***মাদ্রিদ ভ্রমণ নিয়ে পড়তে এখানে ক্লিক করুন****

ইউরোপের যেকোন শহরেই আমার ভ্রমণের একটা উদ্দেশ্য থাকে যে সেই শহরের রাতটাকে উপভোগ করা। মাদ্রিদ নিয়ে আগের লেখায় বলেছি ভাগ্যদেবতা বরাবরই আমার প্রতি বেজার, তার অনেক গোস্বা আমার প্রতি। বার্সেলোনায় এসেও তার ব্যত্যয় উনি ঘটাননি। মাদ্রিদ থেকে প্রায় ৮ ঘণ্টা জার্নি করে বার্সেলোনায় পৌঁছে শুনি রাতে ১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত করোনা-কার্ফিউ। কুখ্যাত কালনাগিনী কুশীল করোনাক্রোধে আমি জ্বলতে থাকলাম। মন খারাপ করিনি, কারণ এই সমস্ত ঘটনা তামাম দুনিয়ায় আমার সাথেই শুধু ঘটবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আর যার উপর আমার হাত নেই, তার জন্যে মুখ গোমরা করে বসে থাকার লোক আমি নই। রাত ১১টায় বেরিয়ে পড়লাম।

আমি যেখানে বাসা নিয়েছি, সেটা শহরের সুন্দরতম একটি পার্কের সাথেই। পার্কের নাম Ciutadella, এর থেকে শুরু করে লম্বা একটা লেন চলে গেছে আর্ক দি ট্রিওম্প পর্যন্ত। আর্ক দি ট্রিওম্প হল বার্লিন গেটের মত সুবিশাল তবে আরো বেশি রঙ্গিন আর সুচারুরূপে কারুকার্যময়। এই গেটের ইতিহাস জানি না, তবে গেট থেকে শুরু করে পার্ক অব্দি বিশাল লম্বা হাঁটার লেনটি, যার দুপাশের রয়েছে সারি সারি খেজুর গাছ আর রয়েছে সামান্য উঁচু আয়তাকৃতির ঘাসের ঢিপি যেখানে মানুষ বসে আড্ডা দেয়। আমার বারান্দা থেকে এটি দেখা যায় আর ওখানে যেতে লাগে ১ মিনিটেরও কম সময়। যখন আমি পৌঁছলাম, আকাশে তখন ঝলসানো রুটির মত চাঁদ তার গমগম করা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। জানি আর মাত্র কিছুক্ষণ পরেই কার্ফিউ, কিন্তু সে বেদনা ভুলে গেলাম অপার এই মুহূর্তে, আর সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিলাম, যে সময়টুকুই এখানে আছি সেটুকু উপভোগ করতে কার্পণ্য করবো না। 

রাতে শুয়ে শুয়ে ফেসবুকাচ্ছি। হঠাৎ দেখি বন্ধুকাম বড়ভাই আজিজ ভাই ফেসবুকে কিছু ছবি আপলোড করেছে, সেও বার্সেলোনায়। রাতের শহরে ঘুরলে অনেক বন্ধু জুটে যায়, যাঁদের সাথে সময় কাটে, যা মাদ্রিদে হয়েছিল আমার বেলায়। এই শহরে যেহেতু কার্ফিউ চলে তাই একা একাই ঘুরতে হবে বলে মনস্থির করেছিলাম। কিন্তু আজিজ ভাইকে দেখে জানে পানি আসলো। দিলাম কল। পরেরদিন দেখা করার সময় নির্ধারণ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আজিজ ভাই এমন এক পিস, যার সাথে দোজখকুলশিরোমনি হাবিয়া দোজখে গেলেও বিরক্ত হওয়ার চান্স নাই। তার এক এক ডায়ালগ হল বজ্রপাতের মত লাফিং গ্যাস, হাসতে হাসতে মরে যেতে হয়। তাই সময়টা ভাল কাটবে এটা নিশ্চিতই ছিলাম। দেখা হওয়ার পর দেখি তিনি আরো দুইজন নিয়ে এসেছেন। এই দুজনের কোন কাজ নেই, শুধুমাত্র ছবিতোলা আর  “ভাই কি খাবেন”, “ভাই ঐদিকে চলেন খুব ভাল জায়গা”, “ভাই এইটা খান, ওইটা খান” এইগুলা বলা ছাড়া। তাঁদের একজন আজিজ ভাইয়ের বাল্যবন্ধু নিয়াজ ভাই আর একজন চব্বিশ বছরের তরুণ স্মরণ। দুজনেই বার্সেলোনায় থাকে বেশকিছুকাল যাবৎ। তাঁদের মধুর আপ্যায়নের যন্ত্রণায় আমাদের জীবন যায় যায় অবস্থা!

চারজনে নেমেছিলাম জলে

বীচে যাব গা ভেজাতে, ভূমধ্যসাগরে সাঁতরাতে। এই প্রকাণ্ড সাগরের একদিনে স্পেন, আরেকদিকে ইতালি গ্রীস, আর অপরদিকে তুরস্ক, মরোক্কা, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি। যুতসই একটা স্থান দেখে আমরা আমাদের ব্যাগ-বোচকা রাখলাম, রোদের তাপ থেকে বাঁচার তাগিদে ছাতা বসানো হল। নেমে গেলাম জলে। শুরুতে একটু ঠাণ্ডা লাগলেও একবার ডুব দিলে আর সমস্যা নেই। আমরা কিছুক্ষণ সাঁতরে উপরে উঠে কিছু খাই, এরপর আবার নামি। চক্রাকারে এরকম কয়েকবার করার পর অবস্থা সামান্য কাহিল, ক্ষিধেও কম লাগেনি। আমাদের প্ল্যান রাতে ভাল কিছু খাব, তখন অলরেডি সন্ধ্যা, তাই ঠেকার কাম চালানোর জন্য হাতের নাগালে যদি ম্যাকডোনাল্ডস পেয়ে যাই তবে তো ষোল আনার আট আনা পূর্ণ হয়েই যায়!

সাগর সাঁতরানো শেষে খাওয়া

ম্যাকডোনান্ডসে খেয়ে সেখান থেকে আমরা গেলাম এক বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে, মূলত আড্ডা দিতে। রেস্টুরেন্টটি বাঙ্গালি দিলেও এখানকার সব খাবার স্প্যানিশ। মাত্র ২০ বছরের এক তরুণ সাগর এটি শুরু করেছে মাত্র মাস তিনেক আগে। বাঙ্গালির অনেক দোষ। কিন্তু যে বৈশিষ্ট্যটি বাঙ্গালিকে সারা পৃথিবীর বাকি দেশ থেকে আলাদা করেছে তা হল বাঙ্গালির আতিথেয়তা। একে বলা যায় একরকম জবরদস্ত আতিথেয়তা। সাগর ভাই আমাদের না খাইয়ে উঠতেই দেবেন না। শুধু তাই নয়, অনেক সময় আড্ডা দিয়েও যেতে হবে। তিনি আমাদের বাহারি নানা রকমের স্প্যানিশ খাবার খাওয়ালেন, পায়েলাও খেলাম। উদরপূর্তি করে প্রাণভরে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরলাম। এই এতকিছু করলাম, এর মাঝে কিন্তু নিয়াজ ভাই আর স্মরণের মধুর যন্ত্রণা থেমে ছিল না। ওদের জ্বালার কত জায়গায় আরো কতকিছু খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।

দূরে পেছনে দেখা যায় পালেস

পরদিন অর্থাৎ শেষদিন আমাদের পরিকল্পনা শহর ঘুরে দেখা, শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা, গির্জা, রাজপ্রাসাদ এইগুলা দেখা। প্রথমেই গেলাম লা সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া (La Sagrada Familia) দেখতে। বহু পুরনো গথিক ডিজাইনের হলেও এটি আসলে তেমন পুরনো নয়। বিশ্ববিখ্যাত স্প্যানিশ স্থপতি এন্টোনি গৌডির বহু অসাধারণ কাজের মাঝে এইটা একটা যা ইউনেস্কো হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। ১৮৮২ সালে এর কাজ শুরু হলেও চলছে শতাব্দী ধরে। এখান থেকে ঘুরে ঘুরে গেলাম The Palau Nacional এ। এটা আসলে একটা আর্ট মিউজিয়াম, দেখতে কিছুটা বার্লিনের অদূরে পটসডাম শহরের সানসৌচি প্রাসাদের মত। এর বাইরেও দিন শেষে আমরা ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে বহুক্ষণ ঘুরলাম আড্ডা দিলাম এটা ওটা খেলাম। 

সৈকতের তীর ঘেঁষে কলম্বাসের ভাষ্কর্য। তিনি এই সৈকত থেকেই আমেরিকা মহাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিলেন সে প্রায় ছয়শো বছর আগে। একারণেই তাঁকে বলা হয় তিনি আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন।

সাগরের তীরবর্তী হওয়ার এখানে সামুদ্রিক খাবার সহজলভ্য। আমরাও বেশ রাতের বেলা একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে পেট ভরে সামুদ্রিক যত প্রকার পোকামাকড় আছে খেয়ে বাসায় ফিরলাম। সাথে করে নিয়ে আসলাম নিয়াজ ভাই স্মরণ আর সাগরের ভালোবাসা। ওরা না থাকলে বার্সেলোনায় এত অল্প সময়ে এত কিছু দেখা বা ঘোরা কিছুতেই সম্ভব হত না।

যে কথাটি বলে শেষ করবো সেটি হচ্ছে, আর কোন কিছু বুঝি না, আবারো বার্সেলোনার যেতে হবে এটাই শেষ কথা!

১লা আগস্ট ২০২১
জাহিদ কবীর হিমন
সম্পাদক, জার্মান প্রবাসে

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply