কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামানের একটা গল্প পড়েছিলাম বহু আগে। গল্পটা এমনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে, এদিকে বিশ্বকাপ ফুটবলও আসছে। পরীক্ষার কারণে খেলা দেখার উপায় নাই ছাত্রদের। শিক্ষকদের কাছে পরীক্ষা পেছানোর বহু দেনদরবার করেও লাভ হলো না। পরিশেষে উপায়ন্তর না দেখে কতিপয় ছাত্র মিলে এক ভয়ংকর পরিকল্পনা করলো। তারা বেছে বেছে এক নিরীহ ছাত্রকে হত্যা করলো। পরিণতিতে পরীক্ষা গেলো পিছিয়ে,  বিশ্ববিদ্যালয় গেলো বন্ধ হয়ে। সবাই মিলে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে মনের আনন্দে খেলা উপভোগ করতে সক্ষম হলো।

এই গল্পের সাথে আজকের বাংলাদেশের কোন মিল নেই, তবু সোনা দিয়ে গড়া এক তরুণের অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুতে এই গল্পটি মনে পড়ে গেল। এই নির্মম ঘটনায় আরও মনে পড়ে যায় পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন প্রদেশের ওয়ালী খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ বছর বয়সী মাশাল খানের কথা, যাকে তাঁরই সহপাঠীরা ২০১৭ সালের ১৩ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে লাঠি-বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল ধর্ম নিয়ে ভিন্নমতের কারণে। 

আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল-রশিদ (৭৮৬-৮০৯) এর মত ছাত্রলীগ  নিজেদের “পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া” মনে করে। খলিফা রাজ্যে ঘোরাঘুরি করতেন দুই পাশে দুই জল্লাদ নিয়ে এটা বোঝানোর জন্য যে যেকোন সময় যেকারো প্রাণহরণ করার ক্ষমতা তার আছে। ক্ষমতার দম্ভ আর সীমাহীন লালসা ছাত্রলীগকে আজ জল্লাদে পরিণত করেছে। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহের পর হুমায়ুন আহমেদ লিখেছিলেন, সাপের পেটে সাপ জন্মায়, বনের হিংস্র বাঘের গর্ভে বাঘ, মানুষই একমাত্র প্রাণি যারা মানব ও দানব উভয়ের জন্ম দেয়। ছাত্রলীগের সবাই নয়, কেউ কেউ মানুষের গর্ভে জন্ম নেয়া দানব। ছাত্রলীগ আজ পৃথিবীর একটি অন্যতম সন্ত্রাসী সংগঠন। বহু জঙ্গি সংগঠনের মত এদেরও নিষিদ্ধ করার সময় বহু আগেই পার হয়ে গেছে। তারা মনুষ্যবর্জিত পুঁতিগন্ধময় বিষ্ঠায় পরিণত হয়েছে। রাস্তার বেওয়ারিশ কুকুরের মত নিজেরা কামড়া কামড়ি করে মরার মধ্যে এতদিন এদের কৃতকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল। আবরারের কোমল পিঠ থেঁতলে দেওয়ার মাধ্যমে আজ হতে ভিন্নমত প্রকাশকারীদের স্তব্ধ করার সংস্কৃতি শুরু করলো। ঢাকায় আমি আর আমার বড় ভাই একসাথে মেসে থাকতাম। আমার ভীতিকর কাব্যপ্রতিভা দেখে ভাই আমার নাম দিল হিমনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। এতকাল বাদে আজ আমি আবার দু’লাইনের কবিতা লিখেছি, তামাম সৌরজগতে যে কবিতা কেউ কোনকালে লেখেনি, কেউ শোনেনি। আপনাদের শোনাইঃ
ছাত্রলীগ পরিচয় পেলেই গণপিটুনি শুরু হতে আর কত দেরি, হে পাঞ্জেরি! 


ইংরেজদের তৈলমর্দন করে বিপুল বিত্তের মালিক হওয়া কিছু বাঙ্গালি “বাবু” উপাধি পেয়েছিল উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বঙ্কিম বাবু তাদের নিয়ে কটাক্ষ করে লিখেছিলেন, “…এরা উপার্জনের জন্য বিদ্যা শিক্ষা করে এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য প্রশ্নপত্র চুরি করে। এদের বল হস্তে এক গুন, মুখে দশ গুন, পিঠে শতগুণ এবং কার্যকালে এরা অদৃশ্য।  এদের বুদ্ধি বাল্যে বইয়ের পাতায়, যৌবনে বোতলের মধ্যে, বার্ধক্যে গৃহিনীর আঁচলে। এরা বহুরূপী, মিশনারির কাছে এরা খৃস্টান, কেশব সেনের কাছে ব্রাহ্ম, পিতার কাছে হিন্দু, ব্রাহ্মণের কাছে নাস্তিক। বাড়িতে এরা জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান আর মুনিবের কাছে গলাধাক্কা খান।” আমার আজকের প্রশ্ন সম্মানিত পাঠকের কাছে, এর কোন কথাটা আজকের ছাত্রনেতাদের বেলায় খাটে না?

