পরীক্ষার আগে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য আমরা চারজন একত্রিত হতাম; পড়াশোনার চেয়ে আড্ডা-তর্কটাই বেশি হত। আমাদের মধ্যে বিশেষত দু’জনের কারণেই আসরটা জমে উঠত; অনবরত কথা বলতে দু’জনেই বেশ দক্ষ। তবে এদের মধ্যে একজনের মুঠোফোন প্রেম থাকায়, অন্যজনই বেশির ভাগ সময় থাকত আসরের মধ্যমণি বা প্রধান বক্তা! আর বাকি দু’জনের মধ্যে আমি শুধু শুনেই যেতাম, মনোযোগী ছাত্রের মতো সব গোগ্রাসে গিলতাম, নিতান্ত বাধ্য না হলে মুখ খুলতাম না আর শেষজন মাঝে মাঝে এটা-সেটা বলে দুই মেরুর মাঝে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করে রাখত।

এখন এতসব মনে পড়ার কারণ বোধ হয় তিন বান্ধবীর মধ্যকার পাশের আড্ডাটি। অদ্ভুতভাবে একজন গভীর মনোযোগে শুনে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে অবশ্য দু’একটা কথা বলছে-তবে কথা শুরু করার আগেই যেন তা শেষ হয়ে যায়। আর একজনের কাঁধে আড্ডা জমানোর দায়িত্ব- আড্ডার মধ্যমণি হয়ে বলে যাচ্ছে নানা গল্প কাহিনী এবং তৃতীয়জন যথারীতি সেতু বন্ধনে ব্যস্ত।

আমার মনোনিবেশ, অবশ্য মনোনিবেশ না বলে তাকিয়ে আছি বলাই বোধ হয় ভালো, অন্য একটা কারণে। আড্ডার মধ্যমণি, যার দিকে এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছি মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি তাকে, তবে আগে কখনো না দেখার সম্ভাবনাটাই বেশি- তবু চেনা চেনা লাগছে। হতে পারে কোন একটা সদৃশ বৈশিষ্ট্যের সাথে পরিচয় আছে, তাই তাকিয়ে আছি আর প্রতিটি মুহূর্তে তার কথা বলার ভঙ্গি, হাসি, চোখ- এসবের ছবি মস্তিষ্কে পাঠাচ্ছি এবং মস্তিষ্ক সেই ছবির সদৃশ কিছু খুঁজে বের করার চেষ্টায় ব্যস্ত।

তার বিপরীত দিকে বসা মেয়েটি যে খুব মনোযোগে সবকিছু শুনে যাচ্ছিল, কোন কারণে হয়তো কিঞ্চিত সময়ের জন্য তার মনোযোগ স্খলিত হয়ে থাকবে। আর তখনই হয়তো আমার এমন করে তাকিয়ে থাকা তার নজরে আসে। সে পুনরায় মনোনিবেশ করার আগে হয়তো ইঙ্গিতে বক্তার কাছে আমার ব্যাপারটি নজরে এনে থাকবে আর তার সত্যতা প্রমাণে মেয়েটি যখন আমার দিকে ফিরল আমি বুঝতে পারলাম, অতি শীঘ্রই একটি অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে যাচ্ছি; বলা ভালো পড়ে গেছি। মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?”

আমি জানি না কিছু বলব কিনা- তবে কিছু একটা তো বলতেই হবে, নয়তো অবস্থা জটিল হয়ে যাবে। কিন্তু কি বলব? ধীর গতিসম্পন্ন মস্তিষ্ক নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়ে গেলাম, এতক্ষণেও কোন সাদৃশ্য খুঁজে পেল না! কিছুক্ষণ আগে আড্ডার কথা ভাবছিলাম, তাই হয়তো বলে ফেললাম, “না, তোমাদের আড্ডা দেখি।”

আমার কথা কি বিশ্বাস করবে তারা? বিশ্বাস না করার কিছু কি আছে এখানে? জানি না। তাই অপেক্ষা করছি বোঝার জন্য; অপেক্ষা করছি পাল্টা প্রশ্ন বা মন্তব্য শোনার জন্য। যেই মেয়েটিকে সেতু বন্ধনকারিনী ভেবেছিলাম, তার বিস্ময় দেখতে পেলাম- জিজ্ঞেস করলো, “আড্ডা দেখছিলে মানে? আড্ডায় দেখার কি আছে?”

এইবার তো আর কিছু না বলে থাকা যাবে না! তাই বলা শুরু করলাম, “ হয়তো দেখার কিছু নেই, হয়তো আড্ডার সক্রিয় অংশগ্রহণকারী না হলে তেমন উপভোগও করা যায় না। কিংবা হয়তো তা সবসময় সত্যি না। যেমন, আমার কাছে বাসে, ট্রেনে কিংবা চলতি পথে আশেপাশে চলতে থাকা আড্ডার প্রতি আলাদা একটা আগ্রহ আছে। হয়তো আমি আড্ডায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছি না; হয়তো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি- তাকিয়ে থেকে অতীত কিংবা ভবিষ্যত দেখছি, হয়তোবা কোন একটা বই পড়ছি কিংবা গান শুনছি, হয়তোবা ঝিমুচ্ছি কিংবা অন্য কিছু করছি, তখন হয়তো পাশের আড্ডা থেকে মজার কিছু একটা কথা বা মন্তব্য কানে ভেসে আসল; আমার হয়তো কোন খেয়ালই ছিল না ঐদিকে কিন্তু একটা-দুইটা শব্দেই কান খাড়া হয়ে গেল, হয়তো মজার কোন গল্পের পূর্বাভাস পেয়ে সে আড্ডার একজন নীরব শ্রোতায় পরিণত হয়ে গেলাম।”

“আমার আগ্রহের অবশ্য আরেকটা কারণ আছে; মূলত সে কারণেই তোমাদের আড্ডা দেখছিলাম বা বলা যায় তোমাদের দিকে তাকিয়েছিলাম। কিছুটা অদ্ভুত মনে হতে পারে, অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরির একটা কারণও হয়তো হতে পারে- যদি সেরকম কিছু হয় তবে ক্ষমা করবে আশা করি। আড্ডায় আড্ডার মানুষগুলোর মাঝে সময়ে সময়ে যে অভিব্যাক্তি ফোটে তা অসাধারণ। কোন চলচ্চিত্রে এসব সূক্ষ্ণ ব্যাপারগুলো তুলে আনতে হয়তো প্রচুর পরিশ্রমের দরকার হয় কিন্তু এখানে খুবই স্বাবিকভাবে ব্যাপারগুলো চলে আসে। কি অদ্ভুত লাগে যখন খুব মনোযোগ সহকারে কিছু শুনতে থাকে, সমস্ত আগ্রহ ফোটে তার চোখে-মুখে, সব কিছু হৃদয়াঙ্গম করাই যেন হয়ে উঠে তার লক্ষ্য, একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে বক্তার দিকে, যদিবা বক্তার বদল হয় তবে তার দৃষ্টিটা সামান্য সরে যায় নতুন বক্তার উপর, অন্যসব থাকে স্থির, একটু নড়চড় হলেই যেন কাঁচের মতো ভেঙ্গে যাবে সমস্ত মনোযোগ। আবার যখন দেখি একজন কিছু একটা বলে যাচ্ছে, মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে কিন্তু গল্পটা বের হয়ে আসতে চাচ্ছে তার বাচন ভঙ্গিতে, অঙ্গভঙ্গিতে, মুখাবয়বে; ঘটনার ব্যাপকতা, ঘটনার গুরুত্ব তুলে আনছে সে শ্রোতার কাছে অভিব্যাক্তির মাধ্যমে- এসবের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকি। আর একজনকে দেখি সে গল্প শুনে যাচ্ছে কিন্তু একইসাথে সে স্মৃতি হাতড়ে যাচ্ছে সামঞ্জস্যপূর্ণ বা সম্পর্কযুক্ত কোন গল্পের বা কথার জন্য; এই একইসাথে শুনতে থাকা আর খুঁজতে থাকা কিংবা গল্পটা পেয়ে গেলে একইসাথে শুনতে থাকা আর আগ্রহভরে অপেক্ষা করতে থাকা- এসবের একটা চমৎকার অভিব্যাক্তি আছে যেটা ভাষায় বলা সম্ভব না, এটা দেখতে হবে। কিন্তু আড্ডায় সক্রিয় থাকলে সবগুলো ব্যাপার লক্ষ্য করা যায় না। মনোযোগী শ্রোতা নিজের একাগ্রতা টের পেলেও চোখে-মুখে ফোটা অভিব্যাক্তি থেকে বঞ্চিত হয়। সে জন্যই এসব একটু দূর থেকে দেখতে হয়।”

এবার থামার পালা। থেমে তিনজোড়া আগ্রহী দৃষ্টি দেখে তৃপ্ত হওয়ার কথা হলেও কিছুটা অপ্রতিভ হলাম ওদের চাহনি দেখে; বুঝলাম আমার আগ্রহভরা দৃষ্টিও এরকম অপ্রতিভ করতে পারে অন্যদের। তাই অনুশোচনার স্বরে বললাম, “আমি মনে হয় আড্ডার স্বাভাবিকতাটা নষ্ট করে দিলাম; এখন মনে হতেই পারে যে একটা ক্যামেরা তোমাদের দিকে তাক করা আছে আর তোমরা অভিনয় করছো; সহজ-স্বাভাবিক ভাবটা নষ্ট হলো হয়তো। এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত!”

“হুমম, ব্যাপারটা আসলেই অস্বস্তিকর, তবে কিছু মনে করলাম না কারণ ব্যাখ্যাটা পছন্দ হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে একই কাজ করা থেকে বিরত থাকাই ভালো, সবার এই ব্যাখ্যা পছন্দ নাও হতে পারে! তবে আড্ডার বৈশিষ্ট্যই হলো তা স্বতঃস্ফূর্ত, ‘Hidden Camera’-এর আশঙ্কা থাকলেও আড্ডাবাজরা খুব সহজেই তাকে প্রাণবন্ত করে তুলে।”- মধ্যমণির উত্তর।

মধ্যমণির উত্তরের উত্তরে শুকনো একটা হাসি দিয়ে ভাবতে থাকলাম, নাহ! খুব ভালো একটা কাজ হল না। কিন্তু এখনো তো স্মৃতি আওড়ে কিছু বের করা গেলো না। মাথার মধ্যে মনে হয় সবকিছু খুব বেশি অগোছালো হয়ে গেছে; স্মৃতি-ছবি-মুহূর্ত-মুখ-নাম কোন কিছুই ঠিক জায়গামতো নেই। কে যে কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে তার কোন হদিশ নেই। মনে হচ্ছে পুরাই হযবরল অবস্থা। এসব যখন ভাবছি তখন পাশে এসে এক ভদ্রলোক বসলো আর আমাকে ঐ আড্ডা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে দিল। আমি এবার কাঁচের ভিতর দিয়ে ট্রেনের গতিতে ভবিষ্যৎ দেখতে লাগলাম।

বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন স্টেশনের কাছাকাছি আসলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তিনজনই নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাকে দেখে বিদায় জানালো- আমিও জানালাম। নেমে যাবার আগে মধ্যমণি একটু অপ্রতিভ হেসে বলল, “ভালোমতো আড্ডা দেখো, কোন সমস্যা নাই, বাই।”

“বাই।”……মনে পড়েছে! এক হলিউড অভিনেত্রীর সাথে তার অদ্ভুত সাদৃশ্য আছে। যাবার আগের অপ্রতিভ হাসিটা দেখেই ধাঁধাঁর সমাধান হল- চিনলাম তার হাসি দেখে! আর বাকি সাদৃশ্যগুলোও মাথার ভিতর থেকে বের হয়ে আসল একটার পর একটা। অদ্ভুত মিল ঐ অভিনেত্রীর সাথে তার- কথা বলার ভঙ্গিতে, চোখ জোড়ায় আর হাসিতে। হয়তো এই অজানা-অচেনা এই মেয়েটি এরকম নামহীনা হয়েই আমার স্মৃতিতে অভিনেত্রীটির মাঝে থেকে যাবে।

mm

By Manir Hossain

মাস্টার্স শেষ করেছি বায়োনিক্স-এ, থাকি এসেন, জার্মানিতে।

Leave a Reply