয়া। আমরা কয়েকজন চললাম ওর সঙ্গে লাঞ্চ করার জন্যে। যেয়ে দেখি বাইরে থেকেই লাইন শুরু হয়েছে এবং আশেপাশের মানুষ আসছে স্রোতের মত, বুঝলাম ছেলেটার কথা মিথ্যে না। তিন রকমের পিৎজা, ব্রেড এবং একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার নিলো হাসনাইন আমাদের দুজনের জন্যে। এরপরে সবাই মিলে এগিয়ে একটা চার্চের সামনে বসে দুপুরের খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়া শেষে ওখানে বসেই আড্ডা মারলাম কিছুক্ষণ। এরপরে একে একে বিদায় নিতে শুরু করলো সবাই। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকা আমরা দুজন, স্পেনের রোজ, জার্মানির ইলিয়না আর পোল্যান্ডের ২টা মেয়ে যেদিকে যাচ্ছি তার উলটো দিকে ইতালিয়ান ছেলেটার বাসা হওয়ায় সেও বিদায় নিলো। এদের মধ্যে রোজের সঙ্গে আমার পরিচয় অ্যাভেন্টাইন হিলে যাওয়ার সময়, সূত্রপাত ভ্যাটিকান নিয়ে, আগের দিনই ঘুরে আসায় ওর প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে পারছিলাম সহজেই। এরপরে বাকি ট্যুরে একসঙ্গেই থাকায় ওর সঙ্গে বন্ধুত্বটা অন্যদের তুলনায় ভালো হয়েছিলো।

আমাদের সবারই গন্তব্য ছিল ক্যাম্পো দে ফিওরি, তাই একসঙ্গেই পা বাড়ালাম। “সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে” এই চিরন্তন সত্য কথাটা প্রথম বলেছিলেন জিওরদানো ব্রুনো। আর একারণে তাকে চার্চের রোষানলে পরতে হয়েছিল কারণ চার্চের মতবাদ ছিল সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে। সেই সময় দেশের শাসনভার চার্চের হাতে থাকায় তাদের ক্ষমতাও ছিল অনেক। তাই চার্চের মতবাদ অস্বীকার করার অভিযোগে এই ক্যাম্পো দে ফিওরিতেই জিওরদানো ব্রুনোকে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৬০০ সালে পুড়িয়ে মারা হয়। সেখানে এখন তার একটি মূর্তি রয়েছে।

জিওরদানো ব্রুনো এর মূর্তী
জিওরদানো ব্রুনো এর মূর্তী

ব্রুনোকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পা বাড়ালাম পিয়াতসা নাভোনা এর দিকে। সেখানে কিছু সময় কাটানোর পরে ইলিয়না এবং পোল্যান্ডের দুজন বিদায় নিলো। এরপরে আমরা তিনজন পা বাড়ালাম প্যান্থিওনের দিকে। তবে ভেতরে ঢোকার আগে বেশ আয়েশ করে একটা করে জিলাটো খেয়ে নিলাম সবাই। এরপরে ভেতরে ঢুকে সবথেকে সুন্দর লেগেছিল বিশাল ডোমটা দেখে যেটার ঠিক মাঝখান দিয়ে খোলা আকাশ দেখা যায়। তবে পরে অবাক হয়েছি জানতে পেরে যে শুধু সৌন্দর্যই নয় বৈশিষ্ঠের দিক দিয়েও ডোমটা অনন্য। তৈরির প্রায় ২ হাজার বছর পরেও প্যান্থিওনের ডোম এখনও বিশ্বের বৃহত্তম আনরিইনফোর্সড কংক্রিটের ডোম। সেখান থেকে বের হয়ে আমাদের পথ আলাদা ছিল, তাই রোজ আমাদের দুজনের থেকে জার্মানিতে আসার দাওয়াত নিয়ে এবং আমাদের দুজনকে স্পেনের ভ্যালেন্সিয়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে বিদায় নিলো।

কোলোসসেও
কোলোসসেও

আমাদের এরপরের গন্তব্য ছিল কোলোসসেও বা কলিসিয়াম। এটি রোম শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এখন পর্যন্ত তৈরি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অ্যাম্পিথিয়েটার যেটি মূলত উপবৃত্তাকার। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন ৬টা বেজে ১০। আগের দিন ইন্টারনেটে দেখেছিলাম ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে তাই হাতে ঢোকার মত সময় আছে। কিন্তু যেয়ে দেখলাম ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে ঠিক তবে ভেতরে ঢোকার শেষ সময় ৬টা। তাই কি আর করার বাইরে থেকেই এর সৌন্দর্য উপভোগ করে আগাতে থাকলাম পিয়াতছা ভেনেতছিয়া এর দিকে। ফরো দি নের্ভা হয়ে পিয়াতছা ভেনেতছিয়া পৌঁছলাম। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে বাস এবং ট্রেনে করে পৌঁছলাম ভিত্তরিও ইমানুয়েলে। এখানে শপিং সেন্টার খোলা পেলামনা, তবে বাংলাদেশী এক রেস্টুরেন্ট খোলা পেলাম। সেখানে বীফ বিরিয়ানি, প্রন বিরিয়ানি, বীফ ভুনা দিয়ে একদম দেশী কায়দায় গলা পর্যন্ত গিলে রাতের খাওয়া শেষ করলাম। হাসনাইন অবশ্য এরপরে রসমালাইও খেয়েছিল।

পিয়াতছা ভেনেতছিয়া
পিয়াতছা ভেনেতছিয়া

সেখানে থেকে সোজা হোস্টেলে, আর এর মধ্যেই শেষ হল আমাদের রোম সফর। অসম্ভব ভালো কিছু মূহুর্ত আজীবনের জন্যে সঙ্গী হল এবং সেই সঙ্গে আরও যুক্ত হল ইতিহাসের সাক্ষী নানা দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে পরিচয়।

mm

By Munshi Arif Rashid

জন্ম বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহর ফরিদপুরে, শৈশব-কৈশোর সেখানেই। জন্মেছি সাংবাদিক মুনশী হারুন-অর-রশীদ ও আফরোজা রাশীদ দম্পতির পরিবারে বড় দুই বোন জিতা ও তানিমের পরে। SSC ২০০২ সালে, এরপরে ঢাকা আসা, উদ্দেশ্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনিস্টিটুটে কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে পড়ালেখা। ২০০৬ সালে যখন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হল জ্ঞান কতোটুকু অর্জিত হয়েছে জানিনা তবে অসম্ভব কাছের কিছু বন্ধু অর্জন করতে পেরেছি। কিছুদিন MGH Group এ চাকরী করার পর bracNet এর চট্টগ্রাম অফিস এ যোগদান। এই সময় চট্টগ্রামে থাকা চার বছর আমার জীবনের সোনালি সময়। Southern University তে Electornics & Communication Engineering এ B.Sc করার সময় আজব কিছু ছেলের সঙ্গে পরিচয়। মজা করতে করতে কখন যে ওদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হল বুঝতে পারিনি। B.Sc শেষ করার পরে UITS এ MBA, সেখানেও কিভাবে কিভাবে যেন বেশ কিছু কাছের বন্ধু জুটে গেল। ২০১০ সালের শেষে মাছরাঙা টেলিভিশন থেকে যখন ডাক পেলাম আবারো ঢাকায় ফিরে এলাম। মাছরাঙা টেলিভিশন এর তথ্য প্রযুক্তি বিভাগে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করেছি স্কয়ার গ্রুপের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে। শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি মসৃণ ই ছিল, কিন্তু নিজের মনেই ভয় ছিল শীর্ষ পদে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার মত বিদ্যার কিছুটা ঘাটতি আছে, তাই অনেক কঠিন হলেও ২ বছরের জন্যে সব ছেড়ে জার্মানি আসার সিদ্ধান্ত নেই। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজিতে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছি।

Leave a Reply