আমি জার্মানী আসি ২০১৩ এর মাঝামাঝি সময়। দেশ তখন সব মিলিয়ে উত্তপ্ত। আবহাওয়া এবং পরিবেশ দুটোই।বিমানের টিকেট কাটার পর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো অফিসের ওইদিকে টং দোকানে বসে এক বন্ধুপ্রতীম বড় ভাইয়ের সাথে চা খাচ্ছিলাম। দুজনে একসাথে যাচ্ছি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে।।আমার দিকে তাকিয়ে উনি হঠাৎ বললেন,‘ভাই, যাচ্ছি তাহলে শেষমেষ।’
সকাল ১১টা নাগাদ ডুসেলডর্ফ বিমানবন্দরে নামার পর ইমিগ্রেশন পার হতেই বাংলা শুনলাম।
‘ভাই, এদিকে আসেন’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অফিস থেকে দুজন বাঙ্গালী স্টুডেন্ট টিউটরকে পাঠিয়েছিল আমাদের রিসিভ করার জন্য।তাদের সাথে দেখি আরো ক’জন বাঙ্গালী স্টুডেন্ট।যাক, অবশেষে নিজের বর্ণ আর ভাষার কাউকে পাওয়া গেল এখানে।অনুভূতি অনেকটা এরকম।বিমানবন্দর থেকে সোজা তারা আমাদের নিয়ে গেল ডুসেলডর্ফ বিমানবন্দর ট্রেন স্টেশনে। চোখের সামনে দিয়ে দুই তিনটা সাদা ট্রেন সাঁই সাঁই করে চলে গেল। ভাবলাম ট্রেনে উঠার পর কত স্পীডে যায় সেটা দেখব। ওহ আচ্ছা! এর মাঝে ট্রেনের টিকেট কাটতে হয়েছিল।সাথে থাকা সহযাত্রী ভাই কাচুমাচু করে দুজনের জন্য ৩০ ইউরো দিয়ে দুটো টিকিট কাটলেন।১ ইউরো কে ১০০ দিয়ে গুণ দেয়ার ব্যপারটা অলরেডি তখন শুরু হয়ে গেছে দুজনের মধ্যে।প্লাটফর্মে নিজেদের মাঝে কথা বলার সময় খেয়াল করলাম পরিচিত একটা গন্ধ নাকে আসছে। পাশে ঘুরে দেখি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দুই-তিনজন বিদেশীনি ধুমায়ে সিগারেট খাচ্ছে।সাথে আনা দেশী ফ্লেভার দিয়ে বিদেশে প্রথমবারের মত কাজটা সেরে ফেললাম।ট্রেন আসল।রিসিভ করতে আসা এক বাঙ্গালী ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আমরা কি এই ট্রেনে যাব?’ উনি মনে হয় বুঝতে পেরেছিলেন কেন একথা জিজ্ঞেস করেছি। বললেন, ‘ভাই সাদা ট্রেনগুলো ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস।সংক্ষেপে আইসিই।ওইগুলাতে আমাদের সেমিস্টার টিকেট দিয়ে চড়ার পারমিশন নাই।আমরা এই লাল রঙের রিজিওনাল এক্সপ্রেস টাইপ ট্রেনগুলোতে চড়তে পারব।’ কিছুটা আশাহত হলেও ট্রেনে উঠার পর অবাক হলাম। এই যদি হয় রিজিওনাল ট্রেন তাহলে আইসিই না জানি কি হবে!খুব পরিপাটী এবং ছিমছাম।ভীড় নেই, গ্যান্জাম নেই। স্পীডও ভালই মনে হয়েছিল এটলিস্ট ফার্স্ট ইমপ্রেশনে।ট্রেন ছাড়ল।শহর থেকে গ্রামের দিকে যেতে থাকলাম। প্রায় দেড় ঘন্টা পর রাইনের ধারের ছোট্ট শহর এমেরিশে পৌঁছালাম।অবশ্য শহর না বলে গ্রাম বলা ভাল।আমরা দুজন বেশ ভাগ্যবান ছিলাম কারণ আমাদের দেশ থেকেই এখানে এসে থাকার বন্দোবস্ত করা ছিল।এখন বুঝি সেই সময় এটা কত বড় হেল্প ছিল।
