একবার বন মন্ত্রনালয়ের অধীনে একটি চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম৷ পদের নাম ছিল সহকারী রসায়নবিদ৷ প্রশ্নের মান বন্টন ছিল নিম্নরূপঃ
বাংলা-২৫, ইংরাজি-২৫, সাধারন জ্ঞান-২৫, রসায়ন-২৫৷ আবারো মনে করিয়ে দিচ্ছি, পদের নাম ছিল সহকারী রসায়নবিদ৷ নিশ্চয় আমার জব রেসপনসিবিলিটি ছিল ল্যাবরেটরিতে রাসায়নিক কাজ৷ সেক্ষেত্রে আমার উগান্ডা সোমালিয়ার রাজধানীর নাম জানা কতটা গুরুত্বপূর্ন? এইসব উদ্ভট বিষয়ের তথ্য দিয়ে মস্তিস্ক ভর্তি করা কি খুব জরুরী? বাংলা ও ইংরাজি থেকেই বা কেন প্রশ্ন করতে হবে? এসএসসি ও এইচএসসি তে তো আমি বাংলা ও ইংরাজি দুটো সাবজেক্ট ই পড়েছি৷ পাশ করেছি বলেই ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেরেছিলাম৷ তার মানে দুটো বিষয়েই আমার বেসিক জ্ঞান ছিল৷ আপনি যদি বলেন পাশ করার পরেও সন্দেহ থেকে যায় যে আমার বেসিক জ্ঞান আছে কিনা৷ তাহলে বলতে হবে আপনাদের এডুকেশনাল সিস্টেমেই সমস্যা৷ আপনারা তাহলে সিস্টেম চেঞ্জ না করে আমাদের কেন কষ্ট দিচ্ছেন? এই চাকরির জন্য বাংলা গ্রামারের রুলস ও কবি সাহিত্যিকদের নাম পরিচয় জানা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ন ছিল? যদি এসব বিষয় আমার জানতেই হবে সেটা আমি নিজ ইচ্ছাতেই জেনে নিবো৷ রসায়নবিদ হতে কেন আমাকে এখন সোমালিয়া, উগান্ডার রাজধানী ধুয়ে পানি খেতে হবে৷

জার্মানিতে আমার ইউনিভার্সিটির অফিসে আমার অফিসমেট একজন জার্মান যুবক৷ আমার সাথে কথা বলার পর সে জানতে পেরেছে বাংলাদেশ নামে একটা দেশ আছে যা কিনা ভারতের পাশে৷ বাংলাদেশের নাম শোনেনি! আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম! পরে মনে হলো, সে তো একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারী৷ বাংলাদেশ নামের দেশ না চেনাতে সে কি তার কোন কাজে আটকে আছে? হয়তো বাংলাদেশ সম্পর্কে তার জানার প্রয়োজন পড়েনি৷ তাই বলে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি তাকে বাধ্য করেছিলো? বাংলাদেশের মুদ্রার নাম কি? রাজধানী কোথায়? স্বাধীনতা কবে পেয়েছে?

একবার বুয়েটে কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট টা পড়ানোর জন্য লেকচারার পদে আবেদন করেছিলাম৷ সেটাই ছিল পাশ করার পর প্রথম কোন চাকরির আবেদন৷ নির্দেশনা দেয়া ছিল আবেদন পত্র থেকে শুরু করে সকল প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র সাত সেট ফটোকপি করে জমা দিতে হবে৷ সাথে একহাজার টাকা মত পে অর্ডার ও করতে হবে৷ সাত সেট ফটোকপি! আমাকেই ফটোকপি করে জমা দিতে হবে? বিশ্বিদ্যালয় কি করে নিতে পারতোনা? তাহলে এক হাজার টাকা পে অর্ডার করেছিলাম কিসের জন্য? ইন্টারভিউ তো হয়েছিলো ভাইবা বোর্ডে৷ শিক্ষকদের বেতন নিশ্চয় আমাদের পে অর্ডারের টাকা দিয়ে দেয়া হয়না৷ আবার যেহেতু ভাইবা বোর্ডে পরীক্ষা তার মানে কাগজ কলম ও প্রশ্ন প্রিন্টের খরচ নাই৷ তাহলে একজন বেকার যুবকের থেকে একহাজার টাকা কোন যুক্তিতে নেয়া হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর দেবার কেউ নাই! যুগ যুগ ধরে এভাবেই চলছে৷ সিস্টেমের যাতাকলে পড়ে হয়রানীর শুরুটা হয়েছিল সেদিন থেকেই৷

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে চাকরীর পরীক্ষা দেয়ার দিন পর্যন্ত আমাদের মস্তিস্ক গুলো অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে ঠেসে দেয়া হয়৷ বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের নাম, জন্মসাল, তাদের রচনা৷ অগুরুত্বপূর্ন দেশ সমুহের রাজধানী মুদ্রার নাম, প্রেসিডেন্টের নাম ঠিক চাকরীর কাজের ক্ষেত্রে কোন প্রয়োজনে লাগে আজো আমার কাছে অজানা৷ তাহলে কেন অপ্রয়োজনীয় তথ্য জানতে চাওয়া হয়৷ যেই ছেলে পাঁচটি বছর কেমিস্ট্রি পড়েছে সে কিভাবে দুনিয়ার এত বিষয়ে খবর রাখতে যাবে? কেন জানতে হবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর বয়স কত?

ধরাযাক কোন ছেলে ব্যাংকে চাকরীর জন্য পরীক্ষা দিতে গেছে৷ প্রশ্ন আসলো উগান্ডার প্রেসিডেন্টের নাম কি! পৃথিবী থেকে নেপচুনের দূরত্ব কত! কি অসামঞ্জস্য প্রশ্ন তাইনা? আচ্ছা বলুন তো উগান্ডার প্রেসিডেন্ট কি ঐ ব্যাংকে সঞ্চয়পত্র খুলবে? ঐ ব্যাংকে চাকরী করতে হলে তার নাম কেন জানতে হবে? নাকি নেপচুনে ঐ ব্যাংকের কোন শাখা আছে?

এবার একটু সরকারী অফিস আদালতের প্রসঙ্গে আসি৷

প্রথমেই নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জার্মানিতে নাগরিকদের জন্য সরকারী অফিসের কিছু পরিসেবার উদাহরন দিচ্ছি ৷ আমার বিশ্বাস আপনাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে৷৷

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবো, মুল সনদ ও অন্যান্য ডকুমেন্টস এবং পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল অফিসে গেলাম৷ পাঁচ ছয়জনের পরেই আমার সিরিয়াল আসলো৷ সেখানে অফিস কর্মকর্তা নিজেই ডকুমেন্টস গুলো ফটোকপি করে মূল ডকুমেন্টস গুলো তখনই ফেরিয়ে দিলেন ও এক কপি পাসপোর্ট সাইজে ছবি রেখে দিলেন৷ এখানে উল্লেখ্য অফিস কর্মকর্তা নিজেই ডকুমেন্টস গুলো ফটোকপি করেছিলেন, কোন পিওন কে অর্ডার করেন নি৷ সত্যি বলতে জার্মানিতে কোন অফিসে আজ পর্যন্ত একজন ও পিওন লেভেলের কর্মচারী দেখিনি৷ সবচেয়ে অবাক হয়েছি, ভর্তির সব কাগজপত্রের সাথে খামে করে আমার জমা দেয়া পাসপোর্ট সাইজের ছবিটিও আমার ঠিকানাতে ফিরিয়ে দিয়েছেন৷

