আমার স্কাইপেতে কথা বলার কতগুলো ফেইজ আছে। ফেইজগুলো নিম্নরূপঃ

ফেইজ-১: শুরুতেই ভাইয়ার সাথে কথা হয়। কথা বলার ডিউরেশন ভাইয়ার মুডের উপর নির্ভরশীল। মুড ভাল থাকলে ভাইয়ার মুখ উজ্জ্বল দেখায়। নদীর বহমান স্রোতের মত আজস্র কথা বলে চলে, খিলখিল করে হাসে, ফোন রাখা যায় না। মুড অফ থাকলে মুখ কাল দেখায়। অত্যান্ত কম কথা বলে। ভাইয়া ভুরু কুঁচকে গম্ভির হয়ে বলে “হ্যাঁ তপু, কি আবস্থা? কালকে কি স্কাইপেতে আসবা? ওকে আম্মুকে দিচ্ছি…”

ফেইজ-২: আম্মু চেয়ারে বসে নিজ হাতে হেডফোন পড়েন, আম্মুর হাতের ঘর্ষণে হেডফোনের ভলিউম কন্ট্রোলার নড়ে মিউট হয়ে যায়। আমি হ্যালো হ্যালো করি, আম্মু ইশারা করে বলে, “কিচ্ছু শুনিনা!” প্রতিদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাই আম্মুর সাথে কথা বলার সময় ভাইয়া পাশের রুমেই থাকে। আর প্রতি পাঁচ মিনিট পর পর অঙ্গুল ফোঁটাতে ফোঁটাতে দরজায় উঁকি মেরে দেখে যায় সব ঠিক ঠাক আছে কিনা। আম্মুর সাথে কনভারসেশন শেষ হয় আম্মুর একই সাথে “হা” এবং “না” যুক্ত স্পেসিফিক বাক্য দিয়েঃ “তোমার আব্বুর সাথে কথা বলবা? সে কিন্তু প্রতিদিনই তোমার কথা জিজ্ঞেস করে, বলে আমার ছেলেটা আসলে আমাকে একটু দিয়ো তো! কিন্তু কালকে তো সকাল বেলা তার ক্লাস আসে, আচ্ছা থাক তাহলে। নাকি কথা বলবা?”

ফেইজ-৩: আব্বু স্বল্পভাষী মানুষ, কম কথা বলেন এবং প্রতিদিনই একই বাক্য বিনিময় করেন। আর ভাইয়া পাশ থেকে থেকে বিরক্ত হয়ে বলে, ”প্রতিদিন একই কথা, একই কথা, রেকর্ড করে রাখলেই হয়!” আব্বুর সাথে কথা বলার সময় ভাইয়া পাঁচ মিনিেটর পরিবর্তে প্রতি দু মিনিট পর পর অঙ্গুল ফোঁটাতে ফোঁটাতে এসে দেখে যায় সব ঠিক আছে কিনা। আব্বু কথা কম বলে তো! অনেক সময় চেকিং এর আগেই কথা বলা শেষ হয়ে যায়! যাই হোক, আব্বু আমাকে দেখেই প্রথমে বলেন, “আব্বা!” তারপর হো হো করে হেসে বলেন, “কেমন আছো বাজান? মনে হয় কত দিন দেখিনা” এরপর স্ক্রিনের সামনে একটু ঝুকে গিয়ে বলেন,”দেখি, মুখটা একটু দেখিতো বাজান।” আমার চাঁদ মুখ দেখতে গিয়ে প্রতিদিনই আব্বুর কান থেকে হেডফোন সড়ে যায়, আমি হ্যালো হ্যালো করি, আব্বু আমার কথা শুনতে পাননা। এরই মধ্যে দু’মিনিট পার হয়ে যায়, ভাইয়ার চেকিং এর সময় হয়ে আসে, ভাইয়া অঙ্গুল ফোঁটাতে ফোঁটাতে দরজা খুলে উঁকি দেয়, পুনরায় আব্বুর মাথায় হেডফোন প্রতিস্থাপন করে, তারপর আবার পাশের রুমে চলে যায়। আব্বু ছোট্ট একটি বিরতি নিয়ে বক্তব্য শেষ করেন, “তুমি ছাড়া একদম সময় কাটেনা বাজান। আমরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করতেসি। দোয়া করি সব কিছু শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরে আসো। আর আমার জন্যও দোয়া করো বাজান!” আব্বার এই দোয়া চাওয়ার পেছনে একটা গভীর অর্থ আছে যেটা আমি বুঝি…