তবে শুধু ছাত্রনেতাদের বেলাতেই নয়, পুরো বাংলাদেশের মানুষদেরই এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। কীভাবে ভিন্নমত সহ্য করতে হয়, আমার ধর্ম বা রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে কঠোর সমালোচনাকারীকেও কি করে সম্মান করতে হয়, সুযোগ থাকা স্বত্বেও কি করে চুরি না করে থাকা যায়, নারীদের সমানাধিকার নিশ্চিত ও সম্মান কিভাবে করা যায়, সকল লিঙ্গের, সকল মতের, সকল ধর্মের, সকল বিশ্বাসের মানুষকে নিয়ে একই সমাজে কিভাবে বাস করা যায় শান্তির সাথে, সেই শিক্ষা প্রতিটি বাঙ্গালির নেওয়া জরুরি।

নোবেলজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটা উপন্যাসের নাম “আমার দুঃখভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা”। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের বয়স যেদিন নব্বই পূর্ণ হল সেদিন তিনি বেশ্যালয়ে ফোন করে তেরো বছর বয়সী একটা কুমারী মেয়ে চাইলেন। মেয়েটির নাম দেলগাদিনা যে ওই বৃদ্ধের শয্যায় শুধু উপর হয়ে শুয়ে থাকত আর কখনো কোন কথাই বলত না। বৃদ্ধ আজ অব্দি যত বেশ্যার সাথে শুয়েছে তার মধ্যে ৫১৪ জনের কথা ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। বাংলাদেশের সরকার যদি হয় ওই বৃদ্ধ, তাহলে এই ৫১৪ জন হল ছাত্রলীগ। যাদের একটার পর একটা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দিবে সরকার। সরকার না চাইলেও তাই এই “মেধাবী” খুনিদের তাদের ধরতেই হবে। জনগণ যদি সজাগ থাকে তাহলে তাদের বিচার করতেও তারা বাধ্য হবে।      

এখন বাংলাদেশের মানুষ এই বেশ্যাদের কী করে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, কী করে সমাজ হতে তাদের সমূলে উৎপাটন করতে পারে? পথ একটাই, রাশিয়ান কবি পুশকিনের মত ডুয়েল খেলতে হবে। পুশকিন একটা উপন্যাস লিখলেন “ইউগেন অনেগিন” নামে। ত্রিভুজপ্রেমের কাহিনী। নায়ক অনেগিন আর তার বন্ধু লেনস্কি উভয়ে ভালবাসে উর্বশী তাতিয়ানাকে। এখন উপায়? সেকালে রাশিয়াতে ডুয়েল খেলা খুব চলে। ডুয়েল খেলা হল দুইজন দুইজনের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করবে। যে গুলি খাবে সে মরবে, যে খাবে না সে বেঁচে থাকল।
তাতিয়ানার প্রেমপ্রার্থী উভয়ে মিলে ডুয়েল খেলার সিদ্ধান্ত নিল। লেনস্কি মারা গেল। বেঁচে থাকল  অনেগিন। পুশকিন আসলে উপন্যাস লেখেনি, নিজের ভাগ্য নিজে লিখেছিলেন। কারণ বাস্তবে তাঁর নিজের জীবনেও একই ঘটনা ঘটেছিল। পুশকিনের স্ত্রী নাটালিয়ার সাথে পরকীয়া ছিল ফরাসি সৈনিক হেকারেনের সাথে। ফলস্বরূপ পুশকিন আর হেকারেনের মাঝে ডুয়েল হল। ১৮৩৭ সালের জানুয়ারির ২৯ তারিখে কনকনে শীতের দিনে গুলি খেয়ে মারা গেলেন রাশিয়ার ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি পুশকিন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৭।

বাংলাদেশ যদি আমাদের মা হয় তাহলে ওই ছাত্রলীগ হল সেই মায়ের ধর্ষণকারী। বাংলাদেশের সন্তান হিসেবে ওই ধর্ষণকারীদের সাথে ডুয়েল খেলতে হবে আমাদের। দুর্ভাগ্যের পরিহাসে পুশকিনের পরাজয় ঘটলেও বাংলাদেশের মানুষদের জিততেই হবে। 


১২ অক্টোবর ২০১৯ 
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply