আমট্র্যাকের জানালা সার্ভিস সুন্দর।

স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় বড়। হাডসন নদী ঘেঁষে যাবার সময় যার কারণে জানালার কার্নিশ একটু সময়ের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম একটা ছুটতে পারা ট্রেন; কতগুলো মানুষ সেখানে।

কিছুক্ষণ আগে, এক জোড়া সনাতন চেহারার তরুণ তরুণী মুখোমুখি বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল। পোশাকের সনাতনী আবহ পুরোদস্তুর বহন করতে পেরেছে তাই বোধহয় আমার কাছে মুখ দুটোই অমন প্রাচীন লেগেছিল। ছেলেটার মাথায় ইহুদীদের কিপ্পাহ ধরণের টুপি।

তারা ছিল খুব চুপচাপ। কেবল তাদের স্টারবাকস নিয়ে আলগোছে ব্যস্ত যতটুকু দেখলাম। মুখোমুখি- সৌম্য। মনে হচ্ছিল ঠিক একটা সেলুলয়েড নির্ভর নির্বাক কোন চলচ্চিত্রে টুপ করে ঢুকে পড়েছি।

আমার অনুমান বলে তারা হাসিডিক সম্প্রদায়ভুক্ত। ব্রুক্লিনের রাস্তায় হাসিডিক ইহুদীদের দেখেছি কিছু। ওখানকার বোরো পার্ক এবং জিউয়িশ কমিউনিটি নিয়ে আমার কিউরিসিটি অবশ্যই নিউজার্সি গিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি দর্শনের চাইতে বেশী। অষ্টদশ শতাব্দীতে ওয়েস্টার্ন ইউক্রেন থেকে শুরু হওয়া স্পিরিচুয়াল রিভাইভাল মুভমেন্ট এখন ইজরায়েল ছাড়াও ইউনাইটেড স্টেটসে জাঁকিয়ে বসেছে বেশ।

হাসিডিকরা আলট্রা অর্থোডক্স হয়ে থাকে। জীবন যাপন পদ্ধতি, চলন বলন কি পোশাক আশাক, হাসিডিজমের ছাপ পাওয়া যাবে সব জায়গায়। দাড়ির ঝুল আর অবনত চোখের ছেলেটাকে দেখাচ্ছিল তাদের গুরুগম্ভীর শাবাদদের মত। মেয়েটা, লম্বা স্কার্ট আর অর্থোডক্স বিবাহীত নারীদের নিদর্শন হিসেবে মাথায় রুমাল বাঁধা। লেসের রুমালটা তার খোঁপাকে আগলে ধরে আছে, ভেঙ্গে পড়তে দিচ্ছেনা।

ওদের দু জনকে দেখার পর থেকে একটু আগ পর্যন্তও আমাকে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টির নানান বিষয় আশয় আর প্রথা ডাকাডাকি করছিল কিছু ভাবার জন্য। থেকে থেকে মনে পড়ছিল রক্ষণশীল বিবাহিতাদের মডেস্টি উইগ, সাব্বাথের লম্বা আয়োজন কিংবা কালচারাল আইসোলেশন নিয়ে। এই মার্কিন মুল্লুকের আরেক প্রথাবিরোধী ধর্মসম্প্রদায় অ্যামিশদের সাথে মিল আর বেমিল নিয়ে ভাবতে বসার আয়োজন করছিলাম বেশ। কিন্তু বিনা নোটিশে কার্নিশবিহীন জানালার বাইরে শুন্যে সাঁতার দিচ্ছিলাম যখন, তারা থেমে গিয়েছিল তাদের কফির ছোট্ট চুমুকে। সেই সেলুলয়েডের ফিতেখানা আটকে গেলে যেমন হয়।

আর আমার ছোট ছেলে…। এরকম গেছো বানর কিভাবে হল বুঝলাম না। সারাক্ষণ কোন না কোনকিছু বাইতে পছন্দ করে। আমার নানু এই ধরণের কর্মকাণ্ডকে বলে “কুট বাওয়া”।

ট্রেনে ঢোকার পর থেকে সে কেবল কুটই বাইছিল। কখনো ইস্পাতের দেয়াল, কখনো সিটের হাতল বেয়ে একদম মাথায়, আমাকে বা তার বাবাকে গাছ বানিয়ে কখনো। বড় ভাইকে বাইতে গিয়ে পিট্টি খেয়ে ঝাপ দিয়েছিল আমার কোলে। ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমিয়ে কাদা হয়েছে এখন। বড় ভাইটিও “আমাকে মাফিন খাবে, ওরাঞ্জ জুসস খাবে”র পর্যায়ক্রমিক দাবী দাওয়া আদায় করে ক্লান্ত হল অবশেষে। পুরো পাড়া একদম জুড়িয়ে গিয়েছে খোকাদের ঘুমে।

খোকাদের বাবাকে দেখছিলাম অতি মনোযোগের সাথে রসুন বোনার মত প্রোজেক্ট প্রপোজাল নিরীক্ষণ করছিল একটু আগে। ভ্যাকেশন স্পেশাল দাপ্তরিক কাজকর্ম নিয়ে স্ক্রিনের ভেতর মাথা গুঁজে আছে; বরাবরের মত। বরাবরের মত আরেকটা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছিল এবারেও। শেষ মিনিটে এসে আমট্র্যাকটাকে ধরতে পেরে বিজয়ীর হাসি হেসেছি।

এদিকে এতদিনের ডকুমেন্টারির পর্দা কিংবা প্রেসের হরফ ছাপিয়ে হাডসন বইছে চোখের সীমানার ভেতর। সবাইকে নির্বিঘ্নে নিরাপদে রেখে আমি কিভাবে যেন শুন্যে বিলীন হলাম।

কিন্তু ব্যপার হচ্ছে এই লম্বা ঝকঝকে নীল নদীটাকে দেখে আমার সামান্য দেজা ভ্যু হল। আমার মনে হল আগেও আমি এখানে এসেছিলাম। এই নদী আমার অতি পরিচিত। দূরে পাহাড়, পাহাড়ে বসতি, একটা একটা সেতু আর বন্দর এদের সবার সাথে দেখা হয়েছে সশরীরে। এর জন্যেই ভর সকালের দূরপাল্লা বেছে নিতে চেয়েছি সবসময়।

আমার কাজ দেখা। অন্ধকারে নিয়নের আলোয় নদীর রঙ যেত বদলে। ওভাবে দেখাটা অন্যরকম অবশ্য। এখন গতানুগতিক একটা নদীই বরং কোথায় যেন নিয়ে যেতে চাইছে। হাডসন; খটখটে শুকনোমত নামের নদীটা এমন স্নিগ্ধ- এতটাই দুঃসহ সুন্দর!

আমি যাচ্ছি আর যাচ্ছি। মানুষের মুগ্ধ হবার সাথে সাবমিসিভ হয়ে পড়ার একটা গাঢ় সম্পর্ক আছে। নিজেকে কোথাও আর তেমন করে খুঁজে পাওয়া যায়না বলে মিস্টার লিরিসিস্ট আবেগপ্রবণ হয়ে লিখে ফেলেন

                                  Just you are there, I am nowhere

আমার মুগ্ধতায় থাকে অনুসন্ধান। আমি খুঁজি। আমি আমাকে খুঁজি এটা ঠিক। তাঁকেও নিরন্তর খুঁজি আমি। যিনি জানতেন হঠাৎ দেখা নদীটাকে আমার চেনা মনে হয় এবং স্পর্শ করে।

রেল লাইন থেকে একটু দূরে গাছ গুলো দাঁড়িয়ে আছে জমকালো গ্রীষ্ম মাথায় নিয়ে।(এদের ভেতর লিরিসিস্টের সেই গুলমোহরকে হয়ত এরই ভেতর দেখে ফেলেছি আমি; একটা লম্বা সময় ধরে সুকৌশলে তার হৃদয় দখল করে যাচ্ছিল যে গুলমোহর। মার্কিন দেশে হুবহু গুলমোহরেরা থাকতেই পারে, অন্য কোন নামে। একটু দেখায় চোখে এমন জ্বালা ধরে যায়!)

