বছর সাতেক আগের এক বিচিত্র সকাল। গির্জার ভেতরে শীত শীত করছে। অথচ রোদে ভেসে যাচ্ছে বাইরেটা। না চাইতেও ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ চলে যাচ্ছে দরজার দিকে। পাদ্রির খুক খুক গলা পরিষ্কারের ধরন দেখে মনে হচ্ছে সামনে ভীষন লম্বা বাইবেল পাঠ আছে। কিসের ভেতর এসে যে ফেঁসে গেলাম! না এসেই বা উপায় কি। সাত কূলে ইনগ্রিডের কেউ নেই। তাই ল্যাব ঝেঁটিয়ে সবাই চলে এসেছি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের বেঢপ মাইক্রোবাসে চেপে।

ইনগ্রিড আমাদের হেল্মহোল্টজ সেন্টারে কাজ করত। গবেষক। পুরো নাম ইনগ্রিড বেক-স্পিয়ার। তার ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল। কেমোথেরাপির কোপে পড়ে মাঝে মাঝেই আসত না অনেকটা সময়। ব্যাপারটা নিয়মের মত হয়ে গিয়েছিল। আলাদা করে আর তার থাকা বা থাকা চোখে পড়তো না। তবে দেয়ালে টাঙ্গানো ইনগ্রিডের আঁকা ছবিগুলো প্রায়ই মনে করিয়ে দিত তার কথা। রক্তের লোহিত কনিকা কিংবা মস্তিষ্কের নিউরনের ছবি এমন মুন্সিয়ানা আঁকা যে বিমূর্ত কলাচিত্র বলে ভুল হবে হঠাৎ তাকালে। মনে মনে ইনগ্রিডের শিল্পীমনের তারিফ না করে পারতাম না।

তারপর একদিন ইনগ্রিড নিজেই ছবি হয়ে গেল টপ্ করে মরে গিয়ে। তাতে অবশ্য হাউকাউ পড়ে গেল না কারো মাঝে। আমরা শুকনো মুখে করিডোরে দাঁড়িয়ে পাড় জার্মান কায়দায় পাঁচ মিনিট আহা উহু করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। জীবনের উৎসবে লোকের যত আগ্রহ, মৃত্যুতে ততটাই অনীহা।

কিন্তু মুশকিল বেঁধে গেল যখন জানলাম, ইনগ্রিডের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় লোক মিলছে না। আত্মীয় বলতে এক বোন আছে তার, বার্লিন নাকি বন-এ থাকে। বয়সের ভারে তার মিউনিখ অবধি আসার জো নেই। স্বামীও নেই, উনি গেছেন আরো আগেই। আবার ছেলেপুলেও নেই যে সৎকারের ভার নেবে। তাই ঘুরে ফিরে শেষ দায়িত্বটুকু কাজ বর্তালো এই আমাদের ওপরে।

ল্যাবে জরুরী এক্সপেরিমেন্ট ছিল। সব লাটে উঠিয়ে রেখে এসেছি। বাকিদেরও একই অবস্থা। উশখুশ করছি আমরা। খুব এক প্রস্থ হাঁচি কাশি চুকিয়ে পাদ্রি বাইবেলের পাতা ওল্টাচ্ছে। অত্যন্ত উঁচু দরের জার্মান আমার এলেমের বাইরে বলে বোঝার চেষ্টা করছি না। পাশে দাঁড়ানো ক্যাথরিন গলার শালটা চেয়ে নিয়ে মাথায় দিয়েছে ঘোমটার মত করে। ক্যাথরিন আর আমি একই ল্যাবে পিএইচডি করি তখন। পেছন থেকে আরেক ল্যাবের শেন জ্যো নামের চাইনিজ ছেলেটা জানতে চাইছে, তারও কি মাথায় কাপড় টাপড় কিছু দিতে হবে নাকি। ঠান্ডা গলায় শুনিয়ে দিয়েছি, ‘না, শুধু খুলির ভেতর ঘিলুটুকু সামলে রাখলেই চলবে আপাতত’।

শেন জ্যো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আবারো জানতে চাইলো, একটা ফোন করা যাবে নাকি। সে চীনে তার বাবাকে ফোন লাগাবে। চীনের চেং দ্যু অঞ্চলের এক অজ পাড়াগাঁয়ের মোড়ল তার বাপ। চোলাই মদ খাবার বদ অভ্যাস আছে। শেন জ্যোর ভয় হয়, চোলাই মদের মাত্রা ছাড়ানো মিথানল গিলে তার বাবা একদিন পটল তুলে ফেলবে। ফিসফিসিয়ে কথাগুলো বলে সে ঝুপ করে গির্জার বেঞ্চে বসে পড়ে সত্যি সত্যি চীনে ফোনে লাগিয়ে চ্যাং চোং করে কি সব বলা শুরু করল। মৃত্যুর ক্ষমতাই আলাদা। সুযোগ পেলেই মনের শংকার ডঙ্কা ঢং ঢং পিটিয়ে ছাড়ে।

এদিকে গির্জায় দাঁড়িয়ে সামান্য অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তিটা হাত নিয়ে। না চাইতেও হাতদুটো মোনাজাত ধরে ফেলতে চাইছে। বাকিরা দু’পাশে হাত রেখে এ্যাটেনশন। শেষ মেষ সংকোচটা ঝেড়ে আনুবীক্ষনিক একটা মোনাজাত ধরে সুরা আউড়ে গেলাম বাকিটা সময়।

আধা ঘন্টা পর গির্জার আলো আঁধারি থেকে বেরিয়ে চোখ ঝলসে গেল মাঝ দুপুরের কড়া রোদে। এখানেই শেষ না। বরং কবরস্থান বরাবর আমাদের যাত্রার শুরু। মিছিলটা নিঃশব্দে এগোলো বসন্তের একটা দুটো কচি পাতাকে সাক্ষী রেখে। পায়ে পায়ে যান্ত্রিক চলছি আর ভাবছি, কি অদ্ভূত মানবজীবন। ঠুশ্ করে এক সময় ফুরিয়ে যায়। অথচ শীত শেষে যদি আবার বসন্ত দিয়ে জীবন শুরু করা যেতে যদি। আহা! এমন একটা বৃক্ষজীবন হলে মন্দ হত না।

পাদ্রি সাহেব ত্রিশূলের মত কি যেন একটা ধরে রেখে হাঁটছে দলের সবার সামনে। তার জমকালো আলখাল্লা আর মাথার পাগড়ীটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি। এই প্রথম এদেশে কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আসা। কোথায় ভেবে রেখেছিলাম একবার না একবার এদের কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাবো। আর ভাগ্যে ছিল ফিউনারেল!

আমাদের দলটা কেন যেন মাঝপথে থামলো। সামনের ক’জন একটা কফিন উঠিয়ে নিলো ছোট্ট একটা বেদির মতন জায়গা থেকে। মেহগনি রঙা কাঠের কফিন সোনালি রোদে শেষবারের মত ঝিকিয়ে উঠছে। নিজের অজান্তেই বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল ইনগ্রিডের জন্যে।

চমৎকার বাগানটা দেখে কে বলবে এটা গোরস্থান। বারোমাসি কয়েক ধরনের ফুলের রাজত্বে গেল শীতের কোন ছাপ নেই। আরো কতগুলো মৌসুমী ফুল তার কুঁড়ি মেলতে ব্যস্ত। পাখিদের কিচির মিচিরে চারিদিক জীবন্ত, উচ্ছল। ইনগ্রিডকে আমরা তার মাঝে যত্ন করে নামিয়ে দিলাম।

মুঠোয় মুঠোয় মাটি পড়লো মেহগনি কফিনে। তফাতে দাঁড়িয়ে সম্মোহিতের মত দেখলাম। জীবন-মৃত্যুর মাঝে আসলে মাত্র এক হাইফেন ফারাক। তবুও আরেকটা দীর্ঘশ্বাস জোর করে বেরিয়ে যেতে চাইলে তাকে খামচে ধরে রেখে দিলাম। ফিরে গিয়ে কাজে মন বসাতে হবে। চোয়াল শক্ত করে তাই পা বাড়ালাম ফিরতি পথে।

-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
গবেষকঃ ইন্সটিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি
২১.০৩.২০

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

Leave a Reply