আমার ২১ শে ফেব্রুয়ারি ২০১৭!

সেমিস্টার শেষ হলো গতকাল আমার। সেই হিসেবে আমাদের গবেষণা দলের আজকে পুর্ব নির্ধারিত একটা রাতের ভোজন ছিল। আমি যে দলে কাজ করি সেখানে জার্মানী ছাড়া অন্য দেশের গবেষক বলতে সব মিলিয়ে আমরা দুইজন। আমি ছাড়া আয়ারল্যান্ড এর একজন
পি এইচ ডি গবেষক আছেন।

ভোজনের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প হয়। অনেকটা ঘরোয়া আড্ডার মতো। আমার যিনি অধ্যাপক তিনি “অন্জনা দেবী” ভারতীয়। প্রায় ১৯ বছর ধরে জার্মানীতে শিক্ষকতা করছেন। আমি নিজেকে সত্যি ভাগ্যবান মনে করি তার মতো একজন অধ্যাপকের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে। দেখে বুঝার উপায় নেই ভদ্র মহিলা কতটা অমায়িক এবং আন্তরিক। ক্রিকেটীয় কারণে হউক কিংবা কুটনৈতিক কারণে হউক ভারতীয়দের ব্যাপারে আমার কেন জানি একটা নাক ছিঁটকানো ভাব ছিল। ইন্ডিয়ান এটা শুনলেই রাগ লাগতো, কেমন জানি মনে হতো।
গত বছর মে মাসের শুরুতে আমি যখন তার দলে কাজ করার সুযোগটা পেলাম আমি কেন জানি সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না, আদৌ কাজ করতে পারব কিনা। একই সময়ে আমি অন্য আরেকজন অধ্যাপকের সাথেও কাজ করার সুযোগ পেলাম। কিন্তু অধ্যাপক দেবীর কাজ এবং গবেষণার প্রতি আমার বেশী আগ্রহ ছিল। ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম দেবীর দলেই কাজ করবো। দুইটার যেকোন এক দলে আমাকে যেতেই হতো কারণ আমাদের গবেষণাগারেই কাজ বেশী-সাথে নম্বরও। যেদিন যোগ দিলাম সেদিন শুধু কিছু কাগজপত্র দস্তকত করা ছাড়া আর কিছুই করা লাগেনি। মে মাস ২০১৬,গ্রীষ্মকাল চলে এসেছে, তাই প্রতি গ্রীষ্মে দেবীর দলের সদস্যদের নিয়ে একটা “দলগত” আয়োজনে মুরগী পুড়িয়ে খাওয়া হয়। পরেরদিন সৌভাগ্যক্রমে সেই দিনটি পেয়ে গেলাম। আমাকে দাওয়াত করলেন, পরেরদিন তার বাসায় আয়োজন হবে। বলে দিলেন বাসায় কিভাবে যেতে হবে। দলের সব সদস্য যাবে।

এখানে একটা প্রচলন সবাই মেনে চলে। কারও বাসায় কোন দাওয়াতে গেলে সাথে কিছু না নিয়ে গেলেও একটা মদের বোতল নিয়ে যায়। আমি যেহেতু ওসবে নেই তাহলে বিকল্প কোন কিছুর কথা ভাবছিলাম। দেশ থেকে আসার সময় আড়ং থেকে কিছু সৌখিন জিনিসপত্র নিয়ে আসছিলাম। ওখান থেকে একটা নির্বাচন করলাম-“দেয়ালচিত্র”। বিকেলে চলে গেলাম তার বাসায়। দরজায় টোকা দিতেই উনি খুব হাসিমুখে আমাকে স্বাগত জানালেন। সুন্দর গোছানো-পরিপাটি বাড়ি। সদ্য কিনেছেন। বেশ সুন্দর জায়গা, উঠোনের মতো এক টুকরো খোলা জায়গাও আছে। একপাশে বেশ সুন্দর একটা বাগান। পরিবেশটা বেশ পছন্দ হল আমার। এর মধ্যে সব সদস্য চলে এসেছে। ২২-২৩ জনের মতো। একফাঁকে দেবী আমাকে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সাথে উপহারটাও দিলাম তাকে, বেশ পছন্দ করলেন।

আমাকে পাশে নিয়ে শুরু করলেন ঠিক এইভাবে-শুভ অপরাহ্ন সবাইকে। ও শফিকুর, আমাদের দলের নতুন সদস্য। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। তোমরা জেনে খুশি হবে যে আমাদের ভারতীয় আর বাংলাদেশের সংস্কৃতি,জীবনধারা, খাবার প্রায় একই রকম। এক সময় ভারত-বাংলাদেশ এক দেশ ছিল। পরে সে বর্ণনা করলেন আমরা কিভাবে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি।আরও যোগ করলেন বাংলাদেশীরা জন্মগত ভাবেই মেধাবী হয়। আমি বাংলাদেশী এরকম অনেককেই চিনি যারা পৃথবীর অনেক জায়গায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। নাসা তে পর্যন্ত বাঙালিরা জায়গা করে নিয়েছে। উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে আমাকে তাদের মাঝে গ্রহণ করলেন। আমি আসলেই নার্ভাস হয়ে পরছিলাম, কিছুটা আবেগীও বটে। সেদিনের অনুভুতি মনকে নাড়া দিয়েছিল গভীরভাবে। হয়তোবা এটাই দেশপ্রেম নয়তো দেশের প্রতি মনের অকৃত্রিম টান, ভালবাসা।

আজকের আড্ডার এক পর্যায়ে উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার দেশের কি অবস্থা এখন। উনি নাকি খবরে পড়েছেন বাংলাদেশী প্রধানমত্রী জার্মানী আসছেন।আমি কিছু জানি কিনা। বললাম জানি। সবাই মন দিয়ে আমাদের আলাপ শুনছে। উনি বললেন আমি উনার ব্যাপারে জানি, নামটা কি যেন? আমি বললাম শেখ হাসিনা। উনি বললেন, হ্যাঁ সঠিক। আমি এরই ফাঁকে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম আজকে হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বুঝতে পারলাম কেউই এ ব্যাপারে কিছু জানেনা। সবাইকে বললাম একটু গুগল করতে। সবাই পরে দেখল। পরে আমি আরও ব্যাখ্যা করলাম। পৃথিবীতে একমাত্র আমরাই এক জাতি যারা শুধু নিজের মায়ের ভাষার জন্য রক্ত বিসর্জন দিয়েছি, জীবনের আত্নত্যাগ করেছি। যার স্বীকৃতিস্বরুপ ভাষা শহীদদের আত্নত্যাগ এবং দেশপ্রেম কে শ্রদ্ধা জানিয়ে সারা বিশ্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি কে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। শুনে সবাই অবাক হলো, শুধু ভাষার জন্যে জীবনের আত্নত্যাগ- ভাবা যায়! সবাই একসাথে টেবিল চাপড়িয়ে, কেউ কুর্নিশের মতো করে মাথা নিচু করে সম্মান করলো।

আমি আপ্লুত হলাম, নিজেকে আরও একবার গর্বিত মনে হলো। ধন্য মনে করলাম আমি বাঙালি পরিচয় দিতে পেরে। নিজের অজান্তেই চোখ গড়িয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু নেমে আসলো।
ধন্যবাদ হে মহান বীরগণ যাদের ত্যাগের ফলে আজকের এই স্বাধীন লাল সবুজের পতাকা। তোমরা অমর, বিনম্র শ্রদ্ধা!

সাবাশ বাংলাদেশ,
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রই।।

শফিকুর রহমান

মাস্টার্স, রসায়ন

রুহর ইউনিভার্সিটি বকুম।

২২.০২.২০১৭ছবিতে আমি আমার প্রফেসর এবং ল্যাবমেট দের সাথে

mm

By Shafiqur Rahman

কেমস্ট্রি নিয়ে পড়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে! পড়ছি/পড়বঃ মাস্টার্স, জার্মান কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে! :)

Leave a Reply