পূর্ববর্তী উপপর্বঃ ভেনিস/ভ্যানেৎছিয়া

৭ই সেপ্টেম্বর সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরলাম ৯টায় ফ্লোরেন্স যাবার বাস ধরতে হবে দেখে। এরপরেও হোস্টেল থেকে বের হতে কিছুটা দেড়ি হয়ে গেলো। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা, হোস্টেল থেকে পিয়াতছালে রোমা যাবার বাস আসলো ২০ মিনিট দেরি করে। পিয়াতছালে রোমায় নেমে ত্রঙ্কেত্তো পিপলস মুভার খুঁজে বের করতে আরও কিছু সময় চলে গেলো। এরপরে যখন ওপরে উঠলাম চোখের সামনে পিপলস মুভারের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, দৌড়ে যেয়েও শেষ রক্ষা হলনা। পরের মুভারে উঠে যখন ওইপাশে পৌঁছলাম তখন ৯টা ৯ মিনিট। জার্মানি হলে পরের বাসের টিকেট খুঁজতাম। কিন্তু বিগত কিছু দিনের ইতালিয়ের অভিজ্ঞতায় খুব ক্ষীণ একটা আশা নিয়ে মুভার থেকে বের হলাম। বের হয়ে দেখি নিচে মেগা বাস দাঁড়িয়ে আছে। আবারো দৌড়, আমরা যখন বাসের কাছে বাস তখন দুই-ফিট পিছেয়ে গেছে পার্কিং থেকে বের হওয়ার জন্যে। অবশেষে চালক মহাশয় কে অনুরোধ করে শেষ রক্ষা হল।

বাসে উঠে কিছুক্ষণ রাস্তার পাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। কিন্তু দৃশ্যপট একই রকম থাকায় ছোটোখাটো একটা ঘুম দিয়ে দিলাম। আধাঘণ্টা পরে ঘুম যখন ভাঙল বাস তখন পাহাড়ের ওপরে। পাহাড় কেটে তৈরি করা রাস্তা আর পাশে অনেক অনেক নিচে ছোটো ছোটো শহর, সে এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। পাহাড়ের চড়াই উৎরাই পার হয়ে বাস চলল বেশ কিছুক্ষণ। এরপরে বাকিটা পথ সমতল যায়গা দিয়ে বাস চলার পরে দুপুর ১ টায় আমরা পৌঁছলাম ফ্লোরেন্সে, নাইটিঙ্গেলের ফ্লোরেন্সে।

ট্রেন স্টেশনের লেফট লাগেজ সেকশনে আমাদের লাগেজ রেখে রওয়না হলাম পুরনো শহরের উদ্দেশ্যে। ইচ্ছে করেই একটু ঘুর পথে গেলাম পোন্তে ভেক্কিও বা ওল্ড ব্রিজ দিয়ে আর্নো নদী পার হবার জন্যে। ইতোমধ্যে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, তাই নদী পার হয়ে খাবারের দোকান খুঁজতে শুরু করলাম। পেটুক হাসনাইন আগের দিন থেকে শুরু করেছে সে ঝাল কিছু খাবে। সামনে পেয়ে গেলাম একটা চাইনিজ খাবারের দোকান। ঢুকে চিকেন ফ্রাইড রাইস আর মাসালা বিফের অর্ডার করলাম আর কাউন্টার থেকে চেয়ে নিলাম সাম্বাল ওলেক সস। বেশ জম্পেশ একটা খাওয়া হল।

পুরোনো শহর থেকে নতুন শহর
পুরোনো শহর থেকে নতুন শহর

ওখান থেকে বের হয়ে পুরনো শহরের মধ্যদিয়ে হাটতে হাটতে একটা পার্কে যেয়ে বসলাম একটু বিশ্রাম নেবার জন্য। পাশেই দেখি একটা আনার গাছ, বেশ অনেকগুলো ধরেও আছে গাছে। তবে পাকা গুলো সব একদম ওপরে, হাতের কাছে মোটামটি রঙ এসেছে এমন একটা দেখে পেরে ফেললাম। এরপর ভাঙ্গার জন্য হাসনাইনকে দেওয়া হল, ভেঙ্গে একটা মুখে দিয়েই ওর ব্যাপক একপ্রেশন। সাহস করে আমিও একটা দিলাম, ওরে বাবারে বাবা, বাঘা টকও ফেল।

এরপরে স্কাউট ম্যাপকে জিজ্ঞেস করতে জানালো কাছাকাছি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে পিয়াতছা দি সান্তা মারিয়া নভেল্লা আছে। পথ দেখাতে বলে হাটা শুরু করলাম, পৌঁছে দিলো দশ মিনিটের মধ্যেই। এটা মূলত বাজিলিকা(চার্চ) দি সান্তা মারিয়া নভেল্লা এর সামনে একটা বড়সড় মাঠের মত। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও বসার সুন্দর ব্যবস্থা করা। সামনে দুই তরুণ অসম্ভব সুন্দর গান গাইছে। গানগুলো ইংরেজিতে গাওয়ায় ভালোমতোই উপভোগ করা যাচ্ছিল, তাই বসে পরলাম আমরা দুজনও। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে পা বাড়ালাম বাজিলিকা দি সান লরেঞ্জো হয়ে ক্যাতেদ্রালে দি সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে বা দুয়োমো দি ফিরেন্তছে এর উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য বাজিলিকা মানে গির্জা আর দুয়োমো হচ্ছে কোন একটি শহরের প্রধান গির্জা।