ট্রেন স্টেশন থেকে নেমে বাস স্টেশনে পৌঁছার পর নজরে পড়ল আরেকটা ব্যপার । সানগ্লাস পরা মহিলা বাস ড্রাইভার।ভাবলাম কি রে ভাই সব জায়গায় কি শুধু মেয়ে আর মেয়ে নাকি!(এখানে একটা মজার তথ্য দেই।জার্মানরা কিন্তু নিজের দেশকে আমাদের মত মাতৃভূমি বলেনা,বলে ‘ফাটারলান্ড’ বা পিতৃভুমি।দেশে নারী আধিক্য থাকলে কি হবে দেশটাকে ঠিকই পুরুষবাচক বানায়ে দিছে। জার্মানী তাদের বাপের দেশ !লিটারালি ই।) এসব যখন ভাবছি তখন পাশ থেকে খটমট করে পুরুষকন্ঠে কে যেন কি বলল। ফিরে দেখি আমার সহযাত্রী ভাই তার লাগেজ এক জার্মান ভদ্রলোকের পায়ের উপর ফেলে দিছে। আমাদের সাথে থাকা বাঙালীরাও ত্বড়িত গতিতে কিছু একটা বলে সামলে নিল।যাহোক বড় বড় লাগেজ, ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাসায় পৌঁছানোর পর দুইটা অনুভূতি হল।পুরো শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত।একইসাথে ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছে।বাঙালী সেই ভাইয়েরা তাদের বাসায় নিয়ে গেলেন দুপুরের খাবার খাওয়াতে।ভদ্রতা করে কিছু বলার মত অবস্থা নাই তখন আমাদের।ভাবছিলাম ছেলে মানুষ।তাও বিদেশে থাকে।মশলাপাতিও তো আর দেশী না। কি-না কি রান্না করবে। কিন্ত না! আমি জানিনা তখন প্রচন্ড ক্ষুধার কারণে কি না তবে ওনাদের রান্না তখন অমৃতের মত লেগেছিল। যদিও পরে জেনেছি ওই বাসার সবাই-ই বেশ ভাল রান্না পারে।বুঝলাম নাহ, বিদেশের ছেলেপেলেরাও রান্না পারে।শুধু পারে যে তা-না।ভালই পারে।বাসায় ফিরে এসে ফ্রেশ হব।গোসল করা দরকার।নতুন দেশের সঙ্গী বড় ভাই আগে গেলেন ।কিছুক্ষন পর কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ‘ভাই আমার মনে হয় নেক্সট টাইম দেশে যাবার আগে আর গোসল করা হবেনা।’ বেচারা তখনও খেয়াল করে নাই যে বাথরুমে হট শাওয়ারের ব্যবস্থা আছে। পরিস্থিতি দেখে সাবধান হয়ে শাওয়ার নিতে গিয়ে বেচারার জন্য খারাপ লাগল। নরমাল পানি আসলেই প্রচন্ড ঠান্ডা।তবে হট শাওয়ারের ব্যবস্থা আছে।এরপরের ৪-৫ ঘন্টা কি হয়েছে আমার জানা নাই। শুধু মনে আছে ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্তিতে কেউই আর চোখের পাতা খোলা রাখতে পারছিলাম না। ঘুম ভাঙল আবার কো্ন একটা পরিচিত কন্ঠ শুনে।
‘ভাই, রাত হয়ে গেছে। উঠেন।খাবেন না?’ দেখি সেই বাঙালী ভাইয়েরা আমাদের বাসায় এসেছেন। আমাদেরকে রাতের খাবার খাওয়াতে নিয়ে যাবার জন্য। মে মাস দেখে ভেবেছিলাম দেশের মত না হলেও এটলিস্ট গরম কিছুটা হলেও পড়বে। ডিনার করে নিজেদের বাসায় ফেরার পথে বুঝলাম কতবড় ভুল করেছি। পরেছিলাম এমনিতেই পাতলা টি শার্ট। তার উপর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট । দুপুরে ওই ভাইয়ের মতই কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরলাম কোনরকম।এর মাঝে একটা ব্যপার খেয়াল করলাম অবশ্য।চারিদিক এত প্রচন্ড শুনশান। রাস্তায় ল্যাম্প পোস্টের আলো আর মৃদু বাতাসে পাতার ঝিরিঝিরি শব্দ। আর এত গোছানো সবকিছু। খালি ভাবছিলাম এ কোথায় এলাম।আবার মনে হচ্ছি্ল আমাদের দেশের সবচেয়ে অভিজাত এলাকাও কি এতটা নিরিবিলি আর গোছানো কি না।
পরেরদিন বিকেলে নিজেরা চিন্তা করলাম বাজারে যাব। নিজেদের অন্নের ব্যবস্থা এবার নিজেদের করার পালা। সুপারমার্কেটে গেলাম।সেখানে গিয়ে কি হল সে এক ইতিহাস।শুধু সেটা নিয়েই পরবর্তীতে কিছু লিখব আশা রাখি। তবে এটুকু বলা যায় সুস্থ্য সবল মানুষ হওয়া সত্বেও সেদিন ভারবাল কমিউনিকেশনের চেয়ে ননভারবাল কমিউনিকেশনই বেশী করতে হয়েছে। রাস্তাঘাটে ঠিকানা না চিনলে আমার সাথে থাকা ভাই জিজ্ঞেস করে ‘ডু ইউ স্পীক ইংলিশ?’ মোটামুটি সবাই-ই জবাব দিত ‘ইয়া, আ লিটল বিট।’ পরে বুঝতাম যে সেই ‘লিটল বিট’ ইংলিশও আমাদের চেয়ে ঢের ভাল।কিন্তু মাঝে মাঝে কপাল মন্দ থাকতো, অনেকে কিছুই বুঝতোনা।গ্রামে এই সমস্যাটা বেশী আসলে।তখন আর কি করা। সেই নন ভারবাল কমিউনিকেশন!বিটিভির সংবাদে মূল ধারায় খবর পরিবেশনের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য যেমন সাংকেতিক ভাষায় খবর দেখানো হত সেরকম কিছু একটা করতে হত! একদিন এক রাতে যেমন আমরা দুই বন্ধু গেছি এক বেকারীতে।মোটামুটি ৫ মিনিট ভাব আদান-প্রদানের পর তাকে বুঝাতে সক্ষম হলাম যে আমরা ব্রেড চাই। তরুণ জার্মান ছেলেটার সহকারী ব্লন্ড মেয়েটা একগাল হেসে বলল ‘আলেস ক্লার’(এভ্রিথিং ইজ ওকে)। কিছুক্ষণ পর দেখলাম সে আমাদের দেশের রুটি বানানোর জন্য যে কাই থাকে ওই গো্ল কাইয়ের দলা ৫-৬ টা সেঁকে আমাদের জন্য নিয়ে আসলো। তার চেষ্টায় মুগ্ধ হয়ে আমরা তখন ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।এরকম এক অভিজ্ঞতার পর সঙ্গী ভাইকে বললাম, ‘ভাই এখন থেকে কেউ ইংলিশ কম বুঝলে তার সাথে সরাসরি বাংলায় কথা বলা শুরু করব।কেউ জার্মান বাদে আর কিছু না বুঝলে তার জন্য কি বাংলা কি ইংলিশ দুইটাই তো সমান!’
আমাদের বাসার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইউরোপের বিখ্যাত রাইন নদী। জার্মানীতে ফার্স্ট ইমপ্রেশনে প্রেমে পড়ার মত কিছু বলতে হলে বলবো এই রাইনের কথা। বিকেল বেলা নদীর পাড়ে হাঁটতে যেতাম প্রায়ই।ফেরার সময় কোন এক অজানা কারণে মন খারাপ হয়ে যেত। কি কারণ সেটা অবশ্য আজো বুঝে উঠতে পারিনি।তখন থেকে একটা বদঅভ্যাসের শুরু।আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। তাকিয়ে প্লেন দেখা।
পরিশেষঃ আজ বিশেষভাবে ওই কয়েকজন বাঙ্গালী ভাইদের ধন্যবাদ দিতে চাই যারা প্রবাসের মাটিতে পা দেয়ার প্রথম অনুভুতিগুলো ভাল লাগা দিয়ে শুরু করাতে ভূমিকা রেখেছিলেন।ভিনগ্রহের মত এই দেশটায় যারা মমতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শুরুর দিনগুলোয়। ভাবুন তো, ভার্সিটি থেকে ফেরার পর বাসায় ফিরতেই কেউ ফোন করে বললো- ‘ভাই আজকে বিকেলে ক্রিকেট খেলব কিন্তু’ কিংবা মন খারাপ দেখে শুয়ে পড়েছিলেন।ঘুম ভাঙ্গার পর যখন শুনবেন কেউ প্রবল মমতায় ডেকে তুলছে- ‘ভাই,ও ভাই।ভাত খাবেন না?’
অসংখ্য ধন্যবাদ এবং অসীম কৃতজ্ঞতা ভাই আপনাদের প্রতি।
মোঃ মহসীন
মাস্টার্স ইন মলিকিউলার বায়োটেকনোলজি
ইউনিভার্সিটি অফ বন
বন,জার্মানী
অসাধারন ।
ভালো লিখছেন ভাই। বর্ণনাতে যা লিখলেন – সম্ভব হলে আমিও চলে আসতাম উপভোগ করার জন্য। নিয়মিত জানাবেন ভাই। অপেক্ষায় আছি…
Thanks vai
[…] ভিলকমেন ইন ডয়েচলান্ড ( ওয়েলকাম টু জার্… […]