আদিবা আর আমি উর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছি। ছড়িয়ে পড়া মার্বেলের মত বাচ্চা দু’টো খেলার ছলে ছুটে পালিয়ে গেছে। করিডোর পেরোলেই লবি। সামনেই হুশ হাশ গাড়ি আসে-যায়। রিসোর্টের স্যুভেনির শপের সামনে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা দু’জন আমাদের বাঁই বাঁই দৌড় দেখে হতভম্ব, ‘গুডনেস গ্রেশাস! হোয়াই দ্যা লেডিজ রানিং লাইক ক্রেজি?’ ওসব গ্রেশাস ফেশাসের ধার না ধারা রানিং লেডিরা ঠিক শেষ মুহূর্তে তাদের ছানাদেরকে বজ্র আঁটুনিতে আটকে ফেলে হাঁপাতে লাগালো। ডারউইন সাহেবের বাঁদর তত্ত্ব প্রমানের জন্যে এ দুটো বাচ্চাই একশো।

খানিক বাদে ফেরিতে বসে আছি। হঠাৎ দৌড়ের কবলে পড়ে শরীরের মরচে ধরা কলকব্জা ক্যাঁচকোঁচ শব্দে বিচিত্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ভেবেছিলাম, ফেরি বোটে উঠে একটু জিরিয়ে নেয়া যাবে। উল্টো, পোড়া তেলের ভকভকে গন্ধে জান বেরিয়ে যাবার যোগাড়! জায়গা বদলে নেবো, তার উপায় নেই। লোকে একেবারে টইটুম্বুর। নিরুপায় হয়ে ফুসফুসে যথেচ্ছা কালো ধোঁয়া ঢুকতে দিয়ে চারপাশটা দেখছি। ব্লু লেগুন নাম শুনে আগ্রহ জাগছে। জনমানবহীন কোমিনো দ্বীপের বালি সৈকতটা নিশ্চয় অদ্ভূত সুন্দর হবে।

কিন্তু না। যাত্রা আনন্দ মাটি করা কালো ধোঁয়ার সাথে এবার যোগ হয়েছে কথার তুবড়ি। পাশের আসনে তিন বিশাল বপু ভদ্রমহিলা টেবিল চাপড়ে তুফান মেল ছুটিয়ে দিয়েছে। প্রায় একই রকম চেহারা আর গলা চড়ানো বাৎচিত বলে দেয়, তারা খুব সম্ভবত সম্পর্কে মেয়ে, মা আর নানি। তাদের সাথে যথাক্রমে কোমর, হাঁটু আর গোড়ালি সমান বয়সের এক বেচারা ছোকরা। খানিক পরপরই যে কিনা বগল বদল হয়ে তিনজনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে। কান তো বাঁচাতে পারছি না, কিন্তু চোখের উপর এই মর্মান্তিক দৃশ্য এড়াতে আবার সাগরে দৃষ্টি ছুড়লাম।

ব্লু লেগুনে নোঙ্গর করা ফেরি। ছবি সৌজন্যেঃ আহমেদ রুমি

আর তখনই দুর্দান্ত ঘটনাটা চোখে পড়লো। নৌকার গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কনায় ক্ষনিকের রংধনু উঁকি দিয়ে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। যত বড় ঢেউ, তত বড় রঙের ধনুক। ঠিক যেন মরীচিকা দেখছি। এদিকে পানির রঙেও আরেক খেলা চলছে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় তার রঙ পাল্টে যাচ্ছে। গাড় নীল ফিকে হয়ে আকাশ নীল। সেখান থেকে মত বদলে আচমকাই শ্যাওলা সবুজ। সব শেষে আশ্চর্য শীতল ফিরোজা নীলে এসে ঠেকেছে। চেনা জগত পেছনে ফেলে আমরা হুট করে স্বপ্নীল রুপকথার পাতায় ঢুকে গেছি। এই বুঝি জল থেকে রুপালি ঝিলিক তুলে হ্যান্স অ্যাান্ডারসনের মৎস্যকন্যা উঠে আসবে সেই রাজকুমারের খোঁজে। তারপর রাজপুত্রের বদলে ট্যুরিস্ট নামের কতগুলো চক্কর বক্কর হাওয়াই শার্ট চাপানো কিম্ভূত প্রানি দেখে ভয় পেয়ে আবার টুপ্ করে ডুবে অতলে হারিয়ে যাবে।

কল্পনার মৎস্যকুমারীর দুঃখে বড় বড় হাই তুলছি। সম্বিত ফিরে পেলাম ফেরির অল্প বয়সী নাবিকদের তোড়জোরে। কচি মুখগুলো ইন্দোনেশীয়দের সাথে খুব মেলে। শিশুশ্রম আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের বয়স পনেরো-ষোলো। তবে চোখে মুখে শিশুতোষ ভাব নেই এক্কেবারেই। বরং জল ঘেটে ঘেটে পোড় খাওয়া নাবিকের মত চৌকষ তামাটে চেহারা। এরা নোঙ্গর না ফেলেই অভিজ্ঞ হাতে অবলীলায় এক একজনকে প্রায় শূন্যে তুলে পাড়ে নামিয়ে দিচ্ছে। সেদিকটা নিরিবিলি। পানি গভীর। স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্যে লা জওয়াব জায়গাটা। কিন্তু স্বভাবে কাছিম ভাব প্রবল থাকায় আমরা এমন রোমাঞ্চের পরোয়া না করে সৈকতে নামার অপেক্ষায় ফেরিতে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকলাম।

ব্লু লেগুন। ছবি সৌজন্যেঃ আহমেদ রুমি

ফেরি ভিড়লে আমরা হেলেদুলে গড়িয়ে নেমে ঠিক দুই মিনিটের মাথায় একটা ছাতা লাগানো রোদ চেয়ার ভাড়া করে সেখানে কাঁধের বোঁচকা ফেলে ফেলে টিলা বানিয়ে ফেললাম। এই ফাঁকে ছেলেপুলের বাবা দু’জন ইয়া লম্বা এক তোয়ালে পেঁচিয়ে ঝটকা মেরে চোখের নিমেষে সাঁতারের শর্টস পড়ে নিল। তাদের ঝটকা বিদ্যার কাছে পিসি সরকারের ম্যাজিকও ফেল। আদিবাও গোঁড়ালি মুড়ে নিয়ে পা ভেজাতে তৈরি। ব্যস, একজনকে পাহারায় বসিয়ে দিয়ে বাকিরা পানির দিকে রওনা দিল।

সেই একজনটা আমি। চুপচাপ কোমিনো দ্বীপটা দেখছি। কোমিনো নামটা শুনতে জাপানি পোশাক কিমোনো’র মত শোনায়। আসলে নামটা এসেছে Cumin থেকে। বাংলায় যার মানে জিরা। এককালে মাল্টায় প্রচুর জিরা ফলতো দেখে এই কোমিনো নাম। গল্পে-উপন্যাসে দারুচিনি দ্বীপ থাকে। বাস্তবে থাকে জিরা দ্বীপ। ভাগ্যিস ছাতা ভাড়া করা হয়েছিল। নইলে মাঝ দুপুরের কড়া রোদে জিরা টালা হয়ে যেতাম।

হাঁটু পানিতে দাপাদাপি করে বাকিরা ফিরে আসলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমারও দৌড় ঐ হাঁটু পানিই। জগিং ট্রাউজারটা সামান্য গুটিয়ে নেমে পড়লাম। ঝুঁকে পড়ে কতগুলো রঙ্গিন পাথর কুড়াতে চাইলাম। অবাক করে দিয়ে যা উঠে আসলো তার তালিকায় আছে হেনিকেন ব্যান্ডের বিয়ারের ছিপি, চশমার ডাঁট, আর কারো হাফ প্যান্টের অংশবিশেষ। মনের দুঃখে মাতাল হয়ে কেউ বোধহয় চশমা ভেঙ্গে বস্ত্র বিসর্জন দিয়ে গেছে। আসলে গ্রেটা থুনবার্গ মেয়েটা এমনি খঁচে থাকে না। আবর্জনা দিয়ে সাগর ভরাট করা কান্ডজ্ঞানহীন লোকের সংখ্যা বিচ্ছিরিভাবে বাড়ছে। কি বঙ্গোপসাগর কি ভুমধ্যসাগরের মাল্টা। দূষনে পরিবেশ সবখানেই উল্টা-পাল্টা।