পিয়াতছা দি সান্তা মারিয়া নভেল্লা
পিয়াতছা দি সান্তা মারিয়া নভেল্লা

দুয়োমোর সামনে যখন পৌঁছলাম সত্যিকার অর্থেই বাকরুদ্ধ হয়ে পরেছিলাম। কি বিশাল! কি বিশাল!! যথার্থই এটা ইতালিয়ের অন্যতম বড় একটি গির্জা। বিগত পাঁচ মাসে বেশ কিছু গির্জা দেখা হয়েছে তবে এত বড় গির্জা এর আগে একটাও দেখিনি। এর বিশালত্বের সামনে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। মধ্যযুগীয় এইসব স্থাপনা দেখে আমি সবসময়ই অবাক হই, আর অবাক হবার বড় একটা কারণ, যখনও আধুনিক নির্মাণ সামগ্রীর আবির্ভাব হয়নি তখন এই বিশাল বিশাল স্থাপনা বানাত কি করে?

ক্যাতেদ্রালে দি সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে বা দুয়োমো দি ফিরেন্তছে
ক্যাতেদ্রালে দি সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে বা দুয়োমো দি ফিরেন্তছে

দুয়োমো দি ফিরেন্তছে এর বিশেষ আকর্ষণ এর বাইরের দেওয়ালেও অসম্ভব সুন্দর শিল্পকর্ম ও ভাস্কর্য। এছাড়া এর আর একটি অন্যতম আকর্ষণ এর ডোম বা গম্বুজ। লাল রঙের বিশাল ডোমটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেক দূর থেকেও। এই ডোমটা এখন পর্যন্ত ইট দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডোম, এমনকি অনেকদিন পর্যন্ত যেকোনো কিছু দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ডোম ছিল। বিস্ময়ের ঘোর লাগা নিয়েই পা বাড়ালাম পিয়াতছা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতার দিকে।

ক্যাতেদ্রালে দি সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে বা দুয়োমো দি ফিরেন্তছে
ক্যাতেদ্রালে দি সান্তা মারিয়া দেল ফিওরে বা দুয়োমো দি ফিরেন্তছে

কোন একটা ট্রাভেল ব্লগে দেখেছিলাম বছরের ঐ সময়টায় প্রতি সন্ধ্যায় পিয়াতছা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতায় জ্যাজ শো হয়, তাই ওখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য জ্যাজ শো উপভোগ করা। আমরা যখন পৌঁছলাম তখনও জ্যাজ শো শুরু হয়নি। অবশ্য খুব বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, অল্প একটু পরেই শুরু হয়ে গেলো প্রোগ্রাম। তবে মজার ব্যাপার ভেনেসিরে মতো ফ্লোরেন্সেও আমরা লাকি। কারণ ৭ই সেপ্টেম্বর ফ্লোরেন্সে উৎযাপন করা হয় বছরের অন্যতম বড় একটি উৎসব ফেস্তা দেল্লা রিফিকোলোনা বা কাগজের লণ্ঠন উৎসব। উৎসবটি ১২শো শতক থেকে উৎযাপন করা হচ্ছে। মেরি এর জন্মবার্ষিকী (৮ই সেপ্টেম্বর) উৎযাপন করার জন্যে শহরের বাইরের বাসিন্দারা ৭ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার পরপরই রওয়না হতো বাজিলিকা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতার উদ্দেশ্যে। যেহেতু সেই সময় সড়ক-বাতি বলতে কিছু ছিলোনা তাই তারা নিজেদের সঙ্গে কাগজের লণ্ঠন বহন করত। আর এভাবেই কাগজের লণ্ঠন নিয়ে পিয়াতছা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতায় যাত্রা একটা উৎসবে পরিণত হয়।

পিয়াতছা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতা

পিয়াতছা দেল্লা সান্তিছছিমা নুনছিয়াতা

আমাদের উৎসবটি সম্পর্কে আগে থেকে জানা ছিলোনা। হঠাৎ করেই দেখি একঝাক বাচ্চাকাচ্চা আর বেশ কিছু মাস্কট। সবাই হাতে কাগজের লণ্ঠন নিয়ে মার্চ করে পিয়াতছাতে প্রবেশ করলো। ওরা কিছুক্ষণ পিয়াতছাতেই নেচে গেয়ে আবার মার্চ করে চলে গেলো। একটু পরে দেখে ফ্লোরেন্টিনোরা সব দলে দলে হাতে কাগজের লণ্ঠন নিয়ে পিয়াতছাতে আসছে। তখন বুঝতে পারলাম এটা বিশেষ কোন ব্যাপার, পরে গুগোল সার্চ করে বিস্তারিত জানতে পারি। তবে বেশীক্ষণ উপভোগ করতে পারিনি। আমাদের ব্যাগ নেওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় ১০টার দিকে চলে গেলাম স্টেশনে। ব্যাগ বুঝে নিয়ে চলে গেলাম ম্যাকডোনাল্ডসে রাতের খাবার খাওয়ার জন্যে। খেয়েদেয়ে আড্ডা দিয়ে যখন ম্যাক থেকে বের হলাম তখন প্রায় রাত ১২টা।

ফেস্তা দেল্লা রিফিকোলোনাতে আসা শীশুরা মাস্কটের সঙ্গে নাচায় মগ্ন
ফেস্তা দেল্লা রিফিকোলোনাতে আসা শীশুরা মাস্কটের সঙ্গে নাচায় মগ্ন

রোমের বাস রাত ৩ টায় তাই এই সময়ে একটু ঝিমানোর জন্য স্টেশনের বেঞ্চেই বসে পরলাম। ঝিমাতে যেয়ে ঘুমিয়েই পরেছিলাম, রাত ২টা ৩০ মিনিটে অ্যালার্ম বাজায় ঘুম ভাঙল। স্টেশন থেকে বের হতে গিয়ে দেখি গেইট বন্ধ। গেইট বেশি উঁচু না, চাইলে টপকে যাওয়া যায়, কিন্তু সভ্য দেশে সেটা তো আর করা যায় না। পুরো মাথায় হাত, না বের হতে পারলে বাস ধরবো কিভাবে? এমন সময় পেছনে দেখলাম প্লাটফর্মে চলাচল উপযোগী ছোট্ট গাড়ীতে করে তিন পুলিশ আসছে। কিছুটা আশাবাদী হলাম, কিন্তু আমাদের কিছু আগে থাকতে ওরা ডানে মোড় নিয়ে চলে গেলো। তবে কয়েক সেকেন্ড পরেই ফিরে দূর থেকেই বলল গেট টপকে চলে যাওয়ার জন্যে, এটা বলেই আবার নিজেদের কাজে চলে গেলো। আবারো মনে হল জার্মানি বা ফ্রান্স এর মত নয় ইতালি বরং অনেকটা বাংলাদেশের মতই। বাস চলে আসলো সময় মতই এবং রোমের উদ্দেশ্যে যাত্রার মধ্যে দিয়ে আমাদের স্বল্প দৈর্ঘ্যের ফ্লোরেন্স অভিযান শেষ হল।

mm

By Munshi Arif Rashid

জন্ম বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহর ফরিদপুরে, শৈশব-কৈশোর সেখানেই। জন্মেছি সাংবাদিক মুনশী হারুন-অর-রশীদ ও আফরোজা রাশীদ দম্পতির পরিবারে বড় দুই বোন জিতা ও তানিমের পরে। SSC ২০০২ সালে, এরপরে ঢাকা আসা, উদ্দেশ্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনিস্টিটুটে কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে পড়ালেখা। ২০০৬ সালে যখন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হল জ্ঞান কতোটুকু অর্জিত হয়েছে জানিনা তবে অসম্ভব কাছের কিছু বন্ধু অর্জন করতে পেরেছি। কিছুদিন MGH Group এ চাকরী করার পর bracNet এর চট্টগ্রাম অফিস এ যোগদান। এই সময় চট্টগ্রামে থাকা চার বছর আমার জীবনের সোনালি সময়। Southern University তে Electornics & Communication Engineering এ B.Sc করার সময় আজব কিছু ছেলের সঙ্গে পরিচয়। মজা করতে করতে কখন যে ওদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হল বুঝতে পারিনি। B.Sc শেষ করার পরে UITS এ MBA, সেখানেও কিভাবে কিভাবে যেন বেশ কিছু কাছের বন্ধু জুটে গেল। ২০১০ সালের শেষে মাছরাঙা টেলিভিশন থেকে যখন ডাক পেলাম আবারো ঢাকায় ফিরে এলাম। মাছরাঙা টেলিভিশন এর তথ্য প্রযুক্তি বিভাগে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করেছি স্কয়ার গ্রুপের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে। শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি মসৃণ ই ছিল, কিন্তু নিজের মনেই ভয় ছিল শীর্ষ পদে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার মত বিদ্যার কিছুটা ঘাটতি আছে, তাই অনেক কঠিন হলেও ২ বছরের জন্যে সব ছেড়ে জার্মানি আসার সিদ্ধান্ত নেই। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজিতে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছি।

One thought on “সাধ ও সাধ্যের ইউরোপ ভ্রমন/ পর্বঃ ইতালি// উপপর্বঃ ফ্লোরেন্স/ফিরেন্তসে”

Leave a Reply