জার্মানি আর জার্মান জীবনের অজানা কথনঃ স্নো হোয়াইট, আইনস্টাইন আর বিয়ার প্রেমীদের দেশে (পর্ব-২)

সামার আর উইন্টারের ভিন্নরুপ
সামারের জার্মানি আর উইন্টারের জার্মানি যেন দুটি সম্পুর্ণ আলাদা দেশ। চারদিকে সবুজ পাতা, রাস্তাঘাট আর সর্বত্র প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা মানুষজন,নিরবিচ্ছিন্ন অপার নীল আকাশ আর রোদেভরা দিন নিয়ে জার্মান সামারের সৌন্দর্য কখনো কখনো নেশা ধরিয়ে দেয়। সামারের দিনগুলোও হয় অনেক দীর্ঘ। রাত সাড়ে দশটা/এগারোটায় সূর্য ডোবে তখন। সামার যদি হয় সূর্যভরা সুন্দরের উৎসব, তবে জার্মান উইন্টার হবে সূর্যহীন এক বিষন্নতার গান। গত উইন্টারে আমার এরিয়াতে সর্বসাকুল্যে ৪/৫ দিন সূর্যের মুখ দেখেছিলাম। শুধু রোদ না থাকলে সমস্যা ছিলো না। ৩/৪ ডিগ্রি তাপমাত্রার কনকনে ঠান্ডার সাথে দিনরাত অবিরাম পড়তে থাকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি নিয়ে জার্মান উইন্টার সত্যিই এক বিরক্তিকর সময়। উইন্টারের দিনগুলোও হয় অস্বাভাবিক রকম ছোট। চারটার মধ্যেই নেমে আসে সন্ধ্যা। সব গাছের পাতা ততোদিনে উধাও। তবে জার্মানিতে গাছের পাতার সবচেয়ে সুন্দর রুপ আমি দেখেছি ফল বা অটামে। অক্টোবরে শীতে শুরু হওয়ার আগে অল্প সময়ের জন্য সব গাছের পাতা লালচে হলুদ রঙ ধারণ করে যা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। জার্মান উইন্টারের রুক্ষমূর্তি থেকে এক পশলা মুক্তি মিলাতে আসা স্নো ফল। বরফের সাদা চাদরে ঢেকে যাওয়া শুভ্র দিনগুলোই শীতের সেরা সময়।প্রথমবার স্নো ফল দেখার অনুভূতি আমাদের বাংলাদেশিদের জন্য সবসময়ই বিশেষ কিছু।সুন্দরের পসরা সাজিয়ে বসা জার্মান সামারে আপনার বাইরে থেকে ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করবে না আর সূর্যহীন অবিরাম বর্ষণে ভরা জার্মান উইন্টারে প্রয়োজন থাকলেও আপনার ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে ইচ্ছে করবে না।

ইমেইল নয়, মেইল
জার্মান লাইফের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বাসার সামনের মেইলবক্স। চিঠির বাক্স নিয়মিত চেক না করলে আপনি বঞ্চিত হবে গুরুত্বপূর্ণ সব অফিশিয়াল কাজ থেকে। ইমেইলের ব্যাবহার থাকলেও জার্মানরা গুরুত্বপূর্ণ সব ব্যাপারে মেইল বা চিঠি ব্যাবহার করতেই পছন্দ করে।বাংলাদেশে যেখানে চিঠির ব্যবহার না হওয়ায় ডাক বিভাগ আজ বিলুপ্তির পথে সেখানে চিঠি ছাড়া আপনি জার্মান লাইফ কল্পনাও করতে পারবেন না।

স্পিড লিমিট বিহীন হাইওয়ে ‘অটোবান’
জার্মানিই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে আপনি পাবেন স্পিড লিমিট বিহীন হাইওয়ে, জার্মান ভাষায় যার নাম অটোবান।আমি অনেক আমেরিকানদের কথা শুনেছি যাদের অন্যতম একটি স্বপ্ন হলো জার্মানিতে এসে এই অটোবানে গাড়ি চালানো। আদতে জার্মান অটোবানের পুরো অংশ স্পিড লিমিট মুক্ত না হলেও এর একটা উল্লেখযোগ্য অংশেই আপনি ইচ্ছা করলে অবমুক্ত করতে পারেন আপনার গতির ক্ষুধা। তবে জার্মান অটোবান নিয়ে যে কথাটা প্রচলিত তা হলো- এখানে আপনি যতো জোরেই গাড়ি চালান না কেন কেউ না কেউ অবশ্যই আপনাকে ওভারটেক করে যাবে।

ডাংকে, বিট্টে আর যতোসব গ্রিটিংস
জার্মানরা ঠিক কতোটা ভদ্র জাতি আপনি বুঝতে পারবেন যখন পিছন থেকে সম্পুর্ণ অজানা অপরিচিত কারো কাছ থেকে শুনবেন- ডাংকে শুন বা অসংখ্য ধন্যবাদ। এই ধন্যবাদ পাওয়ার কারণ আবিষ্কার করতে আপনার বিলম্ব হলেও আপনাকে ধন্যবাদ দিতে ওরা বিলম্ব করবে না। হয়তো ট্রেনের মধ্যে ভীড়ে দাঁড়িয়ে একটু হাঁচি দিলেন। সাথে সাথে পাশ থেকে অন্য যাত্রীদের কেউ কেউ উচ্চস্বরে
‘গেসুন্ডহাইট’ বলে আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করবে। মুখে সর্বদা হাসি না থাকলেও গ্রিট করতে জার্মানরা কখনো কার্পণ্য করে না। প্রায় সব পরিস্থিতির জন্য ওদের আছে আলাদা আলাদা গ্রিটিংস। অফিস, কর্মক্ষেত্র, দোকানপাট, ইউনিভার্সিটি, যানবাহন যেখানেই থাকেন না কেন দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আপনি অসংখ্যবার শুনবেন এসব জার্মান গ্রিটিংস। আমার মতো সব গ্রিটিংসের অর্থ না বুঝলেও কেউ যদি ‘ডাংকে’ বলে হাসিমুখে উত্তরে ‘বিট্টে’ বলতে ভুলবেন না।

বইপোকাদের দেশ
আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেনে উঠে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে চারদিকের কোলাহল আর মানুষের কথোপকথনের মধ্যে প্রায়ই লক্ষ্য করবেন কেউ মনযোগ দিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। কিন্ডল আর ই-বুকের এই যুগেও কাগজের মলাটের বইয়ের প্রতি জার্মানদের ভালোবাসা একটুও কমেনি। বই পড়ার প্রতি এই ভালোবাসা থেকেই এখনো প্রতি বছর জার্মানিতে প্রায় ৯৪ হাজার বই প্রকাশিত হয় যা পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি। বই কিনে যে দেউলিয়া না হয়ে উল্টো সব দিক দিয়ে সমৃদ্ধ হওয়া যায় পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানি বুঝি এরই প্রমাণ দেয়।

কালো নয় নীল কালিতে লেখা
ইউনিভার্সিটির ক্লাসে গিয়ে প্রথম যে ছোট একটি বিষয় আমার কাছে কিছুটা অবাক লেগেছিলো তা হলো নীল কালির প্রতি জার্মানদের ভালোবাসা। বাংলাদেশে যেখানে পরীক্ষা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কালো কালির কলম ছাড়া অন্য কালার ব্যবহার করা যাবে কিনা তা জেনে নিতে হয় সেখানে জার্মানিতে কালো কালির কলমের ব্যবহার কদাচিৎ চোখে পড়ে। ক্লাসের নোট, পরীক্ষার খাতা কিংবা অফিসের ফাইল সব জায়গায়ই দেখা যাবে জার্মানদের প্রিয় নীল কালির কলমের লেখা।

সঠিক জায়গায় দাঁড়িয়েছেন তো?
পিছন থেকে যদি কোনো স্ট্রেঞ্জারের হাক শুনতে না চান তবে জার্মানিতে আপনার দাঁড়ানোর বা হাঁটার সঠিক জায়গা বুঝে নিন। এস্কেলেটরে উঠে কখনো বাম পাশে দাঁড়াবেন না। ঠিক সময় মতো ট্রেন ধরার তাড়া বা কাজ থাকা মানুষদের বিহ্বল দৌড় বা হেঁটে চলন্ত সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠাকে ব্যাহত না করার জন্য সব সময় এস্কেলেটরের বাঁ পাশটা
রেখে দেওয়া হয়। একইভাবে ফুটপাত বা পেভমেন্টে হাঁটার সময় দ্রুতবেগে ছুটে আসা কোনো বাইসাইকেল আরোহীর বিরক্তির কারণ না হতে চাইলেও ভালো করে খেয়াল করে হাঁটুন। হাঁটার রাস্তা আর বাইসাইকেল লেন পাশাপাশি হলেও মার্ক খেয়াল করলে সঠিক পথ চিনে নিতে কষ্ট হয় না।

বিয়ার প্রেমী জাতি
জার্মানদের বিয়ার প্রেমের সাথে শুধু তুলনা হতে পারে আইরিশদের বিয়ার আসক্তির।জার্মানদের বিয়ার প্রেম দেখতে হলে আপনার কোনো বার বা পার্টিতে যেতে হবে না।শুক্রবার আর শনিবার রাতে জার্মানির ট্রেনে চড়লে কিংবা গভীর রাতে রাস্তায় হাঁটাহাটি করলে চারদিকে বিয়ার হাতে ড্রাংক লোকজনের সংখ্যা দেখলে আপনি সহজেই তা অনুধাবন করতে পারবেন। জার্মানি এমন এক দেশ যেখানে প্রকাশ্যে ধুমপান করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ কিন্তু প্রকাশ্যে বিয়ার পানে কোনো বাধা নেই। জার্মান বিয়ারের স্বাদের খ্যাতিও বিশ্বজোড়া। প্রায় প্রতিটি শহর আর অঞ্চলের নিজস্ব ফ্লেভার আর নিজস্ব ব্র‍্যান্ডের বিয়ার থাকায় শুধু জার্মানিতেই আপনি পাবেন প্রায় ১৫০০ বিয়ার ব্র‍্যান্ড। জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যে বিয়ারকে অফিশিয়ালি একটি ফুড হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই বাভারিয়ার রাজধানী মিউনিখেই প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফোক ফেস্টিভ্যাল ‘অক্টোবর ফেস্ট’। ১৮১০ সাল থেকে শুরু হওয়া ১৬-১৮ দিন ব্যাপি এই ফেস্টিভালে জার্মানি ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় দেড়লক্ষ মানুষ একসাথে বিয়ার পান করে। মিউনিখ থেকে কিছুটা দূরে থাকায় পড়াশোনা,কাজের চাপ আর অন্যান্য ব্যাস্ততায় বেশ কয়েকবার টিকিট কেটেও প্রায় পঞ্চাশ/ষাটলক্ষ মানুষের এই উৎসবে এখনো যেতে পারিনি বলে গ্লাসভর্তি বিয়ার নিয়ে লক্ষ মানুষের একসাথে ‘প্রোস্ট’ বলে একই গানের সুরে নেচে উঠার বিচিত্র দৃশ্য এখনো দেখা হয়নি আমার।

(এবারো শেষ করতে পারলাম না। আশা করি আরেকটি লেখায় জার্মান জীবনের খুটিনাটি অভিজ্ঞতার গল্প শেষ করতে পারবো)

mm

By Nazmul Hasan Khan Ashis

I am a masters student in Germany who's studying English literature. I am a traveller and amateur filmmaker. I write occasionally only to unburden myself from the agony of carrying some persistent thoughts.

Leave a Reply