তারা ঝাঁকড়া চুলের এক একজন ভবঘুরে ছিল এতক্ষণ, একটু জিরোচ্ছে।কিছুটা অবিন্যস্ত। ইউরোপের মত শ্রী বৃদ্ধি করতে গিয়ে মানুষের হাতের ছাপ এখানে খুব নিয়ম করে পড়েনা বোঝা যায়। সে জন্যেই কি আপন মনে হয়? শেকড়ের কথা মনে পড়ে? একটা নদীমাতৃক দেশে প্রোথিত আছে শেকড়। আর কত দূরগামী নদী ছিল সেখানে। আকণ্ঠ দেখিনি তাদের। তৃষ্ণা।

বেলা গড়াতে গড়াতে জলাভূমির এপাশের এলোমেলো গাছেরা সঙ্খ্যায় বেড়ে যাচ্ছিল। গ্রামাঞ্চল, ছোট শহরগুলো কোত্থেকে এসে উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। হুটহাট কল কারখানা, ট্র্যাডিশনাল অথবা কটেজ স্টাইল বাসাবাড়ি। কোন বাসার বারান্দা থেকে রেলগাড়ির দূরত্ব অনেক কম। হলিউডী বিগ মামার মত দেখতে একজন বয়স্ক আমেরিকান চেয়ার পেতে পত্রিকা পড়ছিলেন। তিনি তার বারান্দার দেয়ালে বড় করে একটা দেয়ালঘড়ি ঝুলিয়েছিলেন। আমট্র্যাক বেশ দ্রুত দেয়ালঘড়িটাকে পাশ কাটিয়ে যাবার পরেও সময় পড়া গিয়েছিল। মুসাফিরদের ভদ্রমহিলা এরকম আনমনেই সময়জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন, ব্যপারটা অভিনব।

অবশ্য ব্রুক্লিনের রাস্তা ধরে হেঁটেছি যখন, দেখেছিলাম কিছু বারান্দার সাজসজ্জা। মধ্যবিত্তের আলাপী বসার ঘর যেন। উইং চার্ম, ফুল, আরাম কেদারার পাশে পেপার ম্যাগাজিন, আর দেয়াল ঘড়ি। বিশালদেহী মানুষেরা ঠা ঠা হেসে গল্প করছে।

নিউইয়র্কের বিষয়াদি আমট্র্যাকের জানালার চেয়েও বড়। ম্যানহাটন নামক গ্যালিভারদের এলাকার স্কাইস্ক্র্যাপার্স ছাড়াও রাস্তা দিয়ে ঢাউস গাড়িসকল উড়িয়ে নিয়ে যায় ক্রেইজি ড্রাইভারেরা, আমার ওগুলোকেও কিন্তু অতিকায় লাগলো।

ব্রুকলিনের নাম না জানা রাস্তাটায়, একজন র‍্যাম্পার গায়ে দেয়া কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক (অবশ্যই বিশালদেহী) ব্যস্ত ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ধুম ধারাক্কা র‍্যাপ গান ছেড়েছিলেন । গান তো নয় যেন র‍্যাট এ ট্যাট ট্যাট গান ফায়ার। বিনুনি বাঁধা লম্বা চুলগুলো বাতাসের শরীরে এদিক ওদিক আঘাত করে দ্বিধায় ফেলে দিচ্ছিল স্বয়ং বাতাসকেই। কোন দিকে আর কার পানে যে বইবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।

