বার্লিন
২৫ জুলাই, ২০১৫

ভাষা হল প্রাকৃতিক Cryptography- code word না জানলে সব জগাখিচুড়ি মনে হবে। উপলব্ধিটা আরও গাঢ় হল যখন ট্রানজিট এ ফ্লাইট বদলে প্যারিসগামী বিমানে উঠে বিমানবালার অভ্যর্থনাসূচক কথাবার্তা শুনছিলাম। আরবি, ফরাসি আর ইংরেজি তে বলল। ছোটবেলায় মাদ্রাসাতে গিয়েছি, কলেজের আগ পর্যন্ত স্কুলে কোরআন-হাদিস এর আয়াত পড়া আর পরীক্ষায় ভালো নম্বর এর আশায় একটু আধটু আরবি লেখা শেখা পর্যন্তই শেষ। শিক্ষিত-মূর্খ টাইপ। পড়তে পারবা, লিখতে পারবা কিন্তু কিছুই বুঝবা না। যখন “শুকরান” শুনলাম বুঝে নিলাম আরবি তে বলা শেষ। এরপর ফরাসি শুরু হল- আবার খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। বোধ করি কিছু কমিয়ে বলেনি! টিভি, সিনেমাতে ফরাসি যতটুকু শুনেছি তাতে কোনবার ও একটা শব্দ শুনে তার মানে সুরাহা করতে পারিনি; এবারো পারলাম না। কি দুর্বোধ্য রে বাবা। এটা নাকি আবার Romance Language এর কাতারে পরে, কিন্তু কি করে? এত দুর্বোধ্য ভাষায় ভাব বিনিময় হয় নাকি? ইতালিয়ান আর পর্তুগিজ তাও মানা যায়, কেমন একটা সুমধুর ছন্দ – শুনতে মন্দ না। স্প্যানিশ কখনো ভালো লাগেনি কানে। মেয়েদের মুখ থেকে শুনলে মনে হয় ঝগড়া করছে, কর্কশ কিছিমের কিঞ্চিত। প্রেম- ভালোবাসা তেমন একটা করা হয়নি তাই Romance Langugage নিয়েও ঘাটাঘাটি করিনি। তবে ভাষার ব্যাপারে কৌতূহল কাজ করত।

বাংলা বলি বিনা বাছবিচারে, ইংরেজি বলি ভয়ে ভয়ে- পাছে English রা ভুল ধরে। উর্দু-হিন্দি আগ্রহ করে কেউ শেখে বলে মনে হয়না। শুনতে শুনতে গায়েন হতে হয়। ছোটবেলায় ছুটির দিনে বাসায় চাচাত ভাইবোনেরা VCR এ হিন্দি সিনেমা দেখত মাঝে মাঝে। কিছু বুঝতে পারতাম না – তাকিয়ে থাকতাম। এরপর cousin রা শুরু করল সাংকেতিক কথাবার্তা। বাংলা’র সাথে দু একটা বর্ণ ওলট পালট করে কেমন করে যেন বলত- ছোট ছিলাম বলে বুঝতে দিত না। হলো না শেখা। যাই হোক, ব্যাচেলর শেষ করে প্রায় বেকার বসে আছি, স্কুলজীবন থেকে চেনা এক বন্ধু ঢাকা ভার্সিটি’র Modern Language Institute এ ফরাসি কোর্সে ভর্তি হবে। একা একা করতে চাইল না- আমাকেও শুরু করতে বলল। বেশি টাকা লাগবেনা দেখে ভর্তি হয়ে গেলাম। হাতে গোণা অল্প কয়েকজন আমাদের বয়সী- বাকিরা প্রবীণ না হয় মধ্যবয়সী। ক্লাস নিতেন শিশির ভট্টাচার্য স্যার। বেশ মজা করে কথা বলতেন, প্যারিসে পড়াশুনা করেছেন- ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সেখানকার গল্প করতেন। একবার বলেছিলেন ওইখানে নাকি পত্রিকা বিনা পয়সায় পায় সবাই। অবাক হয়েছিলাম। দুই তিনটা ক্লাস করে ফরাসি’র দস্যিপনার কিনারা করতে পারছিলাম না। সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রোযা শুরু হয়ে গেল। আমি থাকি বসুন্ধরায়, ফাল্গুন বাসে করে যেতাম ক্লাস করতে। ক্লাস ছিল দুঘণ্টার কিন্তু আসা-যাওয়াতে চলে যেত তিন ঘণ্টার উপরে। তো চার পাঁচটা ক্লাসের পরে আমি আর গেলাম না। ধরে নিলাম এবার ফরাসি ও আমার রাশিতে নেই। সেটা ২০১০ কি ১১ এর কথা।

২০১৩ তে যখন ফ্রান্স এর স্কলারশিপ হয়ে গেল তখন আফসোস করলাম- কেন তখন ক্লাসগুলো করলাম না। শুনেছি ফরাসিরা ভাষা’র ব্যাপারে বেশ একগুঁয়ে, English জানলেও বলবে না। প্রথমদিন, Charles de Gaulle এয়ারপোর্ট পৌঁছেছি, checked baggage নেবার জন্য carousel এর কাছে দাঁড়িয়ে আছি। দেখি কারো ব্যাগ আসার নাম নাই। এর মধ্যে কি একটা announcement হল, কিছুই ধরতে পারলাম না। ব্যাচধারী মতন একজন কে ইংরেজি তে জিজ্ঞেস করলাম- স্বভাবতই জবাব মিলল ফরাসি তে। তাকে ইংরেজি তে বলতে বললাম- উনি বললেন ” This is France”. বাকিটা যেভাবে বললেন তাতে নিজের দুর্বল ইংরেজি এর ভয়টা কমে গেল খানিকটা। প্যারিস পৌঁছালেও ঘণ্টা খানেক পরে ইতালি যাবার কথা। তাই ফরাসি ভাষার সাথে ভালভাবে পরিচয় হবার আগে ইতালিয়ান শুনতে হল পরের দশদিন। রপ্ত করতে পেরেছিলামঃ Gratzie, Prego, Boungiorno পর্যন্ত। দিন দশেক পরে ফ্রান্স ফিরে face করতে হল আসল challenge. যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ সারতে হবে french এ। বারবার মনে হচ্ছিল হয় English রা, না হয় French রা কেন দুনিয়াটা collonised করল না। French রা গোটা আফ্রিকা দখল করে ফরাসি এর রশি তাদের গলায় বেঁধে দিয়েছে। তাতে অবশ্য আফ্রিকার হাজার খানেক ভাষা’র বদলে এদের নিজেদের মধ্যে একটা common ভাষা হয়েছে কথাবার্তা বলার জন্য। কানাডা ‘র Québec , ল্যাটিন আমেরিকার ডজন খানেক দ্বীপ, প্যাসিফিক এর প্র্যত্যন্ত অঞ্চলেও এখন French বলে। এসব তো আর এমনি এমনি হয়নি, কলোনি কালে এরা অনেক অত্যাচার করেছে ভাষা রপ্ত করার জন্য। পাকিস্তান হয়ত এদের দ্বারা উদ্ভুদ্ধ হয়েছিল ‘ ৫২ তে।

মাস্টার্স শুরু করলাম Sorbonne IV ভার্সিটি তে- একদম প্যারিসের প্রাণকেন্দ্রে Notre Dame Cathedral এর পাশে। আমার প্রোগ্রাম পুরোটা English এ থাকলে ভার্সিটি থেকে ফ্রি ফ্রেঞ্চ কোর্স করতে দিল। একেবারে ফাউন্ডেশন কোর্স – ক্লাসের সবাই আমার প্রোগ্রামেরই। চাইনিজ, পাকিস্তানি, ইথিওপিয়ান, সুইডিশ, রাশিয়ান । Madame Isabelle: ক্লাসের প্রথমদিন ঢুকে সাফ বলে দিলেন যে ওই আধা ঘণ্টাই শেষ বারের মত তিনি English এ কথা বলবেন, এর পর যেন কেউ কখনো ওই ক্লাসে ইংলিশ না বলে এমনকি ইমেইল ও না লিখে তাকে। ক্লাসের সবাই মুখ চাওয়া চাওই করল। তবে Madame কিন্তু ওই আধা ঘণ্টা চমৎকার ইংরেজি বললেন, উনি ইংল্যান্ড এ ছিলেন বছরখানেক। এভাবে চলতে থাকল পরের দুই সেমিস্টার। আস্তে আস্তে আমি উনার কথা বুঝতে শুরু করলাম। কিন্তু ক্লাসরুমের বাইরে বের হলে আর কারো কথা বুঝতাম না। এমনকি মেট্রো তে যে স্টপ গুলার নাম বলত সেগুলো পর্যন্ত! কি করে বুঝব? স্টেশনের নেমপ্লেট এ লেখা নামের বানানের সাথে বলা নামের কোন মিল খুঁজে পেতাম না। ফ্রেঞ্চ ভাষা টা এমন ই। Latin থেকে এলেও phonetically বিশাল ফারাক। বিবর্তনে এখনকার যে ফ্রেঞ্চ লিখিত রূপ তা aristocrat দের ঠিক ক করে দেয়া বানান রীতি অনুযায়ী। তারা ল্যাটিন সমীহ করত বলে ওই বানান রীতি ধরে রাখতে চাইল কিন্তু বলার বেলায় আলসেমি করে প্রতিটা শব্দের এক- তৃতীয়াংশ গায়েব হয়ে গেল। ছোট একটা উদাহরণ, Mont Blanc এর উচ্চারণ মোঃব্ল! কি করে বুঝবেন বলুন!

এরপর থেকে কান খাড়া রাখতাম বাইরে বেরুলেই, লোকে কোনটাকে কি বলে তা বোঝার জন্য। বুঝলাম ল্যাঙ্গুয়েজ বই পরে আমি ফ্রেঞ্চ শিখতে পারব না। শুনে শুনে আয়ত্ত করা যায় যতটুকু। ব্যাপারটা কাজে লাগল ঠিকই ই কিন্তু লেখার উন্নতি আর হল না। ক্লাস টেস্টে madame বললেন , আমি বুঝতে পারি ভালো কিন্তু বানান ভুল করছি আর তাতে অর্থ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। এক ক্লাসমেট আমাজন থেকে ফ্রেঞ্চ শেখার বই কিনল – ইংলিশ এ সেটা । কোন লাভ হল না তার; হাফ ছেড়ে দিল। একটা ব্যাপার দেখেছি বিদেশি ভাষা আসলে নিজের মাতৃভাষা’র সাথে সম্পৃক্ত করে শেখা সহজ। আমাদের জন্য আরও সহজ। বাংলা তে অনেক ভাষার মিশেল আছে আর আমাদের স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণ দিয়ে অনেক স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করা যায়। যেটা অনেক ভাষা তে নেই। এই জন্য চাইনিজ/ জাপানিজ/ কোরিয়ান এইধরনের ভাষাভাষী রা “R” এর ইংলিশ উচ্চারণে হিমশিম খায়। তেমনি Arabic এবং আফ্রিকান ভাষা ভাষীদের কাছে “T” এর উচ্চারণ দুরহ। আমাদের বর্ণমালায় এক “T” এর কাছাকাছি উচ্চারনের জন্য আছে “ট/ত/ৎ” অথবা ত্ব।

এভাবে মাস চারেক পার হল। ততদিনে একটা পার্টটাইম কাজ খোঁজা ফরয হয়ে পড়ল। কিন্তু ভাষা না জানলে বেবি সিটিং হোক আর পিৎজা ডেলিভারি হোক, কোন কাজ পাওয়া যাবে না। Google Translator দিয়ে কোনমতে একটা আবেদন পত্র আর CV বানিয়ে ম্যাডাম কে দিয়ে ঠিক করিয়ে নিমাল। কিছুদিন পর এক ফোন এলো, এক ফাস্ট ফুড রেস্ট্যুরেন্ট থেকে। ফোন করে তারা ইন্টার্ভিউ এর দিন আর সময় বলতে লাগল। মুশকিল হল সপ্তাহের দিনগুলো বুঝতে পারলে ও সময়টা ঠিকক ধরতে পারলাম না। চট করে পাশের রুম থেকে ফ্লাটমেট কে ফোনে ধরিয়ে দিলাম। ও জার্মান কিন্তু ফ্রেঞ্চ জানতো। ইন্টার্ভিউ এর দিন কি হবে সেটা নিয়ে আর চিন্তা করলাম না। যা হবার হবে।

সেদিন সকালে ক্লাস বাদ দিয়ে ইন্টারভিউ দিতে গেলাম। ওরা ফ্রেঞ্চ এ জিজ্ঞেস করছে, আমি যা বুঝতে পারছি তার জবাব ইংলিশ এ দিচ্ছি। এক সময় জিগ্যেস করল আমি ফ্রেঞ্চ শিখছি কিনা- বললাম কোর্স করছি। ভাগ্য সহায় ছিল, সপ্তাহ দুয়েক পরে contract sign করার জন্য ডাকল। কাজের জায়গাতে সবাই ফ্রেঞ্চ বলবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে কিছু কিছু দিন দু এক জন কলিগ ছিল যারা নিজেরা ইংলিশ শেখার আশায় ইংলিশ বলত্। এক কলিগ ছিল মারিউস- অনর্গল ইংলিশ , স্প্যানিশ আর ফ্রেঞ্চ বলত। বড্ড হিংসা লাগত। আর একজনকে চিনতাম U.S Exchange Programme কালীন সময় থেকে। ঊরসুলিনা- সুইয্যারলান্ড এর। সুইস দের একটা সুবিধা; জাতীয় ভাষা ৪ টা। জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান আর রোমানইশ; তার উপরে সবাই ভালো ইংলিশ বলে। উরসুলিনা সব গুলা পারত। কি চমৎকার গুণ। বাড়তি ভাষা জানার সুবিধা অনেক, অনেক সংস্কৃতির সাহিত্যের স্বাদ নেয়া যায়। অনেক সাইন্টিফিক জার্নাল পড়া যায়। বিশেষ করে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রাশিয়ান দের technological advancement রপ্ত করতে গেলে। চাইনিজ, জাপানিজ কোরীয় দের গুলা তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে!

প্যারিস এর রাস্তাঘাটে অনেক উদ্যেশ্যহীন ভাবে হেঁটে বেরিয়েছি। দেখেছি টং এর মত দোকান করে বই বিক্রি করে; নতুন পুরান হাজার কিসিমের বই। আফসোস করে গেছি, একটা বই ও পড়তে পারলাম না। বোধহয় ভার্সিটি’র লাইব্রেরি আর “Shakespeare and Company” এর দোকান বাদে অন্য কোথাও ইংলিশ বই দেখা যাবে। দরকার ই বা কি? Métro তে ওঠার আগে স্টেশন থেকে ফ্রি খবরের কাগজ হাতে নিয়ে নিতাম। ওই কাগজগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো সারমর্ম করে লেখা থাকতো যাতে চলতি পথেই সবাই সব খবরের একটা হাইলাইটস পায়, সময়ও বাঁচে!
মাঝে মাঝে সাথে থাকা বিদেশি ক্লাসমেটরা মশকরা করত যে আমি পত্রিকা নিয়ে পড়ার ভান করছি। আসলে ভান করার তো কিছু নেই, চেনা খবরগুলো পত্রিকাতে পরে বোঝার চেষ্টা করতাম। একটা ব্যাপার দেখেছি ফ্রেঞ্চ রা প্রচুর বই পরে পথে ঘাটে। যেখানেই যাক একটা বই থাকে- পেপারব্যাক! ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ইউরোপের অন্য শহরের মেট্রোতে এতোটা পড়ুয়া চোখে পরে না। তাদের দেখা যায় হয় মোবাইলে গেইম খেলে না হয় চ্যাট করে। আর আমাদের দিকের লোকজন কথা বলে! ঘরের হোক আর বাইরের হোক সব কথা যেন বাসে ট্রেনেই বলতে হবে!

২০০৮ সালের আগস্ট এর দিকে সাউথ কোরিয়া গিয়েছিলাম। অনেকটা মজা করার জন্য অরগানিজার রা দুদিন ধরে ভাষা শেখানোর চেষ্টা করল। এশিয়ান ভাষা, এতো সহজে শেখা যায় নাকি? script শিখতেই সাল পার হয়ে যাবে। ২১ টা স্বরবর্ণ ! তবু সেই দুদিনের কোর্স থেকে হাতে গোণা তিন চারটা phrase মনে আছে। কোরিয়ান কারো সাথে দেখা হলে বলি- বেশ খুশি হয়।

বছরখানেক থাকলাম ফ্রান্স এ। দেখতে দেখতে আর শুনতে শুনতে যা শিখেছি তাতেই খুশি। অন্তত শুনলে বুঝি কিছুটা আর টুকটাক কথাবার্তা। এখন বার্লিন আছি। শহরটা বেশ মাল্টিকালচারাল হওয়াতে ইংলিশ দিয়ে টিকে আছি এখনো। তবে জার্মান এর সাথে বাংলা এর কয়েকটা শব্দের আশ্চর্য রকমের মিল। যেমনঃ Bahn=বাহন , Ni= না , Meisterei= মিস্ত্রি (কোন কাজে পটু ), Aber= আবার , Achso! = আচ্ছা!

বলা মুশকিল হাজার মাইল দুর থেকেও এতো যোগাযোগ কি করে হল । জার্মানরা তো আমাদের উপমহাদেশে ঔপনিবেশ করেনি কখনো। তাহলে কি করে এলো? হয়ত ভেসে ভেসে … ভাষা ভাসমান §§

mm

By Khan Reaz

এখনঃ Chief Technology Officer, Mouse Potato (February 7, 2015 to present). থাকিঃ Berlin, Germany. পড়েছিঃ Technische Universität Berlin, ICT Innovation · Berlin, Germany (EIT ICT Labs Master School student).