Nazmul Hasan Khan Ashis

করোনার তান্ডবে বাকি বিশ্বের মতো জার্মানির শিক্ষা কার্যক্রমও যথেষ্ট ব্যাহত হয়েছে। আশার কথা এই যে আবারো বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জার্মানির ভিসা দেওয়া শুরু হয়েছে। ফলস্বরূপ এই উইন্টার সেমেস্টারে অনেক নতুন স্টুডেন্টসই বাংলাদেশ থেকে জার্মানি এসেছেন এবং অনেকেই শীঘ্রই আসবেন। নতুন আগত শিক্ষার্থীদের জন্য জার্মানির জীবন ব্যবস্থার কিছু অলিখিত নিয়ম-কানুন নিয়েই এই লেখা যা এখানে বাস করতে হলে মেনে চলতে হয়।

রাস্তায় সঠিক জায়গা ধরে হাঁটুনঃ

জার্মানির অনেক শহরেই যাতায়াতের অন্যতম প্রধান বাহন বাইসাইকেল। সব শহরের চিত্র একই না হলেও বাইসাইকেল আরোহীদের জন্য সব জায়গায়ই আলাদা রাস্তা করে দেওয়া আছে। সাধারণত হাঁটার রাস্তা বা ফুটপাতের সাথেই এই বাইসাইকেলের লেন থাকে। ফুটপাতে হাটার সময় তাই এই লাল রঙের লেনে হাটবেন না।অনেক জায়গায় লাল রং করা না থাকলেও রাস্তায় বাইসাইকেলের চিহ্ন আকা থাকে। এই লেনগুলো হাঁটার রাস্তার পাশাপাশি থাকায় না জানা থাকলে বাইসাইকেলের রাস্তায় চলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগত আমিও প্রথম প্রথম এ জন্য বেশ কয়েকবার তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি। আপনার জার্মান জীবন বাইসাইকেল দূর্ঘটনা বা কোনো বাইকারের আক্রোশ দিয়ে শুরু করতে না চাইলে ফুটপাত বা পেভমেন্টে হাটার সময় পথচারীদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা দিয়ে হাঁটুন।

এস্কেলেটরের বাম পাশে দাঁড়াবেন নাঃ

বাইসাইকেলের লেনের মতোই কোনো উবান বা শপিং মলের এস্কেলেটর বা চলন্ত সিড়ি ব্যবহারের সময় সঠিক জায়গায় দাঁড়াতে শিখুন। পিছন থেকে যদি কোনো স্ট্রেঞ্জারের হাক শুনতে না চান তবে জার্মানিতে আপনার দাঁড়ানোর সঠিক জায়গা বুঝে নিন।এস্কেলেটরে উঠে কখনো বাম পাশে দাঁড়াবেন না। ঠিক সময় মতো ট্রেন ধরার তাড়া বা কাজ থাকা মানুষদের বিহ্বল দৌড় বা হেটে চলন্ত সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠাটাকে ব্যাহত না করার জন্য সব সময় এস্কেলেটরের বাঁ পাশ রেখে দেওয়া হয়।

মুভি ডাইনলোড আর টরেন্টিং এর কথা ভুলে যানঃ

আপনি আমার মতো বিদেশি মুভি আর টিভি সিরিজের ফ্যান? রিলিজ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গরম গরম নামিয়ে দেখে ফেলেন? জার্মানিতে এসে ভুলেও এই কাজটি করবেন না। পাইরেসি আর টরেন্টিং করলে জার্মানিতে তিন থেকে পাঁচ হাজার ইউরো পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হয়। অনেককেই এই তিক্ত স্বাদ নিতে হয়েছে। আপনি না জেনে করে থাকলেও পার পাবেন না। সমাধান হিসাবে মাসিক অল্প খরচে এম্যাজন প্রাইম বা কয়েকজনের সাথে শেয়ার করে নেটফ্লিক্সের সাবস্ক্রিবশন নিতে পারেন। আপনার বিনোদনের চাহিদা এতে পরিপূর্ণ হবে বলা যায়।

পানি কেনার সময় স্পার্কলিং ওয়াটার কিনা দেখে কিনুনঃ

জার্মানিতে পানি কিনতে গিয়ে প্রায়ই যে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় তার নাম স্পার্কলিং ওয়াটার। কোক বা অন্যান্য সফট ড্রিংকসের মতো সাধারণ পানিও জার্মানরা গ্যাসসহ পান করতে পছন্দ করে। সাধারণ পানি ভেবে কিনে তাই বোতল খোলার পর পানির বুদবুদ দেখে প্রায়ই ভাবি এবারো বোকামি করে কিনে ফেলেছি জার্মানদের অতি প্রিয় স্পার্কলিং ওয়াটার। স্টিল ওয়াটার পান করে বড় হওয়া আমার কাছে স্পার্কলিং ওয়াটারের স্বাদ আর গন্ধ যে নিতান্তই পরিত্যাজ্য একথা বলাই বাহুল্য। জার্মানিতে তাই পানি কেনার সময় স্টিল নাকি স্পার্কলিং তা চেক করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

জার্মান উবানে যথাসম্ভব নীরব থাকুনঃ

আমি এটা ইউরোপের অন্য কোথাও দেখিনি কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারনে জার্মানির আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেন বা উবানের যাত্রীরা কখনো উচ্চ স্বরে কথা বলে না। জার্মানির উবানে উঠলে আপনার কখনো কখনো মনে হবে কোনো লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছেন। ট্রেনের শব্দ ছাড়া চারদিকে সুনসান নীরবতা। এখানে উঠে তাই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে উচ্চস্বরে কথাবলা বা হাসাহাসি না করাটাই শ্রেয়। করলে কখনো কখনো কোনো এল্ডারলি জার্মান ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার রোশানলে পড়তে পারেন। এগেই রেফারেন্স হিসাবে থাকছে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

পাবলিক বা প্রাইভেট প্লেস কোথাও স্মোকিং নয়ঃ

পাবলিক প্লেসে তো বাংলাদেশেও স্মোকিং করা মানা। তাই নিজের প্রাইভেট স্পেস বা ঘরেই অনেকে তা করে। আপনি যদি স্মোকার হয়ে থাকেন তবে আপনার জন্য দুঃসংবাদ। জার্মানিতে রুম বা কিচেনের মতো প্রাইভেট স্পেসে স্মোক ডিটেক্টর থাকায় সেখানেও কার্যত আপনি ধুমপান করতে পারবেন না। মানে কি? তাহলে কি জার্মানিতে মানুষ জন স্মোকিং করে না? অবশ্যই করে। এজন্য আপনাকে ব্যালকনি বা বারান্দার একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে করতে হবে যা শুধু স্মোকিং এর জন্য বরাদ্দ। অনেক অফিসে অবশ্য স্মোকিং এর জন্য আলাদা রুমই আছে।

বাংলাদেশি টাইম ছেড়ে জার্মান টাইম শিখুনঃ

নয়টা বলা মানে বারোটা টাইপের বাংলাদেশি টাইম সিস্টেমের কথা এখানে ভুলে যান। জার্মানিতে নয়টা মানে আসলে আপনাকে আটটা পঞ্চাশে উপস্থিত থাকতে হবে। জার্মানরা প্রচন্ড রকম সময় মেনে চলা জাতি। কোনো এপোয়েন্টমেন্ট থাকলে তারা সাধারণত পাঁচ মিনিট আগে সেখানে উপস্থিত হয়। আপনার কাছ থেকেও তারা সেটাই প্রত্যাশা করে। বাংলাদেশের মতো এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের কারণে দেরি হয়েছে টাইপ অযুহাত এখানে কেউ পাত্তা দেয় না।

লালবাতিতে কখনোই রাস্তা পাড়াপাড় নয়ঃ

জার্মানরা যে কতোটা নিয়ম কানুন মেনে চলা জাতি তা আপনি স্ট্রিট ক্রসিং এ দাঁড়ালে আরেকটু বুঝতে পারবেন। রাত যতোই হোক, রাস্তায় যতোই গাড়ি না থাকুক কেন সিগনাল লাইটে সবুজ বাতি না জ্বললে জার্মানরা কখনোই রাস্তা পাড়াপাড় হবে। বিশেষ করে সাথে যদি কোনো বাচ্চা থাকে তাহলে তাদের সামনে এই নিয়ম ভাঙ্গাটা জার্মানরা খুবই বাজে এক্সাম্পল সেট করা ভাবে। ইউরোপের অন্য দেশে অতোটা না হলেও জার্মানিতে স্ট্রিট ক্রসিংএ সিগন্যাল লাইটের নিয়ম খুবই ফলো করা হয়। তাই স্ট্রিট কপের হাতে জরিমানা না গুনতে বা পাশে দাঁড়ানো কোনো জার্মান মুরব্বির হাক না শুনতে চাইলে রাস্তায় কোনো গাড়ি না থাকলেও সবুজ বাতি ছাড়া রাস্তা পাড়াপাড় হবেন না।

বিশ্বযুদ্ধ আর হিটলার নিয়ে কোনো কথা নয়ঃ

জার্মানরা যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সবচেয়ে অস্বস্তি অনুভব করে তা হল বিশ্বযুদ্ধ আর জার্মানরা যে ব্যাক্তির নামও মুখে নেয় না তিনি এডলফ হিটলার। তাই জার্মানদের সাথে কথোপকথনে এই বিষয়গুলো না আনাই ভালো। আধুনিক বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালি দেশ হয়েও নিজেদের অতীত ইতিহাস নিয়ে জার্মানরা অনেক বেশি অনুতপ্ত। হয়তো এজন্যই জার্মানদের মধ্যে ন্যাশনালিজম অনেক কম।পঁচাত্তর বছর পেড়িয়ে গেলেও জার্মানদের এই বোধের কারণে তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রতিনিয়ত বেড়ে যায়।

N H Ashis Khan

mm

By Nazmul Hasan Khan Ashis

I am a masters student in Germany who's studying English literature. I am a traveller and amateur filmmaker. I write occasionally only to unburden myself from the agony of carrying some persistent thoughts.

One thought on “ডয়েচল্যান্ড ১০১ঃ নতুনদের জন্য জার্মানি আর জার্মান জীবনের অলিখিত কিছু নিয়ম”

Leave a Reply