বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ লেখাটিতে কারো প্রতি অসম্মান বা ঘাত-প্রতিঘাতের জন্য বলা হয় নি। হাস্যরসের মাধ্যমে কিছু জিনিস সবার সামনে তুলে ধরাই আমার মূল লক্ষ্য। তাই পুরো আর্টিকেলটিই হালকা মেজাজে পড়ার অনুরোধ রইল। সবার প্রতি সম্মান এবং ভালোবাসা।

বাংলাদেশ থেকে টার্কিশ এয়ারের ফ্লাইট শুরু ভোর ছয়টা পনেরো ৷ আগে থেকেই জানালার পাশের সিট বুকিং দেয়া ছিল ৷ চার চাকার ভটভটি হোক আর প্লেন ৷ জানালার পাশের সিট খানা আমার অলটাইম পছন্দের ৷ বিয়ের পর থেকে জানালার পাশের সিট খানা বউয়ের জন্য কুরবানী করেছিলাম ৷ দুঃখের বিষয় বউ এখনো বিষয় টা জানেই না জানালার পাশের সিট খানায় তাকে বসতে দিয়ে তার জন্য কত্ত বড় একটা কুরবানী দিয়ে ফেলছিলাম ৷ অথচ বিয়ের পর থেকেই বউ আমার ভালোবাসার পরীক্ষা ননস্টপ নিয়েই চলেছে ৷ যাই হোক ৷ জানালার পাশের সিটে বসবো প্লেনের উড়া উড়ি দেখবো, বড় বড় ঘর বাড়ি মুহুর্তেই কত্ত ছোট হয়ে যায় নিজ চোখে দেখবো, মেঘের কাছাকাছি যেতে কেমন লাগে সেটাও দেখবো….. কত্ত খুশি ৷ আগে থেকেই বুঝেছিলাম প্লেনের মধ্যে আমার পাড়া প্রতিবেশী সবাই বাংলাদেশী ই হবে ৷ ব্যাগ বোচকা কাঁধে নিয়ে আমার সিট গুনতে গুনতে পৌছে দেখি আমার সিটে কালো এক অভদ্রলোক বসে পাশের জনের সাথে খোশ গল্পে মশগুল ৷ কনফিউজড হয়ে গেলাম ৷ টিকেটের সিট নাম্বার আবারো মিলিয়ে নিলাম ৷ নাতো ঠিক ই আছে ৷ …হ্যালো ভায়া, সিট তো আমার ৷ অভদ্রলোক মশায় মনে হয় শুনতে পায় নাই ৷ ভল্যুম বাড়িয়ে ডাকলাম, ….হ্যালো এই সিট আমার ৷ তৎক্ষনাৎ আমার দিকে দয়া করে গলা খানা ঘুরিয়ে বললেন, …প্লিজ ভাই আমার পাশে আমার বন্ধু, আপনি পিছনের অমক নম্বরের সিটে গিয়ে বসেন ৷ ….আরে ভাই আমি তো জানালার পাশের সিট নিয়ে ছিলাম ৷ তিনি বললেন, জানালার পাশেই ঐ সিট টা ৷ অগত্যা গিয়ে দেখি জানালার পাশেই তবে একজন বসবে তার পাশে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশ বাতাস দেখতে হবে ৷ ততক্ষনে জানালার পাশে বসার জন্য একজন চিকন ছেলে চলে এসেছে ৷ আমি ছুটে গেলাম আমার সিটে বসা অভদ্র লোকের কাছে ৷ আরে ভাই সিট তো জানালার পাশে না ৷ উনি বেশ বিরক্ত মনে হলো, ….আরে ভাই প্লেন থাকবে আকাশে আপনি জানালা দিয়ে কি দেখবেন? কথাটা যুক্তি সঙ্গত ৷ আমি আবার যুক্তি যুক্ত কথা পছন্দ করি ৷ আমি ইমপ্রেসড ৷ পিলিজ ভাই পিছে গিয়া বসেন ৷ আমাকে প্লিজ কথাটা বলাতে মন টা গলে পাতলা ডাল হয়ে গেল ৷ অগত্যা পিছনে চলে আসলাম ৷ আমার পাশের ছেলেটার নড়ন চড়ন দেখে বুঝতে পারলাম নতুন উঠছে প্লেনে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আশে পাশে তার কিছু সাঙ্গ পাঙ্গ ও আছে ৷ মাঝে মাঝে এরা আমার সিটের মনিটরের উপর হাত কামড়ে ধরে শরীরের ব্যালেন্স রেখে তার সাথে বরিশালের ভাষায় কথা বলে যাচ্ছে ৷ আমার সামনের সিটের পিছে গোজা চাদর টা গায়ে দিয়ে একটা মুভি চালিয়ে বসলাম, দেখলাম আসে পাশে কম বেশি সবাই মুভি টুভি দেখায় ব্যস্ত আবার কেউ কেউ মনিটরের দিকে এমন ভাগে আঙ্গুল গুতাইতে লাগলো যেন আজিব কোন জিনিস প্রথম দেখতেছে ৷

ঘন্টা দুয়েক পরে কেবিন ক্রু খাবার নিয়ে হাজির ৷ আমার পাশে লক্ষ্য করলাম লম্বা একটা জুতা পড়া পা ৷ আমার পিছের ভদ্রলোক দুই পা ছড়িয়ে দিয়ে ঘুমাচ্ছে পা টা মাঝের চিকন গলি পুরা টা কাভার করে ওপারে চলে গেছে ৷ মহিলা কেবিন ক্রু খাবারের ট্রলি ঐ পায়ে বাধিয়ে খাবার দিল সব ফেলে ৷ বেচারী উচা ট্রলির পিছনে যে একজন পা ঢুকিয়ে রেখেছে বুঝতে পারেনি ৷ মন খারাপ করে পড়ে যাওয়া খাবার গুলা কুড়াতে লাগলো ৷

খাবার খাচ্ছি, সামনের সিটের পিছে রাখা ট্রে তে খাবার, ড্রিংক্স ও পানি ৷ আমার সামনে বসা আরেক টেকো অভদ্রলোক ইকোনমি টিকেট কিনে সিট কে বিছানা বানিয়ে শুয়ে যাবার এক উদ্ভট প্লান করে বসলো ৷ তার হেলানো সিট দিলো ছেড়ে, ফলাফল আমার ট্রে তে রাখা খাবার, পানি, ড্রিংক্স সব জাম্প করে পড়লো আমার আর আমার চিকন চাকন প্রতিবেশীর কোলে ৷ আমি রাগ সংবরন করে গলা বাড়িয়ে বললাম ….হ্যালো!!!!! টেকো অভদ্রলোক উত্তরে বললো ….সরি, সরি বলেই আবার চাদর মুড়ি দিলো ৷ ব্যাপার টা এমন হলো ধাক্কা দিয়ে পাঁচ তলা ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে নিচে এসে সরি বলার মতো ৷ কি আর করবো, টিস্যু মিস্যু দিয়ে মোছা মুছি শুরু করে দিলাম ৷ ভাবলাম ভিনদেশী সাদা কেবিন ক্রু ডেকে কমপ্লেইন করি ৷ পরে ভাবলাম এই টেকো লোকের বদনাম করলে দেশের বদনাম হবে ৷ রাগ নিবৃত করে চুপ করে বসে থাকলাম ৷
প্লেন হঠাৎ কেপে উঠলো ৷ মাথার উপরে সিট বেল্ট বাধার সাইন টা উজ্বল হয়ে উঠলো, স্পিকারে ঘোষনা আসলো আবহাওয়া খারাপ সবাই সিটে বসে বেল্ট বেধে রাখুন, ঠিক ঐ মুহুর্তে অতি উৎসাহী কিছু বাঙ্গালী সিট থেকে লাফিয়ে উঠে জানালা দিয়ে খারাপ আবহাওয়ায় আকাশ দেখতে কেমন লাগে সেটা দেখতে ঝাপিয়ে পড়লো, মুহুর্তেই কেবিন ক্রুর দল এই কার্টুন গুলাকে ধরে ধরে সিটে বসিয়ে দিলো ৷

আমার পাশ বসা ছেলেটির নাম মোতালেব কিনা আমার জানা নেই, মুতে লেপ ভেজাতে না পারলেও আমাকে প্রায় ভিজিয়ে দেবার উপক্রম ৷ তবে আর যাই হোক যতদুর মনে হলো সে মুতা মুতি তে গোল্ড মেডেলিস্ট ৷ আমাকে পুরাটা সময় জ্বালিয়ে মেরেছে ৷ একটু পর পর ই “ভাই আমি একটু পেচ্ছাব করবো” ৷ প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনাই, পরে ভাবলাম বহুমুত্র রোগের রোগী, তবে তার বয়স পচিঁশের বেশি হবে বলে মনে হয়না ৷ কি সমস্যা কে জানে!! সাঙ্গ পাঙ্গ শুদ্ধা ছেলেটা সাইপ্রাস যাবে ৷ কথা বললাম, ইস্তাম্বুলে ট্রানজিট তার তেরো ঘন্টার অথচ ইস্তাম্বুল থেকে সাইপ্রাস যেতে সময় লাগে এক থেকে দেড় ঘন্টা ৷ কষ্ট লাগলো ছেলেটার জন্য ৷ আরো বেশি কষ্ট লাগলো সে প্রথমবারের জন্য যাচ্ছে ৷ কারন আমি জানি প্রথমবার যখন জার্মানীতে এসেছিলাম কতটা মানসিক কষ্টে ভুগে ছিলাম ৷

আকাশে মাঝে মাঝেই প্লেন কেপে উঠতে লাগলো ৷ বেল্ট বাধার সিগন্যাল সাথে মাইকে ঘোষনা প্লিজ সিটে বসুন আর বেল্ট বেধে রাখুন ৷ কার কথা কে শোনে ৷ কিছু লোক দেখলাম ঘোষনা শোনার পরপর ই সিট থেকে উঠে হাটাহাটি শুরু করলো, চিনে ফেললাম এই লোক গুলাই সেই আজন্ম ঘাড় ত্যাড়া গুলা যাদের দেশে রেখে এসেছিলাম ৷ বিধিবাম, এরা ও এক্সপোর্ট হচ্ছে দেশের বাইরে ৷

প্লেন সফল ভাবে ল্যান্ড করলো ৷ পশ্চিমাদের দেখেছি প্লেন ল্যান্ড করলে সবাই হাত তালি দিয়ে পাইলট ও ক্রুদের কংগ্রাচুলেশান্স জানায় ৷ আর যতক্ষন না সিট ছাড়ার অনুমতি আসে ততক্ষন ঐ সিটেই ঠায় বসে থাকে ৷ যাই হোক প্লেন ল্যান্ড করলো, রান ওয়েতে তখনো প্লেন দৌড়াচ্ছে, কিছু লোক সিট থেকে উঠে ব্যাগ নামানো শুরু করলো, কয়েকজন আবার ব্যাগ নামাতে গিয়ে অন্য যাত্রীদের মাথায় ঠাস করে ফেলে ও দিলো, আর হাত তালি তো দুরের কথা, ভাব খানা এমন শালারা টিকেটের এক গাদা দাম নিছিস, আর ভালো ভাবে পেলেন ল্যান্ড করবিনা মানে!!!! আকাশে পেলেন পাল্টি খেয়ে যদি আমি মরি রে শালারা়, শালাদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলবোনা !!

মাহবুব মানিক
সাইন্টিফিক রিসার্চার
মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সাইন্স ৷
হালে, জার্মানী ৷

#NoOffence #HumourIntended

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

Leave a Reply