(প্রথম পর্বের পর) যুদ্ধে আহত হয়ে হিটলার ফ্রান্সের সমে নদীর তীর থেকে ফিরে আসেন জার্মানিতে। বৃটেনের গ্যাস আক্রমণে অন্ধ হয়ে যাওয়া হিটলার আশ্চর্য্যজনকভাবে তখনো দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাচ্ছে না। চিকিৎসকরা অবাক। এরই মাঝে বিখ্যাত মনোবিদ এডমুন্ড ফরস্টার হিটলারের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়ে খেয়াল করলেন হিটলারের এই অন্ধত্ব চোখের কোন সমস্যা নয়, এটা অনেকটাই মনস্তাত্বিক। হিটলার ধরে নিয়েছিল সে অন্ধ হয়ে গেছে। এটা মস্তিষ্কে এমনভাবে গেঁথে গিয়েছিল যে অন্ধ না হয়েও সাময়িক সময়ের জন্য তাকে দৃষ্টিহীন থাকতে হয়েছে। এডমুন্ড ভেবে দেখলেন হিটলারের ভেতরের অহংবোধকে জাগ্রত করে এই অন্ধত্ব কাটাতে হবে। তিনি হিটলারকে বুঝাতে চাইলেন যে, হিটলার অন্য সবার মত সাধারণ মানুষ নয়, সে বিশেষ কিছু এবং তার দ্বারাই এই জার্মানির মুক্তি আসবে। মনোবিদের এই কথা হিটলার হৃদয়ে ধারণ করলেন, তিনি বিশ্বাস করতে আরম্ভ করলেন তিনিই ভবিষ্যৎ জার্মানির ত্রাতা। দেরিতে হলেও তিনি পুরোপুরি দেখতে শুরু করেন। বিখ্যাত টুথব্রাশ মার্কা গোঁফ রাখা শুরু করেন এ সময়টাতেই। 

দৃষ্টি ফিরে পেয়ে হাসপাতালে বসেই তিনি শুনলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির আত্মসমর্পন তথা পরাজয়ের কথা। এটা ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসের কথা। সেই স্মৃতিচারণ করে হিটলার লিখেছিলেন, “আমি যেন আবার অন্ধ হয়ে গেলাম। দিন আর রাতের মাঝে আর তফাৎ রইল না। এই অন্ধকার সময়ের ভেতরেই পরাজয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে আমার ভেতর নতুন করে জেগে উঠল ঘৃণা। হাসপাতালের নিঃসঙ্গ সময়েই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম জার্মানিকে মুক্ত করতে, আবারো জার্মানিকে মহান করতে।”   

২৮ জুন ১৯১৯, বসন্তের আগুন বাতাসে চারিদিক ঝলমল করছে। প্যারিসের অদূরে ভার্সাইলস প্যালেসের রাজকীয় প্রাসাদে প্রতাপী দেশের যুদ্ধজয়ী রাষ্ট্রপ্রধানরাসহ বাইরেও  গমগম করছে মানুষে। কাকতালীয়ভাবে ঠিক পাঁচ বছর আগে ১৯১৪ সালের এই দিনেই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ফানৎস ফার্দিনান্দকে হত্যা করা হয়, যে ঘটনাটিই মূলত পৃথিবীকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যায়। এই গত পাঁচ বছরে প্রায় দুই কোটি মানুষ মারা গেছে, পৃথিবীতে শুধু যুদ্ধ আর ধ্বংসচিহ্ন। সেই যুদ্ধেরও প্রায় সাত মাস পেরিয়ে গেছে। জার্মানির চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে। জয়ীরা মিলে মধ্যযুগে নির্মিত ওই প্রাসাদে বসেছে জার্মানিকে কী করে শায়েস্তা করা যায় সেই সিদ্ধান্ত নিতে। যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানরা মিলে জার্মানির সাথে শান্তি চুক্তি (ট্রিটি অব ভার্সাই) করলো।

চুক্তির দিনে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড লয়েড জর্জ, ইতালির ভিট্টোরিও অরল্যান্ডো, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী জর্জেস ক্ল্যামেনকু এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানির পরাজয় যখন প্রায় নিশ্চিত তখন কে কার উপর দোষ চাপাবে তাই নিয়ে শেষ প্রুশিয়ান রাজা ভিলহেলম দ্বিতীয়, আর্মি এবং জার্মানির রাজনৈতিক দল এই তিনটি গ্রুপের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ শুরু হয়। জেনারেলদের চাপে রাজা ভিলহেলম দ্বিতীয়কে সিংহাসন ছেড়ে নেদারল্যান্ডসে নির্বাসনে যেতে হয়। সেখানে থেকেই তিনি ১৯৪১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত তিনি জার্মানিতে ফিরে আবার সিংহাসন ফিরে পেতে তদবির করতে থাকেন। এমনকি তিরিশের দশকে যখন ঘটনাক্রমে হিটলার ক্ষমতায়, তখনো সাবেক এই রাজা ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী বহুবার আবেদন করেছে। কিন্তু যে হিটলার প্রথম মহাযুদ্ধের পরাজয়ের কারণ হিসেবে নির্বাসিত রাজাকেও অনেকটা দায়ী করেন তাঁকে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানোর কোন কারণ ছিল না। তবে হিটলার শুধু রাজাকেই পরাজয়ের জন্য দায়ী করতেন না, বরং জার্মান সমাজের উঁচুস্তরে থাকা ইহুদি ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসীদেরও দায়ী করতেন। সশরীরে অংশ নেওয়া প্রথম মহাযুদ্ধের জয়ী দেশগুলো মিলে যে চুক্তি করে জার্মানির সাথে, যা ভার্সাই শান্তিচুক্তি নামে অধিক পরিচিত, যাতে জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী দেশ হিসেবে পরিগণিত করা হয়।

ভার্সাই চুক্তি

কী ছিল সেই চুক্তিতে? প্রথমত, এই চুক্তি অনুসারে জার্মানির সীমানা পরিবর্তন হয়ে যায়। ফ্রান্স, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্ককে ফিরিয়ে দেওয়া হয় সীমান্তবর্তী বহু এলাকা। চীন, প্রশান্ত মহাসাগর এবং আফ্রিকায় অবস্থিত সকল জার্মান কলোনিসমূহ বৃটেন, ফ্রান্স, জাপান এবং অন্যান্য মিত্রশক্তিরা মিলে বগলদাবা করে নেয়। ফলে, ভূমি হারানোর পাশাপাশি জার্মানি হারায় এর অধিভুক্ত দশ শতাংশ জনসংখ্যাও। এছাড়া কোনধরনের অস্ত্র তৈরির সাথে জার্মানি যুক্ত হতে পারবে না বলেও শর্ত দেওয়া হয়। সবশেষে, জার্মানিকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় এবং মিত্রশক্তির অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহে সংঘটিত জীবন, অর্থ ও অবকাঠামোগত সকল ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী করা হয়। ৩১.৪ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ বাবদ ধরা হয়, আজকের বাজারে যার মূল্য ৪৪২ বিলিয়ন ডলার। প্যারিসে এই শান্তিচুক্তিতে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ ডেলিগেট অর্থনীতিবিদ জন মেইনার্ড এই চুক্তিকে অত্যন্ত কঠোর বলে অভিহিত করেন। তিনি মনে করেন জার্মানির প্রতি সুবিচার করা হয়নি। অপরদিকে ফরাসি জেনারেল ফার্দিনান্দ ফখ বলেন এই চুক্তিতে জার্মানিকে কোন সাজাই দেওয়া হল না। মিত্রপক্ষ এই চুক্তিকে যেভাবেই নিক, জার্মানরা এই চুক্তিকে শুধুমাত্র নিজেদের বিশাল ক্ষতির কারণ হিসেবেই দেখেনি বরং জাতি হিসেবে তারা এটিকে অপমানের চুক্তি বলেই মনে করতে শুরু করে শুরু থেকেই। এই অপমান জার্মান জাতি মেনে নিতে পারেনি। পরাজয়ের গ্লানি থেকেই ধীরে ধীরে হিটলারের মাঝে কমিউনিস্ট ও ইহুদীদের প্রতি ঘৃণা জন্মাতে শুরু করে। তিনি  সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর পরেই সে জার্মান ওয়ার্কাস পার্টি- যার পরবর্তী নাম নাৎসি পার্টি- তে যোগ দিয়ে নিজের উগ্র জাতীয়তাবাদী, ইহুদীবিরোধী আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শুরু করে।     

চুক্তির বিরুদ্ধে জার্মানদের প্রতিবাদ

হিটলার মেঠো বক্তৃতায় উপস্থিত জনগণকে কি করে উত্তেজিত করে প্রভাবিত করা যায় তার উপায় খুব ভাল জানতেন। তিনি কথা বলতেন ভারী মেজাজে উচ্চঃস্বরে। কথা বলতে বলতে তিনি বিশেষ অঙ্গভঙ্গিমা করতে, কাঁপতেন, আর একই সাথে তার অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠত ঘৃণা আর জিঘাংসা। এই বিশেষ বক্তৃতাগুণ আর দলের আদর্শ বাস্তবায়নে তীব্র আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিটলারকে অতি দ্রুত দলের উঁচু পদে আসীন করে। হিটলারকে দলের প্রচার ও প্রসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সময়টাতেও তিনি মিউনিখেই আছেন। দলের নতুন সদস্য হিসেবে এত দ্রুত এত উত্থান দলের অনেককে ইর্ষাকাতর করে তোলে। এর মাঝে দলের প্রতিষ্ঠাতা এনটন ড্রেক্সলার যিনি হিটলারের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা ও দলের মাঝে গ্রহণযোগ্যতার কারণে ভীত হয় সাবগ্রুপ তৈরি করেন। এটা ১৯২১ সালের জুন মাসের কথা যখন হিটলার দলের প্রচারের কাজে বার্লিনের অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের সাথে সাক্ষাত করতে এসেছিলেন। ড্রেক্সলারের এই কাজ দেখে হিটলার আত্মবিশ্বাসের সাথে দল থেকে পদত্যাগ করে এবং একমাত্র তখনই সে ফিরে আসে যখন দলে তার একক কর্তৃত্ব নিশ্চিত হয়। 

ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯

আগের পর্বগুলো পড়তে ক্লিক করুনঃ
পর্ব ১ঃ গ্লানি থেকে ঘৃণা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে জার্মান প্রবাসের এই ধারাবাহিক আয়োজন নিয়ে আপনার কোন মতামত বা পরামর্শ আমাদের জানাতে পারেন এখানেঃ [email protected]

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply