জার্মান জীবনের সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং এবং কঠিন সময় কাটে, প্রথম ২ সপ্তাহ। তখন মাথায় থাকে প্রিয়জনের জন্য ভালবাসা, বুক ভরা ইমোশন, নতুন দেশের নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো সহ আরও হাজারো নতুন নতুন ইস্যু। সবচেয়ে বড় সমস্যা থাকে, টাকা পয়সা। কারণ শুরুতেই আতিক্কা খরচের একটা বিশাল  ধাক্কা সামলাতে হয়। কিন্তু পকেটের টাকার এমাউন্ট থাকে লিমিটেড। তাই সবকিছু তাল বেতাল হয়ে পড়ে।

এরকম শত শত সমস্যার সম্মুখীন আপনাকে হতেই হবে। কোন উপায় নাই। যুগ যুগ ধরে, হাজারো বাঙ্গাল এই সকল সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বীরদর্পে বেরিয়ে আসছে। তাই চিন্তার কিছু নাই। যত মুশকিল, তত আসান।

আসার পরেই, কি করব না করব, এই নিয়ে ব্যাপক পেড়ার সম্মুখীন হতে হয়। কেউ বলে উত্তরে যাও, কেউ বলে দক্ষিনে। তাই, এই লেখায় একটা জেনারেলাইজড দিকনির্দেশনা দিলাম। তবে আবারো একটা কথা, সিটি টু সিটি কিছু ব্যাপার আলাদা হতে পারে, বাট বেসিক সেইম।

দেশ থেকেই কিছু প্রস্তুতিঃ

  • জার্মানীতে আসার পরে প্রথমেই যেহেতু টাকা পয়সা নিয়ে ভালই সমস্যায় পড়তে হয়, সেহেতু কিছু ক্যাশ সাথে করে নিয়ে আসা ভাল। কারণ ডয়েচে ব্যাঙ্কের একাউন্ট এক্টিভেট হতে প্রায় ১-২ সপ্তাহ টাইম লাগে। আর মেইনলি প্রথম ২ সপ্তাহের মধ্যেই টাকা পয়সার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী হয়। কারণ প্রথমেই এনরোলমেন্ট ফি, ট্রান্সপোর্টেশান ফি, বাসা ভাড়া, বাসার এডভান্স, নতুন বাসার জন্য কেনাকাটা সহ বিশাল খরচের ব্যাপার আছে। তাই ব্যাক আপ রাখা ভাল। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, হ্যান্ড ক্যাশ হিসেবে কত টাকা আনা উচিৎ। আইডিয়ালি ১০০০-১৫০০ ইউরো আনা উচিৎ। বাট সবকিছুই ডিপেন্ডস অন ইউর কস্ট। কারণ আপনি যদি লাকিলি মিউনিখে একটা বাসা পান, আর বাসা ভাড়া যদি ৪০০ ইউরো হয়, তাহলে ১৫০০ ইউরোতে কিছুই হবে না। কারণ ২ মাসের এডভান্স সহ, প্রথমদিনেই বাড়িওয়ালাকে ১২০০ ইউরো দিয়ে দিতে হবে। তাই একটা রাফ এস্টিমেশান করেই টাকাটা আনবেন।
  • এয়ারপোর্ট থেকে আপনার ফাইনাল ডেস্টিনেশানে কিভাবে যেতে হবে, এই ব্যাপারে হোমওয়ার্ক করে নেবেন। দরকার হলে, কাগজে লিখে রাখবেন অথবা মোবাইলে বিস্তারিত স্ক্রীন শট নিয়ে রাখবেন। যদি পারেন, আপনার ইউনিভার্সিটি অথবা সিটির কোন ভাইয়া/আপুকে, এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করার জন্য রিকোয়স্ট করতে পারেন। দরকার হলে, কুরবানীর দেশী গরুর মাংস খাওয়ানোর ব্যাপারে প্রমিস করতে পারেন। :p বিশ্বাস করেন, এই আশ্বাস, নিশ্চিতভাবে কাজে দিবে। (একটা গোপন টিপস। জার্মানীতে দেশী খাওয়াদাওয়া খাওয়ানোর ব্যাপারে আশ্বাস দিলে, যে কেউ, যে কোন কাজে হেল্প করার জন্য রাজী হয়ে যাবে। এটা পরীক্ষিত সত্য)। এক্ষেত্রে কস্ট অনেকটাই কমে যাবে। আর একদম-ই বাঙ্গালী কাউকে না পেলে, ইন্টারন্যাশনাল অফিসের শরনাপন্ন হবেন। তারা আশা করি, এয়ারপোর্ট ট্রান্সফারের একটা ব্যাবস্থা করে দিতে পারবে।
  • টুকটাক, ২-৪ লাইন ডয়েচ শিখে আসা ভাল। না পারলেও সমস্যা নাই। কিন্তু ঠেকায় পড়ে, কাজ চালানোর জন্য ২-৪ লাইন শিখে আসলে খুব-ই কাজে দেয়।
  • অবশ্যই বাসা/টেম্পোরারি থাকার যায়গা ঠিক করে আসবেন। অনেকেই এয়ারপোর্টে/রেলস্টেশানে বসে কান্নাকাটি করে, “আমার বাসা নাই, আমার বাসা নাই।” এই সকল ক্ষেত্র অনেক সময়, ইচ্ছে থাকা সত্তেও সাহায্য করার উপায় থাকে না।  তাই আগে ভাবে যোগাযোগ করে বাসা ম্যানেজ করে নেয়া ভাল। যদি কিছুই না পাওয়া যায়, তাহলে অন্তত হোস্টেল/হোটেল বুকিং দিয়ে আসা ভাল, যাতে একটা মাথা গোজার ঠাই থাকে।

 

টাকা মানে টাকা আর ইউরো মানে ইউরোঃ
টাকা হচ্ছে বাংলাদেশের টাকা। আর ইউরো ইউরোপের মুদ্রা। কোন কিছু খরচ করার সময় ৯০ দিয়ে গুন করে, বাংলা টাকায় কনভার্ট করার অভ্যাস বাদ দিতে হবে। একটা ডোনারের দাম ৩০০-৪০০ টাকা আর ম্যাকডনাল্ডসে বার্গারের দাম ৪০০-৫০০ টাকা  হিসেব করে চলার অভ্যাস যদি থেকে যায়, তাহলে আমার মত অনাহারে থেকেই দিন কাটাতে হবে, প্রথম কয়েক মাস। তাই, প্রথমেই এই কনভার্শানের বদ অভ্যাস বাদ দিতে হবে।

 

মোবাইল সিমঃ

জার্মানীতে মোবাইল ইন্টারনেট ছাড়া নিজেকে পুরো এতিম এতিম লাগে। অন্যদের কথা জানি না, কিন্তু আমার কাছে মোবাইল ইন্টারনেট ছাড়া নিজেকে পুরা অসহায় মনে হয়। আর প্রথমদিকে যেহেতু কিছুই জানাশোনা থাকে না, তাই মোবাইল ইন্টারনেট টা খুব-ই জরুরী। কারণ জিপিএস, ছোট খাট ইনফোর্মেশান, সবকিছুর ক্ষেত্রে মোবাইল-ই প্রধান ভরসা। আবার, অনেকের বাসায় প্রথম দিকে ইন্টারনেট কানেকশান থাকে না। কানেকশান থাকলেও, ল্যান ক্যাবল/রাউটারের অভাবে ইন্টারনেট ব্যাবহার করা সম্ভব হয় না। তাই, তাদের জন্য একটা মোবাইল সিম অতি গুরুত্তবপূর্ন।
কোন সিম নেয়া উচিৎ, এই ব্যাপারে নিচের আর্টিকেলে বিস্তারিত বলা আছে। তবে বলা বাহুল্য, প্রথমেই কোন কন্ট্রাক্টের সিম নেয়ার দরকার নাই। এতে ২ বছরের জন্য একদম কারেন্ট জালে ফেসে যাবেন, যেখান থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন সুযোগ নাই। 

সিম সমস্যার সমাধান

আর সিম কেনার পরে, অবশ্যই রেজিস্ট্রেশান করতে ভুলবেন না। না হলে সিম জীবনেও চালু হবে না।

 

বাসা খোজা/নতুন বাসায় ওঠাঃ

আপনি যদি আগে থেকেই বাসা পেয়ে যান, তাহলে তো আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি না পান, তাহলে অনবরত Studentenwerk/প্রাইভেট ডর্ম গুলোতে নক দিতে থাকেন। যতক্ষন পর্যন্ত, ওরা আপনার উপর বিরক্ত না হবে, ততক্ষন পর্যন্ত গুতাতে থাকেন। কারণ এই ছাড়া কোন উপায় নাই। আর একদম-ই বাসা না পেলে, কারো সাথে শেয়ারিং/সাবলেট/ইয়োথ হোস্টেলে উঠে পড়ুন এবং চেস্টা চালিয়ে যান। নিচের আর্টিকেলে আরও কিছু টিপস আছে। পড়ে নিতে পারেন।

কিভাবে খুঁজে পাব “ভাল-বাসা”

আর যারা দেশে থাকতেই বাসার কন্ট্রাক্ট বা কনফার্মেশান পেয়ে গেছেন, তারা তো কেল্লা ফতে। নগদে ওদের অফিসে গিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করে ফেলুন। আর বাসায় উঠে পড়ুন। তবে বাসা বুঝে নেয়ার সময়, বাসার সব জিনিসপাতি ঠিক আছে কিনা, তা অবশ্যই দেখে নেবেন। নাহলে পরে আপনাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা গুনতে হতে পারে।

 

ব্যাঙ্ক একাউন্ট এক্টিভেশানঃ

আপনি দেশে থাকার সময় যে ব্যাঙ্কে ব্লক একাউন্ট খুলেছিলেন, সে-ই ব্যাঙ্কের নিকটস্থ ব্রাঞ্চে যোগাযোগ করুন। ওরা আপনার একাউন্ট এক্টিভেট করার জন্য ব্যাবস্থা করে দেবে। সাথে ওরা একটা ঠিকানা জানতে চাইবে, যেখানে আপনার ব্যাঙ্ক কার্ড/পিন কোড সহ যাবতীয় ডকুমেন্ট পাঠাবে। তাই, ঠিকানাটা সঠিকভাবে দেবেন। যদি আপনার নিজস্ব বাসা না থাকে/আপনি ইয়োথ হোস্টেলে থাকেন, তাহলে পরিচিত এবং বিশ্বস্ত কারো ঠিকানা দিতে পারেন। কারণ এই ইনফোর্মেশান গুলো খুব সেন্সেটিভ। তাই অজানা লোকের এড্রেস না দেয়াই ভাল।

 

হেলথ ইন্সুরেন্সঃ

AOK/TK/Private heath insurance এর অফিসে গিয়ে আপনার ইন্সুরেন্স করিয়ে নিন। এটা ১০-১৫ মিনিটের কাজ। অনেকেই অনলাইনে , আগে থেকেই হেলথ ইন্সুরেন্স এর রেজিস্ট্রেশান করে রাখে। তারা শুধু ওদের অফিসে গিয়ে, কনফার্মেশান লেটার টা নিয়ে আসলেই হবে।

বেশীরভাগ ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসেই হেলথ ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর বুথ খুলে বসে। এক্ষেত্রে, অফিসে যাওয়ার ঝামেলাও নাই। তবে হেলথ ইন্সুরেন্স করার পরে, অবশ্যই কনফার্মেশান লেটার টা নিতে ভুলবেন না। এটা ছাড়া অনেক ইউনিভার্সিটি-ই এনরোলমেন্ট করতে দেয় না।

আর হেলথ ইন্সুরেন্স AOK/TK তে করা ভাল। বিদেশের বাড়িতে কোন অসুখ বিসুখ হলে, দেখার মত কেউ-ই নাই। তাই সিকিউর্ড থাকা ভাল। AOK/TK দুইটার ফেসিলিটি-ই সেইম। যে কোন একটা চুজ করতে পারেন।

 

ইউনিভার্সিটি এনরোলমেন্টঃ
এরপরে ইউনিভার্সিটির এনরোল্মেন্টটা সেরে ফেলুন। কারণ, এনরোল্মেন্ট ছাড়া আপনি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টিকেট কিনতে পারবেন না। তাই, এটা খুব-ই জরুরী। অনেক সময় এনরোল্মেন্ট এর সময় অরিজিনাল সার্টিফিকেট, ট্রান্সক্রিপ্ট শো করতে হয়। তাই এগুলো সাথে রাখুন। আর এনরোলমেন্ট ফি দিতে ভুলবেন না।

 

পাবলিক ট্রান্সপোর্টের টিকেটঃ

অনেক সময় এনরোলমেন্ট ফি-টাই, পাবলিক ট্রান্সপোর্টের খরচটা কাভার করে। আর কিছু সিটিতে আলাদা করে টিকেট কিনতে হয়। এই ব্যাপার টা ক্লিয়ার হয়ে নেবেন। আর আপনার সিটি যদি একদম-ই ছোট হয়, তাহলে সাইকেল দিয়েও চালিয়ে দিতে পারেন। পলিউশান ফ্রি। প্লাস একটু এক্সারসাইজ ও হবে। 😉

 

সিটি রেজিস্ট্রেশানঃ

আপনি জার্মানীর যেই শহরের-ই বাসিন্দা হোন না কেন, আপনাকে অবশ্যই সিটি রেজিস্ট্রেশান করতে হবে। এটা ছাড়া ভিসা বাড়ানো/চাকুরী-বাকুরী, কিছুই করতে পারবেন না।

সিটি রেজিস্ট্রেশানের জন্য কিছু কিছু শহরে, বাসার কন্ট্রাক্ট দেখাতে হয়। আবার কিছু শহরে কিছুই লাগে না। তাই ব্যাপারটা শহরের মুরুব্বীদের থেকে জেনে নেবেন।

জার্মানী আসার পরে অবশ্য করণীয় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কাজসমূহ: after your

এই বেসিক কাজ গুলো করে ফেললেই, আপনি মোটামুটি প্রথম ধাক্কাটা সামলে ফেলতে পারবেন। সাথে নতুন বাসার জন্য বেসিক জিনিসপাতি কেনাকাটা করে নিতে পারেন। এখানে কিছু সাইটের নাম দেয়া আছে, যেখানে বাসার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই পাওয়া যায়। আর এদের নিকটস্থ ব্রাঞ্চও অনলাইনে দেখে নিতে পারেন।

http://www.ikea.com/de/de/

http://www.ikea.com/de/de/

https://www.poco.de/

এছাড়া আরও অনেক লোকাল দোকানপাট আছে, যারা বালিশ-তোষক থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কিছু-ই বিক্রয় করে।

আর সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস কিনতে চাইলে, নিচের সাইটে ডু মারতে পারেন। এছাড়া ফেইসবুকে অনেকগুলো শহরভিক্তিক গ্রুপ আছে, যেখানে সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস পত্র বিক্রি করে থাকে।

https://www.ebay-kleinanzeigen.de/

http://www.quoka.de/

 

এইসব প্রাইমারী কাজ শেষ করার পরে, আস্তে ধীরে ভিসা বাড়ানো সহ বাকী কাজ গুলো করবেন। আর নো তাড়াহুড়া। 🙂

 

নতুন জীবন সুখের হোক এবং কম প্যাড়াদায়ক হোক, এই কামনা করি। 🙂

mm

By Tousif Bin Alam

এখনঃ Master of Science in Power Engineering, Technical University Of Munich, Germany. আগে: Islamic University of Technology এবং Govt. Hazi Mohammad Mohsin College, Chittagong.

4 thoughts on “মাত্র পৌঁছালাম জার্মানীতে, এখন আমি কী করব?”
  1. তৌসিফ বিন আলম ভাই, আপনার লেখা অত্যন্ত ভালো লাগে আমার। সবগুলো লেখাই মনে হয় পড়েছি। পড়ার সময় মনে হয় যে বিষয়গুলো যেন আমার চোখের সামনেই ঘটছে। ……

    ভালো থাকবেন। এগিয়ে যান।

Leave a Reply