ফেইজ-৪ (অপশোনাল): “বড়”, আমার আম্মার এসিস্টেন্ট। কিন্তু “বড়” নামটি বড়র আসল নাম নয়, এটা আমার নানার আদর করে দেওয়া একটা নাম। বড়রা তিন বোন, খুব ছোট বেলায় নানুর বাসায় এসেছিল। এরপর নানুর বাড়িতেই তিন বোনের বড় হওয়া। ও ছিল সবার বড়, তাই ওর নাম বড়। আর ওর ছোট বোনের নাম ছোট, কারণ ও সবার ছোট। তবে মেঝোটার নাম অজ্ঞাত কারণে মঝারি রাখা হয় নি। ওকে আসল নামেই ডাকা হয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের সাথে থাকার কারণে বড়ও আমাদের পরিবারেরই একজন। বড় আমাকে অত্যান্ত স্নেহ করে। আমার সাথে মাঝে মধ্যেই স্কাইপেতে কথা বলতে চায়। যেদিন ওর কথা বলতে ইচ্ছে হয়, ও দরজার সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর কথা হলে দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, “কি রান্না করছ আব্বু?” আমি আমার রান্নার বর্ণনা দেই, বড় আমার রান্নার কথা মন দিয়ে শুনে, তারপর ভুল ধরিয়ে দেয়, কিছু টিপ্সও দিয়ে দেয়। টিপ্স দেওয়া শেষ হলে আমি ওর নাতির কথা জিজ্ঞেস করি। নাতির কথা জিজ্ঞেস করলে বড় প্রচণ্ড খুশি হয়। তারপর খুশিতে গদগদ হয়ে বলে, “আমার নাতি এখন মবিল (মোবাইল) উস (ইউস) করতে পারে, ওইদিন একলা একলাই আমাক ফোন কইরিয়ে কয় কি, এ নানি তুমি কবে আইসবা?”

এভাবেই আড়াই বছর ধরে প্রতিদিন একই কথা শুনে আসছি। কিন্তু এই একই কথাগুলই আমাকে প্রতিদিন সজিব করে তোলে, আমাকে জীবনী শক্তি দেয়, আমি দ্বিগুণ উৎসাহে আবারও পরের দিনটা শুরু করি। আসলে ভালবাসার ক্ষেত্র অনেক বিশাল। ভালাবাসা প্রতিদিনের। ভালবাসা আমাদের সব কিছুকে ঘিরে। সবাইকে “বিশ্ব ভালবাসা দিবস”-এর অনেক অনেক শুভেচ্ছা!

তপু,

০২/১৪/২০১৫

mm

By Rashed Shelim

বর্তমানে RWTH Aachen ইউনিভার্সিটিতে Communication Engineering এ মাস্টার্স করছি। পাশাপাশি P3 Communication GmbH এ রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করছি। এর আগে Huawei Bangladesh Ltd এ Core Network Engineer(PS) হিসেবে কর্মরত ছিলাম। ২০১০ সালে নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে Electronics and Telecommunication Engineering এ ব্যাচেলর সম্পন্ন করি। অবসর সময়ে গিটার, রান্না-বান্না, গান, আড্ডা, লেখালেখি, চা খেতে আর WWF দেখতে পছন্দ করি।

Leave a Reply