সিটি রেজিস্ট্রেশন করতে মিউনিসিপল অফিসে গেলাম৷ পাসপোর্ট, বাসার কন্ট্রাক্ট পেপার ও অন্যান্য ডকুমেন্টস নিয়ে সিরিয়াল নাম্বার টেনে আধা ঘন্টা অন্য সবার মত অপেক্ষা করলাম৷ এক্ষেত্রে কোন রাজনৈতিক নেতা বা এখানকার কোন স্টাফের আত্মীয়কে দেখলাম না যে সিরিয়াল ভেঙ্গে আগেই চলে গেলো৷ সবাই ধৈর্য সহকারে নিজের সিরিয়াল আসার জন্য অপেক্ষা করছিলো৷ এভাবে আমার নাম্বার আসলো, নির্ধারিত ডেস্কে গেলাম৷ কর্মকর্তা আমার সঙ্গে কথা বললেন ডকুমেন্টস গুলা দেখলেন এরপর নিজেই দৌড়ে গেলেন দুরে রাখা ফটোকপি মেশিনের দিকে৷ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস ফটোকপি করে মূল কাগজ ফিরিয়ে দিলেন৷ প্রিন্ট করে আমার সিটি রেজিস্ট্রেশন পেপার টা দিয়ে দিলেন৷ সর্বোচ্চ দশ মিনিটের সাক্ষাতে কাজ সেখানেই শেষ হয়ে গেল৷

হেলথ ইন্সুরেন্স করতে সরকারী ইন্সুরেন্স অফিসে গেলাম৷ পনেরো মিনিট অপেক্ষার পর আমার সিরিয়াল আসলো৷ পাঁচ মিনিটের মধ্যে কাগজপত্র নিজেরাই ফটোকপি করে মূল ডকুমেন্টস ফিরিয়ে দিলো, কাজ শেষ ৷ দশ দিন পরে বাসার ঠিকানায় ইন্সুরেন্স কার্ড ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা চলে আসলো৷

ভিসা বাড়াতে ভিসা অফিসে গেলাম৷ সিরিয়াল নিলাম, আধা ঘন্টা পর আমার সিরিয়াল আসলো৷ রুমে ঢুকলাম, মূল কাগজ ও দুই কপি ছবি জমা দিলাম কর্মকর্তার যা যা দরকার নিজেই ফটোকপি করে সব মূল কাগজ ফিরিয়ে দিলো৷ আমার ফিংগার প্রিন্ট নিলো সব মিলিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে গেলো৷

একবার একটা পার্ট টাইম কাজের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্ট লেগেছিলো৷ মিউনিসিপল অফিসে গেলাম৷ তেরো ইউরো জমা দিলাম, জমার স্লিপ বুঝিয়ে দিলো৷ পাঁচ নিনিটের মধ্যে আমার আইডি কার্ড থেকে আমার ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নিলো৷ তিন দিনের মাথায় পুলিশ ক্লিয়ারেন্স রিপোর্ট বাসার ঠিকানায় চলে আসলো৷

ইউনিভার্সিটিতে স্বল্পকালীন পদ বৈজ্ঞানিক গবেষক পদে চাকরীর জন্য সব ডকুমেন্টস, আবাদেনপত্র নিয়ে অফিসে গেলাম৷ তিনি আমার সব ডকুমেন্টস নিজেই ফটোকপি করে সেগুলো রেখেদিলেন, মূল সনদ তখনই হাতে হাতে ফিরিয়ে দিলেন৷ তার সাথে সাক্ষাতের সময়কাল ছিল মাত্র পনেরো মিনিট৷ দশ দিনের মাথায় বাসার ঠিকানায় জব কন্ট্রাক্ট চলে আসলো৷

এবার আসি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ৷ কিছুদিন আগে একটি নাটক দেখেছিলাম৷ বৃন্দাবন দাসের নাটক৷ নাটকের নাম ছিল কথা দিলাম তো৷ নাটকের একটা সাধারন মেসেজ ছিল দেশের সিস্টেম চেঞ্জ করা দরকার ৷ সেই মেসেজের সাথেই তাল মিলিয়েই বলা লাগে আসলেই দেশে কিছু কিছু পদ্ধতিগত পরিবর্তন করা খুব দরকার ৷

একটি সাধারন জিনিস সবার মাথায় রাখা উচিত৷ দেশের অফিস আদালতের জন্য কিন্তু নাগরিক নয়৷ নাগরিকের জন্য দেশের অফিস আদালত৷ কাজেই অফিসের শ্রীবর্ধনের থেকেও জরুরী সেই অফিস থেকে নাগরিকগন যাতে আরামদায়ক পরিবেশে পরিসেবা পায়৷

একটি জিনিস লক্ষ্য করবেন৷ কোন সরকারী অফিসে যখন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়৷ তখন লেখা থাকে সিনিয়র অফিসার পদের জন্য এক হাজার টাকা ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে, জুনিয়র অফিসার পদের জন্য পাঁচ শ টাকা আর চৌকিদার পোস্টের জন্য তিনশ টাকা৷ অথচ এরা সবাই কিন্তু বেকার৷ এদের প্রশ্নের জন্য একই কাগজ ও একই কালি ব্যবহার করা হয়৷ এমন না যে টাকা বেশি নিচ্ছি তাই প্রশ্ন বানাবো অফসেট পেজে আর টাকা কম নিলে নিউজপ্রিন্ট কাগজ দিয়ে৷ তাহলে কেন আবেদন করার খরচের ব্যবধান?

ধরাযাক কোন সরকারী অফিসে কোন একটা কাজের জন্য কিছু ডকুমেন্টস জমা দিতে হবে৷ নির্দেশনা দেয়া থাকে, মুল কাগজের সাথে ফটোকপি জমা দিতে হবে তাও সত্যায়িত ফটোকপি৷ এই সত্যায়িত জিনিস টা আসলেই একটি হাস্যকর সিস্টেম৷ আমি ছাত্রবস্থায় অনেক কেই দেখেছি নিজেরাই সত্যায়িতের সীল বানিয়ে নিজেরাই ফটোকপির উপর মেরে দিতো৷ তাছাড়া কোন উপায় ও ছিলোনা৷ কারই বা কয়জন প্রথম শ্রেনীর অফিসারের সাথে পরিচয় থাকে আর জানা শোনাই বা থাকে৷ অনেক সময় এদের কাছে গেলে নিগৃহীতের স্বীকার ও হতে হয়৷ তাছাড়া সত্যায়িতের এসব সীল আসল নাকি নকল দেখার কেউ থাকেনা৷ কিন্তু এটাই ছিল সরকারী সিস্টেম৷ সব সরকারী অফিসেই এই সিস্টেম চলে আসছিলো৷ এটাকে সিস্টেম না বলে এক কথায় বলা উচিত বাজে সিস্টেম৷ যে অফিসে কাগজপত্র জমা দিবো, সেই অফিস কতৃপক্ষ কি ঐ সত্যায়িতের সীল ও স্বাক্ষর দেখেই সিদ্ধান্ত নেন, যে এই ডকুমেন্টস টা আসল নাকি নকল? নিশ্চয় বোকার মত এমন ভাবে বিবেচনা করে কোন সিদ্ধান্ত নেন না৷ তাহলে সত্যায়িতের নামে হয়রানী করা কি খুব দরকার? এমন হলে কি হয়না যে ডকুমেন্টস এর ফটোকপি জমা দেয়া হলো৷ পরে যখন কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেবার সময় হলো তখন ডকুমেন্টস এর মালিকের সাক্ষাৎ নিয়ে ডকুমেন্টস গুলা ফটোকপির সাথে মিলিয়ে নিলো৷ ভুয়া বা না মিললে আইনগত ব্যবস্থা নিলো আর মিলে গেলে কাজ টা এগিয়ে নিলো৷

ধরাযাক কোন সরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরীর আবেদন করবো, আবেদন পত্রের সাথে প্রথম শ্রেনীর গেজেটেড অফিসারের নিকট হতে চারিত্রিক সনদ জমা দিতে হবে৷ একটি সাধারন বুদ্ধি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করুন তো৷ দেশে কতজন চাকরী প্রার্থীর সাথে একজন প্রথম শ্রেনীর গেজেটেড অফিসারের নিবিড় পরিচয়, ওঠাবসা বা ঘনিষ্ঠতা আছে? আর যদি এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থেকেই থাকে কেউ কি প্রার্থীর চরিত্রের খারাপ দিক প্রকাশ করবে? তারমানে জেনে শুনে দুশ্চরিত্র একজন কে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন৷ আবার যদি এমন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নাই ই থাকে তবে একজনের চরিত্র সম্পর্কে কতটুকু গ্যারান্টি সহ সুপারিশ করা যায়? তারমানে এটাও একটা হাস্যকর সিস্টেম৷ আবার প্রার্থীর চরিত্র জানার জন্য পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা পাঠানোর সিস্টেম ও একটি সুপার ফ্লপ সিস্টেম৷ এক্ষেত্রে অযথাই বেকার প্রার্থীর পকেট থেকে কিছু টাকা বেরিয়ে যাবে, প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পাবেনা৷ আসলে প্রত্যেকটা অফিসের ই একটি নির্দিষ্ট টিম থাকা উচিত যারা তাদের অফিসে চাকরীর জন্য প্রার্থীদের চরিত্র জানার জন্য তদন্ত করতে পারে৷ এক্ষেত্রে প্রার্থীর প্রতিবেশী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা পরিচিতদের মতামতকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত৷

সত্যায়িত করার সিস্টেম টাযে হয়রানী মূলক ছিল তা নিজের একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্ণনা করছি ৷ আমি তখন কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের ছাত্র৷ আমার কোন একটা কাজে এসএসসির সনদ ও মার্কশীটের ফটোকপি সত্যায়িতের দরকার পড়লো ৷ তখন ছিল গরমকাল ৷ বাইরে কাঠফাটা রোদ ৷ নিজের সাইকেল টা বের করলাম, ক্যারিয়ালে ফাইল আটকে ছুটলাম কলেজের উদ্দেশ্যে ৷ গরমে ঘেমে নেয়ে আমি একাকার ৷ সাইকেল চালানোর জন্য ঘামছিলাম খুব বেশি ৷ মাথা কপাল ঘেমে টুপ টুপ করে ঘাম পড়ছিলো ৷ সাইকেল স্ট্যান্ডে সাইকেল টা রেখে ছুটে গেলাম বোটানি ডিপার্টমেন্টের একজন প্রভাষকের রুমে ৷ আমি তার নাম টা বলবোনা, উনি সম্মানী মানুষ, সম্মানহানী হবে৷ যাইহোক, ক্লান্ত শরীর নিয়ে তার রুমে উকি দিয়ে দেখলাম, নিশ্চিন্তে তিনি ফ্যানের বাতাস খাচ্ছিলেন৷ দরজার বাইরে দাড়িয়ে ও সেই বাতাসের ভগ্নাংশে আমার শরীরের উত্তপ্ত লোম কাপিয়ে দিচ্ছিলো ৷ আস্তে করে বললাম স্যার আমার কয়েক টা কাগজে যদি একটু সত্যায়িত করে দিতেন ৷ উনি প্রথমে আমার দিকে তাকালেন, সেই তাকানোতে চোখের চাহনি দেখে মনে হলো ওনার দুইটা কিডনির একটা অযথাই চেয়ে বসেছি ৷ আমি অবাক হয়ে গেলাম উনি দাঁত খিচিয়ে উঠলেন ৷ ভাবলাম হয়তো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আছেন ৷ একেতো আমার পাতলা শরীর, তারপর রোদের মধ্যে প্যাডেল মারা, তারপর আবার ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত শরীরে বিনা অপরাধে ধমক ৷ মনে হচ্ছিল মাথা ঘুরে পড়ে যাবো৷ নিজেকে সামলে শেষে রসায়ন বিভাগে একজন শিক্ষক কে পেলাম, জনাব ইয়ার আলী স্যার ৷ তার কাছ থেকে সত্যায়িত করে নিলাম৷ ৷

শেষ করবো নিজের অভিজ্ঞতায় পুলিশ ভেরিফিকেশনের একটি গল্প দিয়ে৷ দেশ ছাড়ার পূর্বে একটা পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট নেবার দরকার পড়লো৷ বিদেশে কিছু পার্ট টাইম জব আছে যেগুলা করতে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট লাগে৷ কুষ্টিয়া ডিএসবি অফিসে পাচঁ শ টাকা চালান সহ আবেদন পত্র জমা দিলাম৷ দশ বারো দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা বাসাতে আসেনি, আবার কোন সাড়া শব্দ ও না পেয়ে ডিএসবি অফিস থেকে স্মারক নং নিয়ে চলে গেলাম কুষ্টিয়া মডেল থানাতে৷ সেখানে অফিসে স্মারক নং দেখালে তারা জানালো আমার কাগজ পত্র তদন্ত কারী কর্মকর্তা একজন এস আই এর কাছে দেয়া হয়েছে৷ ওনার নাম টা মনে আছে কিন্তু আমি এখানে বলবোনা৷ অফিস থেকে বললো এইযে ওনার মোবাইল নম্বর, ওনার কাছে ফোন করেন৷ পরদিন বিকেল বেলা থানার সামনে যেয়ে একটা ফোন করলাম৷ ফোন রিসিভ করলে আমার কাগজটার কথা জানালাম৷ উনি বললেন, আপনি দশ মিনিট অপেক্ষা করেন, আমি আসতেছি, সাক্ষাতে কথা হবে৷ আধা ঘন্টা পেরিয়ে এক ঘন্টা চলে গেলো৷ আবারো ফোন করলাম, এবার একটু উচ্চস্বরে বললেন, আরে মিয়া দাড়ান না কেন, এইতো আসতেছি৷ যাই হোক আনুমানিক দুই ঘন্টা পর তিনি আসলেন৷ আমি ই ওনার হম্বি তম্বি ভাব দেখে অনুসন্ধান করে খুজে নিলাম৷ দোতলাতে ওনার অফিসে নিয়ে গেলেন৷ কি জন্যে তার সাথে দেখা করতে এসেছি, কারন জানতে চাইলেন৷ বললাম পুলিশ ক্লিয়ারেন্স এর জন্য৷ উনি জানালেন আবেদন করেছেন? বললাম, হুম করেছি অফিস থেকে জানালো আমার তদন্ত আপনি করবেন৷ দশ বারোদিন হয়ে গেল কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে নিজেই খোজ নিতে আসলাম৷ উনি ওনার ড্রয়ার খুলে কি সব কাগজপত্র হাতিয়ে বললেন, আমার কাছে আপনার কাগজ আসেনি৷ আমি নরম গলায় বললাম, অফিস থেকে যে বললো আপনার কাছে কাগজ আছে৷ এবার আবারো কয়েকটা ড্রয়ার খুলে ফাইল পত্র ঘেটে ঘুটে একটা ড্রয়ারের তলা থেকে গোল পাকানো স্ট্যাপল করা কয়েকটা কাগজ বের করলেন, বুঝলাম এটাই আমার৷ তিনি একটু গম্ভীর ভাব ধরে বললেন, হুম৷ তো তদন্ত কি বাসায় যেয়ে করবে নাকি এখানেই সেরে ফেলবো৷ আমি বললাম এখানে যদি সম্ভব হয় এখানেই করে ফেলেন৷ আমাকে তিনি অযাচিত কিছু প্রশ্ন করলেন, কোথায় পড়েছি, কোথায় কি করছি এসব প্রশ্ন৷ হঠাৎ বলে বসলেন, এক হাজার টাকা দেন৷ আমি তো অবাক, বাহ বেশ ভদ্রলোক তো, কোন রাখ ঢাক নেই সরাসরি মুখ দিয়ে ফায়ার করে বসলেন৷ আমি বললাম এক হাজার নাই পাঁচ শ মতো আছে ৷ তিনি মোটা গলায় ব্যক্তিত্ব সহ বললেন, পাঁচ শ টাকায় তো এসব কাজ হয়না, খুব রিস্কের কাজ, আপনাকে তো আমি চিনিওনা৷ যদি আপনার প্রিভিয়াস রিপোর্ট খারাপ কিছু হয় রিস্ক তো আমার৷ এত অল্প টাকায় তো এত বড় রিস্ক নেয়া যায়না৷ শেষ মেষ আমার জন্য তার জীবনের রিস্ক নেবার ঝুকিটার কথা বিবেচনা করে একহাজার টাকাই দিলাম৷ সে বললো আমি রিপোর্ট এখনি করে অফিসে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনি কাল অফিসে এসে খোজ নিয়েন৷ তার কথা মত পরদিন অফিসে গেলাম, সেখানে আনুমানিক বিশ বছরের একটা ছেলে বসেছিল, সে পুলিশ ছিলনা৷ তার কাছে যেয়ে সব খুলে বললাম, সে জানালো এসআই আমার কাগজ অফিসে এখনো দিইনি৷ সে জানালো আগামীকাল আসেন৷পরদিন গেলাম, ছেলেটা অফিসে ছিলনা৷ আধা ঘন্টা পর আসলো, আমাকে চিনতে পারলোনা৷আমি পরিচয় দিলাম, তখন বললো জ্বিনা আপনার কাগজ আসেনি৷ পরশু আসেন ৷ আমি পরশুদিন বিকেলেই গেলাম৷ আমাকে ছেলেটা চিনতে পারলো, যেনে মনে মনে পুলকিত হলাম৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় এসআই টি এখনো তাকে কাগজ দেয়নি বলে জানালো৷ অআর কিছু বলতে চাচ্ছিলো তবে ইতস্তত করছিলো, এই ধরনের সিগন্যাল অনেক আগে থেকেই দেখে আসতেছি, বুঝতে সমস্যা হলোনা৷ দুইশো টাকা হাতে দিলাম৷ প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো, আর বললো কাল আসেন কাজ হয়ে যাবে৷ পরদিন গেলাম, সে জানালো আমার কাগজ পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় নাকি কোথায় যেন পাঠিয়ে দিয়েছে, আরো কিছু প্রসেজার সম্পর্কে আমায় জ্ঞাত করলো, আমার কাগজ কোথায় কোথায় যাবে তার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়৷ সেখান থেকে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট ফাইনালি ডিএসবি অফিসে যাবে ৷ ঐ দিন গুলোতে আবার বিরোধী দলের লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলছিলো৷ তাই কনফিউজড ছিলাম পচিঁশ দিনের মধ্যে পাবো কিনা৷ যাই হোক সব ঘুরে ফিরে আমাকে সবশেষে ডিএসবি অফিস থেকে উত্তোলন করতে হবে৷ সার্টিফিকেট প্রস্তুত হলে আমাকে মোবাইল ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে জানিয়ে দিবে৷ পচিঁশ দিন গেলো, দেড়মাস চলে গেলো৷ কোন ক্ষুদেবার্তা পেলাম না৷ শেষে ডিএসবি অফিসে গেলাম, আমার কোন কিছুই আসেনি৷ এরপরে আরো চারমাস দেশে ছিলাম৷ কোন ক্ষুদেবার্তা আমার ফোনে আসেন৷ ডিএসবি অফিসমুখি ও হইনি৷ আশা ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলাম৷

সিস্টেমের নামে হয়রানী এখনো বন্ধ হয়নি৷ এখনো চলছে৷ জানিনা ঠিক কতদিন এসব চলবে৷ তবে ক্ষেত্র বিশেষে কিছু উন্নতি হয়েছে৷ ডিজিটালাইজড হয়েছে৷ আশাকরি দেশের পদ্ধতিগত ব্যবস্থার অন্ধত্ব ও বধিরতা দুর হবে এবং নাগরিকগন সরকারী অফিস থেকে ভালো সেবাটাই পাবে৷

মাহবুব মানিক
বৈজ্ঞানিক গবেষক
মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সায়েন্স
হালে, জার্মানি৷
FB id: https://www.facebook.com/mahbubmanik001

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

Leave a Reply