আমাদের শৈশবের সেই রেস্লিং রিংএর মধ্যে, যখন দৈত্য দানো-মাচো ম্যানেরা এন্ট্রি নিত তখন এমন ভাঙচুর সঙ্গীত হত। লোকটির অঙ্গ ভঙ্গীও বাজনার সাথে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ লেগেছে। এমন না যে তিনি অর্থ সংগ্রহের লিপ্সায় এমন করছিলেন, বরং সরব সন্ধ্যায় ভরা ফুটপাতে নিজের চিত্তকে বিনোদিত করাটাই মুখ্য বলে মনে হচ্ছিল। তাতে অবশ্য কারো কিছু আসছিলও না- যাচ্ছিলও না। পথচারী যারা হেঁটে যায় তাদের অনেকেই বড় গলায় , অনেক জোরে জোরে কথা বলছিল যেটা জার্মানির ব্যস্ত শহরগুলোতেও তেমন দেখা যায়না।(সাময়িক স্থানান্তরে ভ্রমণরত মানুষ আরও বেশী তুলনামূলক কার্যক্রম করতে পছন্দ করে। এড়াতে পারেনা)

আমার বাসা হামবুর্গে। সেখানে আটটার পর বাতিগুলো নিভে যায়। কোথাও কোন অপ্রয়োজনীয় বাতি জ্বলতে নেই। কোন কোন জায়গায় সেন্সর লাগানো বাতি থাকে। জনমনিষ্যি হেঁটে যাচ্ছে এমন সিগন্যাল পেলে জ্বলে ওঠে ক্ষণিকের জন্য আবার নিভে যায়।

এদিকে ব্রুকলিনের ফুটপাত গম গম করে ওঠে যেন রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে। ঢাকার ফুটপাতও সন্ধ্যায় মহাব্যস্ত থাকে কিন্তু রাত বাড়তে বাড়তে ঘুমিয়েও পড়ে। অথচ ব্রুকলিন কখন ঘুমায় বুঝতে গিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে হল এই শহর আসলে ঘুমহীন। ফ্রেডেরিকো গার্সিয়া লোরকাও ব্রুকলিনের নির্ঘুমপনায় বাধ্য হয়ে লিখে গিয়েছেন,

Nobody is sleeping in the sky. Nobody, nobody.

Nobody is sleeping.

If someone does close his eyes,

a whip, boys, a whip!

Let there be a landscape of open eyes

and bitter wounds on fire.

No one is sleeping in this world. No one, no one.

I have said it before.

(City That Does Not Sleep)

হাডসনের অসহনীয় সুন্দরে অবগাহন করতে করতে কেমন ঝপ করে নিদ্রাহীন শহরটায় এসে পড়েছি! জানালার ফ্রেম ভুলে গেলে ওরকম এলোমেলো হয়।

এই জানালাটা নদী ঘেঁষা ট্রেনের। আকাশ পথে যে জানালা থাকে সেখানে মেঘদলে হারাই ভয় নিয়ে- শঙ্কা নিয়ে। আকাশ পথের হাঙ্গামা অনেক। আদতে মনে হয় সময় বাঁচায় কিন্তু মূল যাত্রার আগে পরে যা কিছু ওতে উৎকণ্ঠা আর ক্লান্তি অনেক। আর ইয়ে… আমার এরোফোব আছে।

সে তুলনায় নিউইয়র্ক সিটি থেকে রচেস্টার যেতে সাত ঘণ্টা লেগে গেলেও হাডসন রিভার ভ্যালী, ইরি ক্যানাল অথবা মোহাভক নদীর একাংশ কাছ থেকে দেখতে পাওয়া গেল।

অনুভব করা গেল শুধুই জমাট বাঁধা নীলের বদলে চঞ্চল তরঙ্গ। পশ্চীম নিউইয়র্কের শহর অ্যালবানি, ইউটিকা অথবা স্যেরাকিউযের ওপরেও হালকা নজর বোলানো গেল।

এদিকে ক্লাইম্বার, বায়না, প্রপোজালের খসড়া আর সাদাকালো দিনের মত মানুষের ভেতরে থেকেও নিশুতি দিনে একলা ডুব সাঁতার।

আর কী লাগে?

Leave a Reply