শনি-রবি শেষে অর্থাৎ সপ্তাহান্তে সোমবারে যখন অফিসে যাই (এখন যাই না, কারণ হোম অফিস চলে), সহকর্মীদের এক রা, কি কি করলে উইকেন্ডে? এক এক জনের এক এক উত্তর। কেউ হয়ত থিয়েটারে গেছে, কেউ পিয়ানো বাজিয়েছে, কেউ ম্যারাথনে গেছে, কেউ ডান্স কেউবা কনসার্ট অথবা সিনেমায় গেছে। কেউবা নৌকা চালায়, কেউ বাইসাইকেল নিয়ে ঘুরে এসেছে শহরের শেষ প্রান্ত। আমার উত্তরের পালা এলে বলি, এক ঝাঁক বন্ধু নিয়ে ৩ ঘণ্টা রান্না করেছি, তিরিশ মিনিটে খেয়ে গল্প করেছি। লক্ষ্য করে দেখলাম প্রায় দুই বছর ধরে আমি একই উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। একসময় সহকর্মীরা জেনে গেল আমি একই উত্তর দিচ্ছি, তাই আমার পালা এলেই ওরাই উত্তর বলে দিয়ে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে। 

পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত জীবনকে পরিপূর্ণরুপে উপভোগ করতে ইউরোপীয়দের চেষ্টার ত্রুটি নেই। এটি প্রকটরুপে আমরা দেখি গ্রীষ্মকালে। এবারে করোনার দরুণ উৎসবে ভাটা পড়লেও অন্যান্য বছরে বার্লিন বর্ণালী হয়ে উঠে, উৎসবের নগরী হয়ে উঠে। বহু মানুষ একত্র হয়ে কিছু করার সুযোগ এবারে না থাকলেও মানুষ নিজ নিজ সৃষ্টিশীলতা দিয়ে সময়কে উপভোগ করতে সচেষ্ট। ঘরে বসে ছবি আঁকা, পিয়ানোতে নতুন নতুন গান তোলা, জমানো বইগুলো পড়ে রিভিউ দেওয়া, বাইক নিয়ে ঘুরতে যাওয়া ইত্যাদি কাজে মানুষ নিজেদের আরো বেশি করে যুক্ত করছে। এর বাইরে স্প্রী নদীর ধারে মনোরম পরিবেশে পারিবারিক পিকনিক এখন বার্লিনের পরিচিত দৃশ্য।

আমার এক বন্ধু আছে পেশায় ভাইরোলজিস্ট। এইচ আই ভি আর হেপাটাইটিস নিয়ে তাঁর কারবার। এমন বেখাপ্পা পেশার মানুষ হলে কি হবে, তাঁর ব্যক্তিগত শখের শেষ নেই। বার্লিনের মধ্যে হলেও তাঁর নিজস্ব বাড়ির চারিপাশ দেখলে মনে হয় গহীন বন। বাড়ির উঠোন ভর্তি কচ্ছোপ, গিনিপিগ, খরগোশ, কুকুর, কোয়েল পাখি ইত্যাকার প্রাণি। আমি বেশ কবার গিয়েছি। সেদিন একবার গেলাম যখন গিনিপিগ বাচ্চা দিল। এই গিনিপিগ ভাইয়ের সাথে শুয়ে গর্ভবতী হয়েছে। আমাদের চোখের সামনেই  পাঁচ পাঁচটি মেয়ে বাচ্চার জন্মদিল। অন্যদিকে বাড়িতে চারটি কুকুর। দেখলেই কোলে নিতে ইচ্ছে করে। সেদিন একটি কুকুরকে ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলতে হল। ওর নাম ছিল সোফি। খুব অল্প কদিনে ওর পেটের নিচে বিরাট এক টিউমার হল, শেষের দিকে নড়তেই পারত না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই কষ্ট আর না বাড়িয়ে ইনজেকশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। বন্ধু আমার কেঁদে কেটে একাকার। কম তো নয়, গুনে গুনে এগারো বছর ধরে ওর সঙ্গী ওই কুকুরগুলো। 

কোলে যে আছে ওর নাম বাজিঙ্গা, নিচে সোফি, সম্প্রতি যে মারা গেছে।

ভাইরাস-বিজ্ঞানী এই বন্ধুর আরেকটি শখ হল মৌমাছি পালন। প্রথম দিকে শখ থাকলেও এখন এখান থেকে দু’পয়সা রোজগারও হয়। ওখানে প্রায় ২৫ টি কলোনি আছে যা থেকে বছরে সে প্রায় দশ হাজার ইউরোর মধু বিক্রি করে। এখানে সরকার মধু চাষকে উৎসাহিত করে। কারণ মৌমাছি পরিবেশের জন্য ভাল। পরাগায়নে সহায়তা করে। কেউ কেউ বলে মৌমাছি না থাকলে মানবজাতি মাত্র চার বছর টিকে থাকতে পারবে। কথাটি পুরোপুরি সত্য নয়, তবে মৌমাছিবিহীন পৃথিবীতে মানুষের খাদ্যসংগ্রহে বিরাট পরিবর্তন আসবে তা নিশ্চিত। যেমন, বাদাম, পীচ, বরই, আপেল, চেরি মৌমাছি ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়। অন্যদিকে চাল আর গম বায়ু পরাগায়নে উৎপাদিত হয় বিধায় মানুষ অন্তত না খেয়ে মরবে না।   

ভিডিওতে আমি নিজে মধু ভরছি বোতলে।

জার্মানিতে ৩০টির বেশি কলোনি হলে সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়, তাই প্রায় সবাই সর্বোচ্চ ২৯ টি করে কলোনি রাখে। মে জুন জুলাই হল মধু সংগ্রহের মাস। এ সময়ে আমার বন্ধুটির কাজ বেড়ে যায়, তাতে হাত লাগানোর কিছু মানুষের দরকার পড়ে। আমিও বেশ কবার গিয়েছি। কিছু কাজ করার পরেই ৪টি বোতলে ভরে ২ লিটার করে মধু ধরিয়ে দেয় হাতে। এর বাইরে আমি একবার ৪ বোতল কিনেছিলাম। চিনি থাকায় মধু আমি খুব কমই খাই, তাই প্রায় সব মধুই বন্ধুদের দিয়ে দিয়েছি।

প্রতিটিতে ৫০০ গ্রাম করে মধু।

এবছর মধু তোলা শেষ, তবু পরিচর্যার জন্য কিছু কাজ সবসময়ই থাকে। ওসব করতে আমি বেশ আগ্রহ পাই, তাই মাঝে মাঝে যাওয়া হয়। ওর এবার কলোনি বাড়বে, আমার আগ্রহ দেখে সে কিছু কলোনি আমার কাছে বিক্রি করতে চায়। আমি বলেছি, সে যদি গাইড করে তাহলে আগামী বছর নাগাদ আমি কিনবো।
 



২৩ শ্রাবণ ১৪২৭
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে

আরো পড়ুন
বার্লিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ- কোরিয়ান খাবার-উৎসব

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply