এখানকার বাসগুলো জাদুর মতো। আপনার গন্তব্যস্থান আসলেই আপনি দরজার সামনে দাঁড়াবেন; আর ওমনিই দরজা খুলে যাবে— অন্তত এই ছিল আমার ধারণা।

রোজরোজ বাসে উঠি। স্টপেজ আসলেই অন্যদের সাথে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। নির্দিষ্ট জায়গায় আমরা সবাই একসাথে নেমে পড়ি। এখানে কেউ মাঝরাস্তায় বলে না— ওস্তাদ, গাড়িটা স্লো করেন; আমি নামব। কিংবা, ওস্তাদ, লেডিস নামব। এখানে লেডিস জ্যান্টস্ বলতে কিছু নেই। গাড়ি সাধারণত মেয়েরাই চালায় (আমার শহরে সম্ভবত শতকরা আশি ভাগ বাস ড্রাইভারই মেয়ে)। গাড়ি নির্দিষ্ট স্টপেজেই থামে, দরজা খোলে, যাত্রী নামে। ড্রাইভারের সাথে কারো কোনো কথা নেই। বাসে ‘হেল্পার’ নামক কোনো ব্যক্তি নেই। নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থামছে, যাত্রী উঠছে-নামছে।

আর সবচেয়ে সুখের বিষয় হচ্ছে— এখানে ‘ট্রাফিক জ্যাম’ নামক কোনো শব্দ নেই। একটা বাস এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছায়। আপনার ফোনে নির্দিষ্ট শহরের বাসের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাপলিকেশন থাকবে। আপনি ঘরে বসে দেখবেন— ঠিক কত ঘণ্টা কত মিনিটে আপনার বাসার সামনের বাস স্টপেজে বাস এসে থামবে। নির্দিষ্ট সময় পরপর (প্রায় পাঁচ-দশ মিনিট পরপরই) বাস পাবেন। সাড়ে দশটার বাস সাড়ে দশটাতেই আসবে, আগে পরে না (এটা অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়িয়ে বলেছি— প্রায়ই দুই-এক মিনিট আগে পরে চলে আসে)।

তো যা বলছিলাম— অন্যান্য দিনের মতো আমার গন্তব্যস্থান আসলো। আমিও নামব বলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু, হায়! দরজাতো খোলে না! গাড়িওতো থামে না! স্টপেজওতো গেল পার হয়ে! এ কী মসিবত! নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জার্মান শব্দগুলোর একটি— এনশুলডিগং! (Excuse me!) চারপাশের লোকজন ভূত দেখার মতো করে তাকাল আমার দিকে। এদিকে স্টপেজও পার হয়ে গেছে। চাইলেও পরের স্টপেজ ছাড়া আমি আর নামতে পারব না, গাড়ি থামবে না। সুতরাং, লোকজনের ভূত দেখা দৃষ্টির জন্যই হোক, আর নিজের নিয়তিকে মেনে নেয়ার কারণেই হোক, পুনরায় বললাম— আলেস গুট! আলেস গুট! (সব ঠিক আছে! সব ঠিক আছে!)

পরের স্টপেজে অন্যান্য যাত্রীও নামবে। তাদের একজনকে দেখলাম সিটের পাশে থাকা লাল রঙ্গের একটা সুইচ চাপ দিতে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের সামনে থাকা স্ক্রিনে লেখা উঠল— ভাগেন হাল্ট (ভাবানুবাদ: গাড়ি থামবে)। খেয়াল করে দেখলাম প্রায় প্রত্যেকটা সিটের পাশেই এরকম সুইচ দেয়া। সুইচ চাপ দেয়ার মানেই এই স্টপেজে গাড়ি থামবে। এজন্যই এখানে ড্রাইভারের সাথে যাত্রীর কথা বলতে হয় না। গাড়িতে ‘হেল্পার’ নামক কোনো ব্যক্তিও লাগে না। গাড়ি দুই সময় স্টপেজে থামে। এক— ভেতর থেকে কেউ সুইচ চাপ দিয়েছে, মানে যাত্রী নামবে। দুই— বাইরে স্টপেজে কেউ আছে, মানে যাত্রী উঠবে।

আচ্ছা! তারমানে এখানে জাদু বলতে কিছু নাই। সব সুইচের খেলা!

এখন জাতির বিবেকের কাছে প্রশ্ন— বাস ভর্তি যে এতগুলো সুইচ, এগুলোর একটাও কেন এক সপ্তাহেও আমার চোখে পড়েনি? কেন পড়েনি?

বাস বিড়ম্বনা—১

mm

By Khadizatul Sonya

M.Sc. student of Sustainable International Agriculture (SIA), at University of Goettingen, Germany.

Leave a Reply