১৭ই জুলাই, ২০১৫। দিনটা হতে পারতো আর দশটা সাধারন জার্মান দিনের মতই। তবে দিনটা এ্সেছেই নিজেকে ব্যতিক্রম করার জন্যে। খুব সকালে আমি গোসল করতে পছন্দ করি না। কিন্তু ওইদিন ভোর ৭ টাতেই আমি শাওয়ারের নিচে। কারন!!! দিনটা এ্সেছেই যে নিজেকে ব্যতিক্রম করার জন্যে। শাওয়ারের নিচে দাঁড়ানোর পরে প্রথম যে কথা মনে পড়ল তা হচ্ছে এইভাবে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে কখনও এই দিনটি শুরু করা হয়নি, বরং সবসময়ই দাদীবাড়িতে কাজিনদের সঙ্গে পুকুরে লাফ দিয়ে দিনটি শুরু করেছি। বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পুকুরের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে শাওয়ারেই কাজ চালিয়ে নিলাম। রুমে ফিরে পাঞ্জাবী পড়ে সোজা মসজিদের দিকে যাত্রা।

আমি যখন মসজিদে পৌছালাম তখন বন্ধু-পরিচিতদের মধ্যে আর কেউ আসেনি। তবে একেএকে সব আসতে শুরু করল একটু পরেই। বেশ লম্বা বয়ান শেষে নির্ধারীত সময়ের অনেক পরে হুজুর শুরু করলেন কাংখীত নামাজ। নামাজ শেষে ডানে, বামে, সামনে, পেছোনে যাকেই পাই তাকেই জাপ্টে ধরে কোলাকুলি আর সেই সঙ্গে “ঈদ মোবারাক” বলা শুরু করলাম। কারন!!! সেদিন ছিলো ঈদূল ফিতার ২০১৫। এরপরে মসজিদের ভেতরেই বাঙ্গালি পাকিস্তানিরা মিলে কিছুক্ষন ফটোসেশেন করে মসজিদ থেকে বের হতে গিয়ে দেখি নানা রকম খাবারের বিশাল সমাহার। কি আর করার, ওনারা এতো কষ্ট করে আয়জোন যেহেতু করছেন খেতে তো হবেই 😉 খেয়েটেয়ে যাত্রা শুরু করলাম গুকেলসবার্গ ভনহাইমের উদ্দেশ্যে। শাফায়েত ভাই ওখানে থাকেন, উনি ভনহাইমের কমন কিচেনটা ভাড়া নিয়েছেন পুরোদিনের জন্যে। আমাদের প্ল্যান সবাই মিলে রান্নাবাড়া করে দুপুরে একসঙ্গে খেয়ে প্রবাসের ঈদ উদযাপন করা। কিচেন দেখে তো পুরা মাথা খারাপ। একে কিচেনটা ছাদে, ভনহাইমটা পাহাড়ের চূড়ায় হওয়ায় ভিউটা অসাধারন সুন্দর, বেশ কিছু বিচ চেয়ার অসাধারন্তের মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপরে কিচেনটা নিজেও বিশাল, আর হাড়িপাতিল থেকে শুরু করে যাবতীয় সব ধরনের সাহায্যকারী যন্ত্রপাতি দিয়ে ভর্তি। রান্না শুরুর আগেই দেখে মন ভালো হয়ে গেল।

মেইন বাবুর্চি নাথদা আর সালমান ভাই আসার পরে শুভ্র ভাই শুরু করলেন পেয়াজ, রসুন, আদার জামাকাপড় উন্মোচন, আর আমি স্ট্যাব মিক্সার দিয়ে ওদের ওপর নির্যাতন। শাফায়েত ভাই ব্যাস্ত হয়ে পরলেন পানি সরবারহের কাজে। আমাদের ইভেন্ট ম্যানেজার হাসান আসলো আরো ৩০ মিনিট পরে। ওকে দিয়েও কিছু তো একটা করাতে হবে, তাই ও আর আশিক ভাইকে দায়িত্ত দেওয়া হলো আমাদের বিনোদিত করার জন্যে গানের ব্যাবস্থা করতে। বেশ হইচই করে আমাদের রান্না চলতে থাকলো দুপুরের পর পর্যন্ত। এর মধ্যে দুপুরে আমাদের দলে যোগ দিলেন অঞ্জল ভাই আর হাসিব ভাই। ৪ টার দিকে অবশেষে শেষ হল নাথ দা এর পোলাও, ইলিশ ভাজা, চিংরী মাছের দোপেয়াজা, সালমান ভাই এর মুরগির রোস্ট, ল্যাম্ব ভুনা, সালাদ, আমার খিচুরী আর সাম্বাল সস। খেতে বসে মনে হল যেন আমি না, কোনো একটা রাক্ষস আমার প্লেট থেকে খাচ্ছে, আর খাওয়ার পরে মনে হল ক্রেনটা যেনো কোথায়? অবাক হলাম হাসান যখন বলল সব মিলিয়ে খরচ জনপ্রতি মাত্র ৫ ইউরো, তখন মনে হতে লাগলো একটা রেস্টুরেন্ট দিতে পারলে আমাদের কোটিপতি হওয়া ঠেকায় কে। এরপরে ৮ টা পর্জন্ত চলল তুখোড় আড্ডা, আড্ডা শেষ করে বাসার দিকে রওনা হলাম।

বাসায় ফিরে মনে হলো বেশ ভাল একটা দিন গেলো, বিশেষ করে আমার প্রবাস জীবন যেখানে মাত্র ৩ মাস, সেই হিসাবে ভয়াবহ রকম ভালো একটা ঈদ। কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হযে বসলাম ফেসবুক নিয়ে। ঝামেলার শুরু এখান থেকেই। বাংলাদেশে যেহেতু পরদিন ঈদ মানে ১৮ তারিখে, তাই ওয়ালে একে একে ভেসে আসতে লাগলো সবার ঈদ প্রস্তুতিমূলক স্ট্যাটাস। কাজিনরা দাদীবাড়িতে, স্কুল ফ্রেন্ড্রা সব ফরিদপুরে, এগুলো যত দেখতে থাকলাম তত মনে হতে লাগলো আমিওতো আজকে ওখানে থাকতে পারতাম, আর ততই মন খারাপ হতে থাকলো। এই সময় এক ফ্রেঞ্চ ফ্রেন্ড আমার মন খারাপের বিষয়টা জানতে পেরে জিজ্ঞেশ করলো আমি বের হব কিনা বা ওরা আসবে কিনা। চিন্তা করে দেখলাম আমাকে যেহেতু আরো ২ বছর থাকতে হবে তাই সমধান আমার নিজেরই করা উচিত। ওকে মানা করে দিলাম। এর পরে নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলতে বসলাম। প্রায় ১০ মিনিট কথপোকথনের পরে নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হলাম মন খারাপ করে আসলে পরিস্থিথির কোনো উন্নতি হবেনা। দীর্ঘ চাকরী জীবনের কল্যানে ঠিক এমন না হলেও এর থেকে বাজে সময় পার করেছি। সেই সময় গুলোর কথা চিন্তা করলাম, সেই সময়গুলোর বিরুদ্ধে যেহেতু জয় পেয়েছি তাহলে এখন কেন নয়? আর মানুশ হিসেবে যেহেতু জন্মেছি সামনে এমন দিন আরো আসবে, তাই আজকে হার মানা যাবেনা। এইসব চিন্তা করতে করতে দেখলাম মন খারাপ ভাবটা কেটে গেছে। রাত ২ঃ৩০ টা পর্যন্ত যেগে থাকলাম আম্মুর সঙ্গে কথা বলার জন্যে। আম্মুর সঙ্গে ঈদ সুভেচ্ছা বিনিময় করে অবশেষে রাত ৩ টায় ঘুমাতে গেলাম।

ঘুম দিয়েই ঈদ টা শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু হইতে হইতেও হইলা না শেষের মতই আমার ঈদও শেষ না হযে ১৮ তারিখেও চলতে থাকলো। কারন ওইদিন যে বাংলাদেশে ঈদ। ঘুম থেকে উঠে আপুদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম কিন্তু ৩ এবং ৪ বছর বয়েসের ভাগ্নেরা  ব্যাপক ব্যাস্ত থাকায় তাদের সময় পাওয়া আর গেলো না। এরপরে একেএকে বাকি আত্মীয় সজন, বন্ধু বান্ধব্দের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করলাম। এর পরে ফেসবুকে বসলাম। ঈদের স্ট্যাটাস, ছবিতে হোম পেজ ভর্তি, কিন্তু আগের দিনের অ্যান্টিডোটের কারনে এদিন আর একদমই খারাপ লাগেনি। সন্ধায় কন্সার্টে যাওয়ার জন্যে বাসা থেকে বের হলাম। বের হওয়ার সময় পাঞ্জাবী টা পরে নিলাম। উদ্দেশ্য মূলত ২ টা। এক, বাংলাদেশের ঈদের সঙ্গে একাত্ততা প্রকাশ করা, দুই, আমার ফরাসী বান্ধবীদেরকে বাংলাদেশী ঐতীয্যবাহী পোশাখের সঙ্গে পরিচ্য় করিয়ে দেওয়া। ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে জানতে পারলাম ওইদিন ফ্রান্সের নৎসের (আমার ফ্রেন্ডগুলোও ওখনেই পড়ে) খুব পু্রোনো এবং বিখ্যাত একটা ব্যান্ড পার্ফরম করবে যারা কিনা ওই এলাকার ঐতীয্যবাহী গান গায়। আমার যেই ফ্রেন্ডের বাড়িও নৎসে সে আমাকে বলল, দেখ আজকে একদিকে তুমি তোমার ঐতীয্যবাহী পোশাক পড়ে এসেছো আর এক দিকে আমার এলাকার ঐতীয্যবাহী গান হবে, ব্যাপারটা মজার না? যাইহোক, অবশেষে গান শুরু হল। আমাকে আগে থেকে ব্রীফ করার পরেও প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম। ৬০/৬৫ বছরের সাদা চুলের তরুনদের মঞ্ছে লাফাতে দেখলে, একই সঙ্গে ৩ জেনারেশন কে মাতাতে দেখলে, যে কেউই ধাক্কা খাবে। ১১ঃ৩০ টা পর্যন্ত ডুবে থাকলাম এই ৬০/৬৫ বছরের তরুনদের মাঝে। এরপরে ৩ টা পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে ৩ঃ১৫ তে বাসায় ফেরার মাধ্যমে শেষ হল আমার ২ দিন ব্যাপী প্রবাস জীবনের প্রথম ঈদ উদযাপন।

mm

By Munshi Arif Rashid

জন্ম বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহর ফরিদপুরে, শৈশব-কৈশোর সেখানেই। জন্মেছি সাংবাদিক মুনশী হারুন-অর-রশীদ ও আফরোজা রাশীদ দম্পতির পরিবারে বড় দুই বোন জিতা ও তানিমের পরে। SSC ২০০২ সালে, এরপরে ঢাকা আসা, উদ্দেশ্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনিস্টিটুটে কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে পড়ালেখা। ২০০৬ সালে যখন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হল জ্ঞান কতোটুকু অর্জিত হয়েছে জানিনা তবে অসম্ভব কাছের কিছু বন্ধু অর্জন করতে পেরেছি। কিছুদিন MGH Group এ চাকরী করার পর bracNet এর চট্টগ্রাম অফিস এ যোগদান। এই সময় চট্টগ্রামে থাকা চার বছর আমার জীবনের সোনালি সময়। Southern University তে Electornics & Communication Engineering এ B.Sc করার সময় আজব কিছু ছেলের সঙ্গে পরিচয়। মজা করতে করতে কখন যে ওদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হল বুঝতে পারিনি। B.Sc শেষ করার পরে UITS এ MBA, সেখানেও কিভাবে কিভাবে যেন বেশ কিছু কাছের বন্ধু জুটে গেল। ২০১০ সালের শেষে মাছরাঙা টেলিভিশন থেকে যখন ডাক পেলাম আবারো ঢাকায় ফিরে এলাম। মাছরাঙা টেলিভিশন এর তথ্য প্রযুক্তি বিভাগে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করেছি স্কয়ার গ্রুপের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে। শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি মসৃণ ই ছিল, কিন্তু নিজের মনেই ভয় ছিল শীর্ষ পদে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার মত বিদ্যার কিছুটা ঘাটতি আছে, তাই অনেক কঠিন হলেও ২ বছরের জন্যে সব ছেড়ে জার্মানি আসার সিদ্ধান্ত নেই। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজিতে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছি।

Leave a Reply