এক সকালে উঠেই দেখি পায়ের পেশীতে টান ধরে গেছে। মনে মনে হাসলাম। এই আমিই নাকি মাসখানেক এর মাঝে ম্যারাথন দৌড়ানোর মতলব আঁটছি। এক দান কুতকুতও ঠিক মত খেলতে পারতাম না ছোটবেলায়। হাঁপাতে হাঁপাতে হাপুস হুপুস অবস্থা হতো। সেই চিজ কিনা দিবে একুশ কিলোমিটারের হাফ ম্যারাথন! পরিচিত কয়েকজন বাঙ্গালী ছেলেপেলে সামনে ষ্টাডলাউফ ম্যুনশেন -মানে মিউনিখ ম্যারাথনে নামছে। ওদের কাছ থেকে শুনেই একদিন ফট্ করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ভাবলাম কি আছে দুনিয়ায়। দেই একখান দৌড়। জীবনটাই তো একটা ইঁদুর দৌড়। আর বাঙ্গালীর মেয়ে নিশাত মজুমদার, ওয়াসিফা নাজরীনরা এখন এভারেস্ট টুপটাপ ডিঙ্গিয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলেছে; আর সেই তুলনায় আধঘন্টার একটা ঢিমে তালের কচ্ছপ দৌড় তো রীতমত ফুঃ। কিন্তু উচ্চমার্গীয় চিন্তার ফাঁদে পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়া এক বস্তু আর সেই মত কাজ করা আরেক ব্যাপার। তাছাড়া আসল কথা, আমি চরম অলস প্রকৃতির মানুষ। আলসেমির কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা থাকলে আমি চোখ বুজে দেশের জন্যে সোনা নিয়ে ফিরতাম। ”আঁন্ধার কালো” পত্রিকার খেলার পাতায় ছাপা হত “স্পেনের বার্সিলোনায় আয়োজিত ত্রয়োদশ আন্তর্জাতিক আলস্য প্রতিযোগিতার মাছি মারা বিভাগে বাংলাদেশের বিরল সাফল্য!!” সাথে থাকতো আমার নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার আর মেডেল কামড়ে ধরে থাকা বোকাটে অপ্রস্তুত হাসির ছবি।Image result for to run is life
যাইহোক, এক শনিবার সকালে সেই আমিই কিনা আমার কুখ্যাত ঘরকুনো স্বভাব গা ঝড়া দিয়ে ফেলে স্পোর্টস ট্রাউজার আর টি-শার্ট গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এদিককার লোকজন বোধহয় বাদামী চামড়াদের দৌড়ঝাপ করতে কম দেখে। কেমন একটু সন্দিহান ভাব চোখেমুখে। কিন্তু এত গ্রাহ্য করলে কি চলে? কচ্ছপগতি কমালাম না। ঘরের সামনেই বিরাট গোরস্থান। সাথে লাগোয়া ছোট্ট একটু পার্ক আর পার্কের মাঝে দিয়ে বয়ে যাওয়া এক চিলতে পানির স্রোত। কাছেই ইজার নদী। কে জানে হয়তো তার থেকেই আসছে এই পানি। বেশ লাগলো। প্রায় এক ঘন্টার মত দৌড়বাজি করে ঘরের কাছের সুপারমার্কেটটার সামনে দিয়ে আসছি, তখন দেখি গনি মিয়া বাস থেকে নামছে। আমাকে দেখেই ছেলেমানুষের মত হাত নাড়তে থাকলো। গনি মিয়া এই দোকানের ক্যাশিয়ার। তার দোকানে গেলেই সে খুব মজা করে চোখ টিপে একটা হাসি দিবে আর আমিও আমার ভাঙ্গা জার্মানে বলবো, কি গনি, আছো কেমন? উত্তরে সে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায় আর তার হাসি আরো প্রশস্ত হয়। এই হুতুমপ্যাঁচাদের দেশে এক-দুইটা হাসি মুখ দেখলে মন্দ লাগে না।
batman running GIF
দিন বয়ে চলে। আজকে এক মাসের উপর হতে চললো আর দৌড়াতে বেরোই না। ওই সেই পুরোনো রোগ, আলসেমি। ছুটির দিনে এক বারোটায় ঘুমাই তো পরদিন চরম বেলা করে উঠি। ভাবছি কাল থেকে আবার শুরু করলে কেমন হয়? গ্রীষ্মকাল, এখন তো সূর্য ডোবে রাত করে। কাজ থেকে ফিরে এসে অনায়েসে এক ঘন্টা ঘুরে আসা যায়। দেখা যাক কদ্দুর কথা রাখতে পারি…।
এর পরে কেটে গেল শুধু মাস না, বরং গোটা একটা বছর। মাঝে হয়তো একদিন দৌড়ালাম তো দুইমাস আলাব্বু দিয়ে বসে থাকলাম। এভাবেই চলে যেতে থাকল অলস দিন, মাস, বছর। হঠাৎ এক শুক্রবার সন্ধ্যা। তিন বছরের তাফসীরকে নিয়ে ব্যস্ত বিকেল। এর মাঝে ফোনের ক্রিং ক্রিং। ফোনটা রুমির। ছেলের বাবা অফিস থেকে ফোন করে খবর দিলো যে, হাদী ভাই হাঙ্গেরী থেকে ফিরে সোজা আমাদের বাসায় আসবেন। রাতে এখানে খাবেন। হাঙ্গেরী থেকে ফিরে উনি নাকি বড়ই হাঙ্গরি। হাদী ভাই হচ্ছে গিয়ে রুমির বুয়েটের বড় ভাই। ক্ষ্যাপাটে মজার মানুষ। হাসি-ঠাট্টায় আড্ডা মাতিয়ে রাখেন। বহু বছর বিখ্যাত ইনফিনিয়ন কোম্পানির হয়ে অস্ট্রিয়ায় কাজ করেছেন। সবে বদলি হয়ে মিউনিখে এসেছেন। কাজের খাতিরে প্রায়ই বিজনেস ট্রিপে আশেপাশের দেশগুলোতে যেতে হয়। যাহোক, ওনাকে নিয়ে রুমি যথাসময়ে বাসায় এসে হাজির। ওদিকে আমার প্যারাবয়েল্ড চালের খিচুড়ি তখনও হয়ে সারে নি। সময় কাটানোর জন্যে আমরা আড্ডা জুড়ে দিলাম। খেলাধুলা-সাইক্লিং এসবে আবার হাদী ভাইয়ের বিরাট উৎসাহ। এই প্রসঙ্গ আসতেই রুমিকে আর আমাকে ক্যাঁক করে ধরলেন। সামনে মিউনিখ ম্যারাথন। আমরা দুইজন দৌড়াব কিনা জিজ্ঞেস করলেন।
parks and recreation running GIF
আমি মনে মনে ফিকফিক করে হাসছি আর ভাবছি আর লোক পেলেন না, আমাদেরকেই! হাদী ভাই বলেই চলছেন, রিম, তুমি তো কারাতে-টারাতে করতে এককালে, তো এবার একটা একুশ কিলোমিটার একটা দৌড় দিয়ে দেখাও দেখি। এবার আমি সশব্দে ঢোঁক গিললাম। সেই একুশ কিলো ম্যারাথনের ভুত আবার ফিরে এসেছে। চোখের কোনা দিয়ে দেখলাম, রুমি হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিয়েছে খিচুড়ীর হাল-হকিকত দেখতে। দৌড়ানো-টৌড়ানো তার পোষায় না। মৃদু-মন্দ প্রশ্রয়ে হালকা উঁকি দেয়া সুখ-সুখ ভুঁড়িটাই বলে দিচ্ছে একথা। কিন্তু হাদী ভাই নাছোরবান্দা লোক। এদিকে আমিও পেশেদার আলসে। কাঁচাবাজারের আলু-পটল দরদামের সুরে বলেই চলছি যে, একুশ না, বড়জোর পাঁচ কিমি দৌড়াতে পারি। তাও পারবো কিনা ঠিক বলা যাচ্ছে না। উনি বললেন, আরে পাঁচ কিমি তো এখনই পারবে…না, না, তোমাকে দশ কিমিই পারতে হবে। মিনিটখানেক তর্কাতর্কির পর দেখা গেল আমি দশ কিমিতে একরকম নিমরাজি হয়ে গিয়েছি। এর মানে আসলে আমি পাঁচ কিমি দৌড়াবো। হাদী ভাই আমাকে ঠিক চেনেন নি। পরের দৃশ্য হল, সবার হাতে খিচুড়ীর থালা। তাতে বেগুন ভাজার মাঝ থেকে ভিয়েতনামিজ দোকান থেকে কেনা নধর বাগদা চিংড়ি ওরফে বাংলাদেশী ব্ল্যাক টাইগার উঁকি দিচ্ছে। ম্যারাথন বলে কথা। অনেক পরিশ্রমের কাজ। তাই আদা-জল খেয়েই মাঠে নামা উচিত। আপাতত, খিচুড়ী-চিংড়িই আমার আদা-জল।
অবাক ব্যাপার হল, পরদিন থেকে আবার আমি খুব আগ্রহের সাথে দৌড়ানো শুরু করে দিলাম। সপ্তাহে তিন-চার দিন করে। কখনো তাফসীর মিয়াকে বিকালে ক্রিপে থেকে তুলতে চলে যাই এক দৌড়ে। হাঁটার বদলে দৌড়। একেবারে লেতুপেতু ছোট ছানাপোনা থেকে শুরু করে তিন বছরের বাচ্চাদের ডে-কেয়ারকে এখানে বলা হয় ক্রিপে। আর তিন থেকে ছয় হয়ে যাওয়া মুরুব্বীদের জন্যে কিন্ডারগার্টেন। যাহোক, আবার কখনো রুমি অফিস থেকে ফিরল তাফসীরকে তার কাছে গছিয়ে বেরিয়ে যাই। দৌড়ের পোশাক আর কটকটে ম্যাজেন্টা-গোলাপি কেডস পরে আগেই তৈরি থাকি। রুমি ঘরে ঢুকলেই আমি ফুরুত করে উড়ুত। আর সপ্তাহান্তে দৌড়াতে চলে যাই প্রিয় ইজার নদীর পাড়ে। বাসা থেকে মাত্র দশ মিনিট দূরে। সেই ২০১১ সালে মিসেস বিটনারের বাসা ছেড়ে রুমির এক রুমের স্টুডিও ফ্ল্যাটে ওঠা। আর তারও মাসখানেক পর ইজারের কাছে দুই রুমের এই ছোট্ট বাসায় ওঠা। এখন পর্যন্ত এখানেই প্রবাসের সিংহভাগ।
forest gump running GIF
RUN FOREST, RUN!
দুপুর বাজে বারোটা। আজকে শনিবার। দৌড়াতে যাব কিনা ভাবছি। রুমির হাঁটু ব্যাথা। রেড মিট থেকে ইউরিক এ্যাসিডের ক্রিস্টাল জমেছে হাঁটুতে। এই কদিন দেদারসে গরু-খাসি আর যা যা গবাদিপশু আছে, সব পেটে চালান দেয়া হয়েছে। ছুটি ছিল, তাই ঘুড়তে যাওয়া হয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্টে, রুমির বন্ধু পিন্টু ভাইয়ের বাসায়। সেখানে একদফা ভুড়িভোজ হল। পরের দিন পিন্টু ভাই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলেন জার্মান বর্ডারের সাথে লাগোয়া ফ্রান্সের শহর Metz-এ। উচ্চারণটা নাকি হবে ”মেস”। সেখানে আরেক বন্ধুর বাড়ি। বাঙ্গাল আমরা কই নতুন শহর ঘুরে দেখবো, তা না করে কব্জি ডুবিয়ে গরুর মাংস ভুনা আর খাসির রেজালা খেয়ে ঘাউক করে একটা ঢেঁকুর তুলে সোফায় হেলান দিয়ে বসে থাকলাম। বাইরে পড়ে থাকলো বৃষ্টিভেজা অনিন্দ্যসুন্দর ফরাসী শহরতলী।
সুতরাং ইউরিক এ্যাসিডের ক্রিস্টাল আমাদের প্রাপ্য ছিল। তো রুমি আর আমি মিউনিখ ফিরলাম যথাক্রমে হাঁটু ব্যাথা আর কয়েক কিলো বাড়তি ওজন নিয়ে। আমার একদম হাঁসফাঁস অবস্থা। দৌড়ঝাঁপ না করলেই নয়। আর রুমির জন্যে পেইনকিলার ইবুপ্রুফেন আনতে হবে। ভাবলাম, নাহ যাই ওষুধটা নিয়ে আসি আর ইজারের পাড় দিয়ে একটু দৌড়ে আসি। এক ঢিলে দুই পাখি। তথাস্তু বলে বেড়িয়ে পড়লাম। এক পকেটে ঘরের চাবি আর আরেক পকেটে আকবরী আমলের মুদ্রা সাইজের দুই-দুই চার ইউরোর বিশালাকার কয়েনের ঝনঝন শব্দ তুলে দৌড়ানো শুরু করলাম। বাইরে মন ভালো করা ঝকঝকে রোদ। ইজারের পাড়ে এই ভর দুপুরে লোকজনের আনাগোনা কম। বিকালবেলা আসলে দেখা যেত মানুষ পিলপিল করছে। যে যার মত চিত-কাত-উপুড় হয়ে মাঠে বা ঘাসে শুয়ে-বসে আছে আর বুভুক্ষের মত কপ্কপ্ করে রোদ গিলছে। শীতের দেশের দুর্ভাগা মানুষ বলে কথা। তবে আপাতত নিরিবিলি পরিবেশটা ভালোই লাগছে। ইজারের এই অংশটা বেশ প্রশস্ত। কিন্তু পানির গভীরতা কম। বরজোর হাঁটু অবধি হবে। এর মাঝেও একদিকে যেখানে পানি একটু বেশি, সেখানে কৃত্রিমভাবে স্রোত তৈরি করা হয়েছে। স্রোতের ঢেউয়ে লোকজন কেউ কেউ সার্ফিং বোর্ড নিয়ে নেমে পড়ে। বেশ লাগে তখন নদীর ওপরের সেতু থেকে দেখতে।
Image result for to run is life
হঠাৎ চিন্তায় ছেদ পড়লো। কারণ, একটানা দৌড়ে হাঁফ ধরে গেছে। ভাবলাম, একটু জিরিয়ে নেয়া যাক। শান বাঁধানো পরিচ্ছন্ন একটা ঘাটে বসে পড়লাম। চোখের সামনে স্বচ্ছ পানিতে নুড়ি-পাথরের ঝিকমিক। ঠিক যেনো মনি-মুক্তা। কয়েকটা রঙবেরঙ্গের হাঁস অলস ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে টুপ্ করে ডুব দিয়ে প্লাঙ্কটন জাতীয় কি যেন খাচ্ছে। আমাকে বসতে দেখে একটা হাঁস আগ্রহ করে এগিয়ে এল। ঝিরিঝিরি বাতাসে লেজের পালক ফুলে হাঁসটাকে কেমন ময়ূর ময়ূর দেখাচ্ছে। ময়ূরবেশী হাঁস আমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে আর পিকপিক করে ডাকছে। উত্তরে আমিও এক-আধটা পুকপাক শব্দ করছি। হংস সঙ্গ পেয়ে আমার খারাপ লাগছে না। টুকটাক কথা তো বলা যাচ্ছে। হোক না সেটা হঙসীয় ভাষায়। নির্জন নদীর ধারে তা-ই বা কে কার সাথে বলে। কি ভেবে জুতা খুলে পা ডুবিয়ে দিলাম নদীর ঠান্ডা স্রোতে। মাত্র গোঁড়ালি পর্যন্ত ডুবল। তাতেই হিম শীতল একটা ঝাঁকুনি লাগলো। যদিও পাঁচ সেকেন্ডেই সয়ে গেল। পানিতে পা জোড়া আর জুতার উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। দৃষ্টিসীমা আকাশে। আর সেই আকাশি রঙের সমুদ্রে ভাসছে পাল তোলা মেঘের নৌকা। কি বিশাল আকাশ! আর তার নিচের পৃথিবীতে আমরা শত কোটি পিঁপড়ামানব। মহাকাশের বিশালতার কাছে একেবারে ক্ষুদ্র, তুচ্ছ। আকাশ বাতাস ভাবছি, এমন সময়ে আবার চিন্তার সূতায় টান পড়লো। পানির ঝাঁপটা এসে লাগলো মুখে। হাঁসময়ূরটা উড়ে যাবার সময়ে আমাকে কায়দা করে পানির ঝাঁপটায় আমাকে বিদায় জানিয়েছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে উঠে বসলাম। চিন্তার ঘুড়ি লাটাই ঘুড়িয়ে মাটিতে নামিয়ে এনে পকেটে পুরে ফেললাম।
হাঁসের কাজ উড়ে যাওয়া। আর আমার কাজ দৌড়ে যাওয়া। যে যার কাজে মন দেয়া যাক। পায়ের পাতা থেকে বালু ঝেড়ে দ্রুত জুতা পরে উঠে দাঁড়ালাম। নিজেকে বললাম, এবার দে দৌড়। এই দৌড়টাই বোধহয় আসল। আর থেমে থাকাটাই হয়তো নকল। তাই দে দৌড়। দিলাম দৌড়। পেছনে পড়ে থাকলো ভরদুপুরের নিঃসঙ্গ নদী। আর উড়ে যাওয়া হাঁসটার রেশ।
– মিউনিখ, জার্মানী
mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

Leave a Reply