দ্বীপটা সবাই মিলে একপাক ঘুরে কতগুলো ডোরাকাটা টিকটিকি আর একটা ভীতু চেহারা আনুবীক্ষনিক বৃশ্চিক আর কোন প্রানির দেখা পেলাম না। পাবোই বা কি করে। ছোট্ট দ্বীপের একপাশে স্যান্ডুইচ-বার্গারের দোকান দিয়ে সয়লাব। আরেক পাশে মালা-পুতি-পোস্টকার্ডের দোকান। তার মাঝে এক লোক রোদ চশমা বেঁচতে বসেছে। একটার দামে দুইটা দেবে। এইসব হট্টগোলের ভেতরে টিকটিকিগুলো যে কানে তুলা গুঁজে পড়ে আছে-এই তো বিরাট আশ্চর্য।

ফেরিতে চড়ে বসলাম একটু বাদেই। আবার সেই ফিরোজা নীল সাগর। আবার শান্তি। গতকাল গুহায় যেতে না পারার আফসোস ঘুচল আজকে। গোটা তিনেক গুহার খুব কাছ থেকে ঘুরিয়ে আনা হল আমাদের। তারপর মাঝ দরিয়ায় জাহাজ বন্ধ করে দেয়া হল। এখন যত খুশি সাগরে দাপাও। জনাকয়েক তাড়াহুড়ো করে জামাকাপড় এদিক সেদিক ফেলে সাঁতারের পোশাকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এদের কাউকে আবার কিলার শার্ক এসে টেনে নিয়ে না গেলে হয়। সেরকম কিছু ঘটলো না। বরং তাদের এক আধজন আবার সাঁতরে পাশের ভীষন উঁচু খাড়ি বেয়ে উঠে টপাৎ টপাৎ ক্লিফ ডাইভিংয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কাছেই একটা ছোট জাহাজ ভাসছে। তাতে একদল তরুন-তরুনী বেজায় হুল্লোড় জুড়েছে। হাতে হাতে কাঁচের গ্লাসে লাল শরাব। প্রচুর পাগলাপানি পেটে পড়ায় তারা বেশ তরল মেজাজে আছে। গলা ছেড়ে গান গাওয়া থেকে শুরু করে অতি আবেগে আমাদের দিকে হাত নাড়ানো, কি এক পাক নেচে দেখানো-সবই চলছে। তাদেরকে দ্রবীভূত অবস্থায় রেখে আমরা বোট ঘুরিয়ে ফিরে চললাম।

সাগরের গায়ে পাথুরে গুহা। ছবি সৌজন্যেঃ আদিবা আমাত

সন্ধ্যা। খিদেয় মন চনমন আর পেট চোঁ চোঁ। হোটেলের হলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ঢোকার মুখে জটলা। এক জার্মান ভদ্রমহিলা ভাল ক্যাঁচাল বাঁধিয়ে দিয়েছেন রিসেপশনের মেয়েটার সাথে। মুশকিল হল, একজন জার্মানে বলছে তো আরেকজন ট্রশ ট্রশ ইংরেজিতে। এইভাবে বাৎচিত চলতে দিলে রাত পুহিয়ে যাবে। ছেলেকে বাবার জিম্মায় দিয়ে যেচে এগিয়ে গেলাম।

ভদ্রমহিলা গত রাতে ছাদে বসে অনেকগুলো বোতল উড়িয়ে এই রিসেপশনে বিল চুকিয়ে গেছেন। আজকেও একই কাহিনী। কিন্তু এখন নাকি তাকে ছাদের রেস্তোরায় গিয়ে বিল মেটাতে হবে। মহিলা আমতা আমতা করলেন, ‘এক রাতে নিয়ম পাল্টে গেল কি করে?’ কিছুটা অধৈর্য্য হয়ে জবাব দিলাম ‘এ তো আপনার জার্মানি না। এখানে নিয়ম কানুন সকাল-বিকাল বদলায়। তার চেয়ে বরং যা বলছে তাই করুন না একটু কষ্ট করে।‘

কথাটা শেষও করতে পারলাম না, কানে আসলো, ‘এ্যাই ও কই গেলো??’ চকিতে ফিরে দেখি ছেলে লা পাত্তা। মুহূর্তের ফসকা গেঁড়ো গলে পাখি উড়ে গেছে। পাখির কথা মনে হতেই ওপরে তাকালাম কি ভেবে। একি কান্ড! একটা ধাতব পোল কি পাইপ বেয়ে সে অনেক উপরে উঠে গেছে। কড়া রকমের চোখ রাঙ্গানি খেয়ে তৈলাক্ত বাঁশের অঙ্ক মিলিয়ে সে চু করে নেমে আসলো। জানে পানি এল বানর ফিরে পেয়ে।

সারাক্ষন ছানাপোনা নজরে রাখতে গিয়ে তিন নাম্বার চোখটায় ক্লান্তি জেঁকে বসেছে। ঢুলুঢুলু চোখে খাদ্যপর্ব সেরে সে রাতের মত কাত হয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

শেষের দিন। আজকে আকাশ কালো। ঝড়ের পূর্বাভাস আছে। বেড়ানোর সুযোগ নেই। কি আর করা, ঘাপটি মেরে অলস কাটিয়ে দেবো। ঘড়ি ধরে ঠিক বেলা একটায় সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল। শহুরে দালানের আড়ালে লুকিয়ে ঝড় দেখা এক জিনিস। আর সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে তান্ডব দেখা আরেক বস্তু। ছাই কালো মেঘ চিড়ে চিলিক্ দিয়ে শাই করে নেমে আসা বাজ পড়া দেখে পিলে চমকে গিয়ে চরম একটা বাংলা গালি বেখাপ্পা মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। সাথে সাথেই জিভ কাটলাম। পাশে দাঁড়ানো হতভম্ব ছেলের বাবার কাছে ভদ্র-শান্ত ঘরের বউ ইমেজটা আজকে কেঁচে গেলো বোধহয়।

উল্টে দেয়া বালি ঘড়ির মত দিনগুলো উবে গেলো যেন। এই ক’টা দিন সাগরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, মর্ত্যের মানুষ ভুল করে স্বর্গের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি। কিংবা একটা ঘোরের ভেতর আছি। ঘোর কাটলেই আবার বালিশের পাশে অ্যালার্মের চিৎকার, চোখে পানির ঝাপটা আর কাজে বেরিয়ে পড়া। পাতার রেলের ভিড় ভাট্টায় চিরেচ্যাপ্টা সেই একঘেয়ে নাগরিক জীবন।

আমাদের নিয়ে গাড়িটা রাত ফুড়ে চলছে। ভোরের আলো ফোটে নি এখনও। একটা দু’টা অফিস-আদালত জেগে উঠছে আড়মোড়া ভেঙ্গে। হলদে সোডিয়ামের পথঘাট অনেক দূরের আরেক চেনা শহর বলে ভ্রম হয়। ভিন দেশটার জন্যে সোডিয়াম আলোর মতই কোমল উষ্ণতা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি আপন ডেরায়। কমলা রোদের দেশ মাল্টার মিষ্টি স্বাদটা মনে থেকে যাবে বহু দিন। (সমাপ্ত)

-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
গবেষক, ইন্সটিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

2 thoughts on “কমলা রোদের মাল্টা-৩”
  1. ম্যামের লেখার হাত খুব চমৎকা!
    ম্যামের কাছে একটা অনুরোধ রাখছি, মাইক্রোবায়োলজি তে অনার্স শেষে জার্মানি তে উচ্চশিক্ষার সুজোগ মানে কোন কোন বিষয়ে পড়া যাবে এবং কর্মক্ষেত্র বিষয়ক একটা পোস্ট লেখবেন। এই অসাধারণ সাইটে মাইক্রোবায়োলজি বা বায়োলজি ফিল্ড নিয়ে খুব ভালো তথ্য পেলাম না।
    অগ্রীম ধন্যবাদ ম্যাম!

Leave a Reply to Shohel Rana Cancel reply