বাংলাদেশের বা পৃথিবীর কোন এলাকার মানুষ উপকূলীয় এলাকার মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ঝড় কখনো বুঝতে পারবে না যারা এর ভেতর দিয়ে যায় নি। এমনিতেই বরিশাল, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা অঞ্চলে সারাবছর অভাব লেগে থাকে। এই সব এলাকায় বর্ষার শুরুতেই জোয়ারের পানি এসে যায় বলে মাত্র একবার ফসল হয় যেখানে কুষ্টিয়া যশোরে দুইবার বা তিনবার ফসল হয়।
পুর্ব পাকিস্তান আমলে এইসব এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি বেশীর ভাগ কাচা ছিলো,পাকা দালান নেই বললেই চলে। এজন্যয খন তুফান আসে তখন মানুষের যাওয়ার কোন জায়গা ছিলোনা। যখন সাগরে জোয়ার ওঠে আর তুফান শুরু হয় ঘরের মেঝে থেকেও পানি আসা শুরু করে। ঘূর্ণিঝড় এর সময় প্রচন্ড বাতাস শুরু হয়। প্রচণ্ড রকম শব্দে কেউ কারো কথাও শুনতে পারেনা। টিনের চালের প্রচণ্ড শব্দ আর বাতাসে জামাকাপড় এমনকি মায়ের কোলের বাচ্চাটাও যেন বাতাস আছড়ে ছিটকে নিয়ে যেতে চাই।
মায়ের অনেক গুলো বাচ্চা কিন্তু সবগুলোকে ডেকে পাওয়া যায় না। বাতাসে নাম ও ভেসে যায়। আমার চাচা ফুফুদের ডাক নাম গুলো এইজন্য এরকম ছিল টুকু, টুলু, পুটু, হিলু, দুলু। তীব্র বাতাসের ভেতর যাতে অনেক দূর থেকে নাম ধরে ডাকা যায়। তুফানের পানি আসা শুরু করেছে তুমুল ঝড়, মানুষ জীবনের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে সারারাত। বাতাসে অন্ধকা্রে বাতি নিভে গেছে কোথাও কোন বাতি নেই। মা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বাচ্চাগুলো নিয়ে ছুটছে, কোথায় যাবে জানেনা পানি এসে গেছে।


১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এর আগে বরিশাল বা উপকূলীয় অঞ্চলে আশ্রয় কেন্দ্র ছিলো না। মানুষ এক জীবনে শুধু একটা পাকা ঘরের স্বপ্ন দেখে গেছে। যখন তুফান ওঠে বাড়িঘরে শন শন করে তুফানের পানি আসা শুরু করে। কয়েকঘন্টার ভেতর কোমর ছাপিয়ে পানি উঠে যায়।


মানুষ সব বিপদে আগে বাড়িতে আসে আশ্রয় খোঁজে। কিন্তু ঝড় তুফানের সময় বাড়িতেও আর আশ্রয় নাই। সবাই শুধু বেচে থাকার চেষ্টা, এর ভেতর পানির সাথে সাপ ও আসে আশ্রয় নিতে। কিছু কিছু ঘরে বয়স্ক এবং অসুস্থ মানুষ কোথাও যেতে পারেনা, পরে সারারাত চিৎকার করে ভয়ে বা পানিতে মারা গেছে। কারো মায়ের হাত থেকে বাচ্চাটা পানিতে পড়ে ভেসে গেছে। যেখানে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পায়ের নিচের মাটিটা হঠাট সরে যেতে থাকে।


আগে রেডিও টেলিভিশন ছিলো না, ইন্টারনেট তো সেদিন এসেছে। কেউ কোন বিপদ সংকেত পেতো না। হঠাৎ একজন হয়তো বড় নদীর মাঝির থেকে খবর পেয়েছে। সারাগ্রাম সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে দৌড়াতে থাকে খালি গলায়, “তুফান আইতাছে” তুফান আইতাছে।”


বৃষ্টির পানিতে মাটির চুলায় পানি উঠে গেছে। কাঠের খড়ি সব পানিতে ভিজে সপসপ করছে। বেশীর ভাগ বাড়িতে উনুন জলে নি। উনুন জ্বললে ভাত রান্না করে ফেলে রাখা হয়। পান্তা ভাতে লবণ আর ইচা মাছ পোড়া। যখন দশ পনের ফিট পানি আসে কেউ হয়তো নারিকেল গাছ জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো সারারাত কেউ বেঁচে গেছে আর আবার কেউ বজ্রপাতে মারা গিয়ে গাছের ডালে আটকে রয়ে গেছে। চারিদিকে মৃত দেহ ছড়াছড়ি।
যাদের ভাগ্য ভাল তারা পাকা মসজিদে বা স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলো, তারা হয়তো টিকে আছে। ১৯৭০ সালে ভয়াবহ ঘূণিঝড়ে ভোলায় প্রায় ৫ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।সাথে গবাদি পশু, হাস মুরগীও ভেসে গেছে।


পূর্ব পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশকের একটা রাতের ঘটনা শুনেছি আমার বাবার মুখে, তখন আমাদের দাদা বাড়িতে সারা গ্রামে একটা পাকা মসজিদ ছিলো, দাদার বাবার করা। আমার বাবা এবং চাচা ফুফুরা তখন খুবই ছোটো। একদিন আকাশ অন্ধকার করে প্রচন্ড ঝড় তুফান শুরু হয়েছে।সন্ধ্যা থেকে পানি এসে বাড়িঘর বিছানা পত্র সব তলিয়ে গেছে। সারারাত প্রচন্ড তুফান, আমার দাদী ছোটছোটো বাচ্চা গুলো নিয়ে মসজিদের ভেতর যেখানে ইমাম দাঁড়ান একটা উঁচু জায়গায় সারারাত দেওয়ালের নিজেদের আটকে রেখেছে।আর বাইরে সে কি তুফানের দমকা হাওয়া। প্রচন্ড শব্দে মড় মড় কর গাছের ডাল আর নারিকেল সুপারির গাছগুলো আছড়ে আছড়ে পড়ছে। হঠাৎ বিরাট বড় পুরোনো এক দেবদারু গাছ প্রকান্ড শব্দ করে মসজিদের উপরে ভেঙে পড়ে মসজিদের একটা কোনা ভেঙে গেলো!


গায়ের জামাকাপড় ভেজা, বাচ্চারা চিৎকার করছে সারারাত। আর বড় মানুষরা সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেদের দেওয়ালে আটকে ধরে রাখার চেষ্টা করছে আর প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে, লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতে ইল্লাবিল্লাহিল আলিয়ুল আলিয়ুল আজিম, কেউ আজান দিচ্ছে কেউ চিৎকার করতেছে আল্লাহ আকবর।


সারারাত গলা ফাটিয়ে চিল্লানোর পরে ভোর হয়৷ একসময় ক্লান্ত হয়ে ঝড় থেমে যায় । কিন্তু তখন কোথাও এক ফোটা খাবার পানি নেই। চারদিকে লবণ পানি, ঘরে মানুষের চাল ডাল খাবার নেই। হাড়ি-বাসন ভেসে গেছে, ঘরের চাল উড়ে গেছে। এরকম একটা রাত পার করার পরে সকালে ঘর নেই বিছানা, তোষক নেই। কোন রকম একটা কাঠের চোকি খুঁজে পেয়ে বা ভেজা মাটিতে মানুষ ঘুমিয়ে গেছে এই ভেবে যে বেঁচে আছে।


আজকাল ঢাকা বা শহরের করোনা বন্দী মানুষ বা বাংলাদেশের উত্তর দিকের যেমন কুষ্টিয়া, বগুড়া, যশোরের মানুষরা হয়তো তাদের সারা জীবনে কোনদিন এরকম একটা রাত পার করেনি আর কল্পনাও করতে পারবে না ।

mm

By Rasha Binte Mohiuddin

স্টুডেন্ট অফ মাস্টারস ইন ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রকালচারাল ফুড প্রডাকশন, ইউনি হোয়েনহেইম (স্টুটগার্ট জার্মানি)

Leave a Reply