ক্লাস টু-তে পড়ি। শীতকাল। ফুলার রোডের টিচার্স কোয়ার্টারের মাঠে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা চলছে। কার সাথে খেলে যেন গো-হারা হারছি। কোর্টের বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দুইটা বাদামী কবুতর অস্থির পায়চারিতে ব্যস্ত। নাম বাবিন আর বাবলি। উড়তে তাদের বেশি ভালো লাগে না। ভালো লাগে পিছু পিছু হাঁটতে কিংবা ডিমে তা দেয়ার ভঙ্গিতে কাঁধে বসে থাকতে। খেলা শেষে হাঁপাতে হাঁপাতে তাদের ইশারায় ডাকলাম। টায়রা দুলিয়ে দু’জন হাঁসের মত হেলেদুলে দৌড়ে এল। একজন টপ করে কাঁধে চড়ে বসলো, আরেকজন সমান গতিতে পা মিলিয়ে হাঁটছে।

পোষা পাখির এত দূর পোষ মেনে যাওয়ায় পাখির মালকিন আমি আলহ্বাদে আটখানা। তার উপর বাবা-মা বাসায় নেই। তারা নানির জিম্মায় ছেলেমেয়ে রেখে সপ্তাহখানেকের জন্যে বন্যপ্রানির উপর এক কনফারেন্সে ভারতের দেরাদুনে গেছে। সেই সুযোগে আমরা দুই ভাইবোন নিজেরাই বন্যপ্রানি হয়ে উঠছি। একজন কাঁধে কবুতর নিয়ে পাড়াময় ঘুরে বেড়াই। আর ক্লাস নাইনে পড়া বড়জনেরও বেশ পাখা টাখা গজিয়ে গেছে। সন্ধ্যার আগে তার টিকির দেখা মেলে না।

এহেন অবস্থায় বেশির ভাগ সময়ে নানি আসিয়া খাতুনকে খাস বরিশালের ভাষায় উচ্চকিত কন্ঠে অদৃশ্য কাউকে শাপ-শাপান্ত করতে দেখা যায়। ‘পিঠ পাচাইয়া কেনু (বাংলা মাইর) একখান দেলে বোজবাআনে মনু। কইতর কান্ধে ঘোরে। কইতর না য্যান একেকডা মুরহা‘। মৃদু প্রতিবাদ করি, ‘নানি, কেনু দিলে কিন্তু আম্মুকে বলে দিব। আর প্লিজ আমার কবুতরকে মুরগি বলবেন না‘। লাভ হয় না সচারচার। উত্তরে উল্টো শুনতে হয়, ‘ওয়া মোর আল্লাহ তা’আলা, মুরহা-কইতর লইয়া কোম্মে যে মুই যাই.. হালার পালা (হালার পো হালা) পোলাপান মোরে বোগদা পাইসে…’। সেই সাথে পোলাপান কর্তৃক এত অত্যাচারের পরও তার কপালে কেন ‘ঠাডা’ পড়ছে না তাই নিয়ে মিহি সুরে বিলাপ চলতে থাকে।

নানির হাতে চব্বিশ ঘন্টা গরম খুন্তি থাকে। তাই তাকে বেশি ঘাটাই না। তবে কথাগুলো প্রায় মুখস্থ হয়ে এসেছে। বিশেষ করে হালার পা’লা। সব মিলিয়ে আঠারোটা কবুতরকে লাইনে রাখতে গালিটা ভাল কাজে দিচ্ছে। নানির মেজাজ বাই পোলার ধাঁচের। এই ঠান্ডা তো এই গরম। মেজাজ ঠান্ডা হলে নানি দুয়েকটা ‘কইতর’টাকে বাটার জুতার বাক্সে বসিয়ে নিয়ে আসেন। আমিও আস্তে করে বাক্সটা মাথার কাছে রেখে ঘুমিয়ে যাই। শীতের মাঝরাতে কবুতর বাক্স ডিঙ্গিয়ে বিড়ালের মত লেপের ওমে হানা দেয়। বাসার বিশাল একটা বারান্দা আমার পাখিদের জন্যে বরাদ্দ। রেডিও, টেলিভিশনের কার্ডবোর্ডের বাক্স বেঁধে তাদের ঘর বানিয়ে দেয়া হয়েছে। লাই পেয়ে পেয়ে কবুতরের সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে এখন দেড় ডজন। সকালের আলো ফুটতেই বাকবাকুম রবে তাদের পুরো ব্যাটেলিয়নটা তাদের ব্যারাকে, মানে বারান্দায় এক দফা লেফট-রাইট ঠুকে নেয়।

আজকে আমিও তাদের দলে আছি। তবে ভিন্ন কারনে। ছড়া আওড়াচ্ছি। পাড়ায় বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে কাজী নজরুলের ‘প্যাঁচা’ শুনিয়ে আসতে হবে। মা যাবার আগে পাখি পড়া করে শিখিয়ে পরিয়ে দিয়ে গেছে। ছড়াটা নাকি নজরুল সাহিত্যের সেরা সৃষ্টি। প্যাঁচার উপর বিস্তর গবেষনা করা প্রানিবিদ মায়ের তাই ধারনা। যদিও আমার কিঞ্চিত দ্বিমত আছে। তো, ছড়ার ফাঁক ফোকরে বুদ্ধি করে ইম্প্রোভাইজেশন হিসেবে হালকা অভিনয় জুড়ে দিয়েছি। সেটারই ঝালাই চলছে।

‘ঠ্যাং চ্যাগাইয়া প্যাঁচা যায়/যাইতে যাইতে খ্যাঁচখ্যাচায়’ 
‘প্যাঁচায় গিয়া উঠল গাছ/কাওয়ারা সব লইল পাছ’
– এখানে সামান্য অভিনয়। একটু উদ্বাহু হাউ মাউ মানে প্যাঁচা গাছে উঠে গেছে। তারপর ডানা ঝাঁপটে ধেয়ে আসা মানে কাক পিছু নিয়েছে। নিজেই প্যাঁচা, নিজেই কাক। দ্বৈত চরিত্র। প্রতিভা দেখানোর সুযোগ প্রতিদিন আসে না। 
‘প্যাঁচার ভাইস্তা কোলাব্যাঙ/কইল চাচা দাও মোর ঠ্যাং’- টেংরি ভাঙ্গা লুলা ভাইস্তা হিসেবে পাড়ার কোনো ছেলেকে ভুজুং দিয়ে পটাবো নাকি ভাবছি।

যাহোক, ছড়া ঠোটস্থ হয়ে গেছে। শুধু সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, আবৃত্তির সময় লুকিয়ে একটা দুইটা কবুতর নিয়ে যাব কিনা। এরা সাথে থাকলে ভরসা লাগে। কিন্তু মঞ্চে আচমকা উড়ে গিয়ে কারো গায়ে পড়লে ঝামেলা বাঁধতে পারে। সুতরাং, এই চিন্তা বাদ দিতে হল। সন্ধ্যায় কবুতর ছাড়াই ঢিপঢিপ বুকে মঞ্চে উঠলাম। ভালোই চলছিল। কিন্তু গোল বাঁধলো শেষের কয়েক লাইনে। ‘প্যাঁচায় কয় বাপ, বাড়িতে যাও/পাছ লইছে সব হাপের ছাও’। হাপের ছাওয়ের পরের লাইন বেমালুম ভুলে গেলাম। ইঁদুর জবাই কইর‌্যা খায়/বোঁচা নাকে ফ্যাচফ্যাচায়’-এই অতি কাব্যিক পংক্তিটা আর মনে পড়ছে না। ঘেমে নেয়ে বার কতক এ্যাঁ এ্যাঁ করে শেষমেষ নিজেই একটা হাপের ছাও হয়ে মঞ্চের পেছনের পর্দায় ঝুলে পানির ফোঁটার মত চুইয়ে নেমে যাবার তাল করছি। শেষ মুহূর্তে হঠাৎ আরেকটা র‍্যান্ডম ছড়ার দুই লাইন মনে পড়ে গেল। ‘শেয়ালের ল্যাজ, গোটা দুই প্যাঁচ’ আর কি সব গাঁজাখুরি আউড়ে ইজ্জতের দফা রফা হবার আগেই দিলাম এক চম্পট।

তারপর থেকে কিরা কাটলাম যে, কবুতর ছাড়া কোথাও যাওয়া যাবে না। এরা আমার আত্মবিশ্বাসের চাবিকাঠি। কিন্তু লোকে ভাবে এক, হয় আরেক। একদিন মায়ের সাথে স্কুল থেকে ফিরে দেখি ঘরটা দেখি বেশি বড়সড় আর ছিমছাম লাগছে। যেন কেউ জঞ্জাল সরিয়ে সব গুছিয়ে রেখেছে। মনটা বেশ ফুরফুরে লাগলো। কিন্তু মা বলল, বাসায় চুরি হয়েছে। ফ্রান্স থেকে সাধ করে নিয়ে আসা টাইপ রাইটার থেকে শুরু করে হাল মডেলের ক্যামেরা-সব লোপাট। ছুটা বুয়া নুরবানু ও তার দল কাজটা খুব দ্রুততার সাথে সুচারুভাবে করেছে। মাল-সামাল সরিয়ে নুরবানু শেষবারের মত মায়া করে বোধহয় ঘর ঝাট দিয়ে মুছেও গেছে। পুলিশে নালিশ করলে মাস খানেক বাদে এটুকু তথ্য ছাড়া আর কিছু জানা গেল না। এই ঘটনার পর তড়িঘড়ি করে বাসা বদলের তোড়জোড় শুরু হল।

একই পাড়ায় আরো বড় বাসা পাওয়া গেল। সেটা এত বড় যে অনায়াসে ক্রিকেট খেলা যাবে। তবে সমস্যা আছে। কবুতর নেয়া যাবে না। এরা খালি বাসায় কয়েকদিন বসে থেকে এদিক ওদিক উড়ে চলে যাবে। কোন ব্যাপার না। এই সিদ্ধান্তে নানি বেজায় খুশি। সে এই সুযোগে শালুনের হুররা (তরকারির ঝোল) রাঁধার জন্যে গোটা কয়েক কবুতর চেয়ে বসলো। চালের রুটির সাথে দারুন জমবে। সব দেখেশুনে অধিক শোকে পাথর হয়ে পাখির মায়া ত্যাগ করতে রাজি হলাম। শুধু শর্ত হল, কবুতর খাওয়া যাবে না। কালী, রাজা, পাফিন, ফ্যাশফ্যাশ, কুটুনী ওরা সবাই আমার বন্ধু। বন্ধুকে মেরে খাওয়া অবান্তর চিন্তা।

কবুতরগুলোর কেউ নানির শালুনের হুররা হয়েছিল কিনা সেটা বলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে ছোট মানুষকে কেউ পাত্তা দেয় না। দুঃখজনক সত্য। নতুন বাসায় আমি মন খারাপ করে ঘুরি। স্কুলের পর ফিরে অজান্তেই চোখ চলে যায় দূরের দালানের কার্নিশে। সেখানে চলে বদখত দাঁড় কাক নয়তো বাচাল শালিকের আড্ডা। কিন্তু এক দুপুরে ঘটল আজব ঘটনা। দূর কার্নিশে দুধ সাদা কুটুনী আর দাবার ছকের মত সাদাকালো ফ্যাশফ্যাশকয়ে দেখতে পেলাম যেন। ভাল করে চোখ কচলে আবার তাকালাম। তারপর চেঁচিয়ে, লাফিয়ে, হাত নেড়ে, গামছা-তোয়ালে উড়িয়ে যেভাবে পারি ডাকতে থাকলাম। বাড়ির সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে কবুতরের জোড়াটা উড়ে এসে টান বারান্দার গ্রিলে বসলো।

পুরানো বন্ধু ফিরে পেয়ে কত কি যে সেদিন তাদের বলেছিলাম, আজকে সে সব আর মনে নেই। শুধু মনে হয়েছিল, তাদেরকে ঠিক মত বিদায় বলে আসা হয় নি। বরং চোরের মত লুকিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু পশুপাখির সৌজন্যতাবোধ প্রখর। তারা তাই একবার ভাল করে বিদায় নিতে এসেছে। কিন্তু ঐ এক দিনই। এরপর আর মেলে না নোটন নোটন পায়রাগুলোর দেখা। কার্নিশ জুড়ে আবার সেই গম্ভীর কাক-শালিকের ভিড়। তবুও শেষ বিকেলের ঘোর লাগা আলোয় ছোট্ট মনের কল্পনায় এক আধটা সফেদ পালক উড়ে ঘুরে দূরে হারিয়ে যায়। সে খবর কেউ জানলো না।

-ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার,

গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

4 thoughts on “কবুতর কাহিনি”
  1. কি জানি কি হয়েছে, মন খুব খারাপ ছিল, মুখ চেপে মন উজার করে হাসতেছিলাম, মন ভালো হতে হতে শেষ প্যারায় এসে যেই লাউ সেই কদুই রয়ে গেল…

  2. ঠিক, কিছুটা ভেজিটেবল লেখা। শুনেছি এর লেখক ইদানীং হালে পানি না পেয়ে মনের দুঃখে দুই নম্বরি লেখা লিখছেন।

  3. আপনার লেখাগুলো পড়ি। খুব সাবলিল ভাবে লেখেন। দৈনন্দিন বিষয়গুলো এত সুন্দর ভাবে লিখেন পড়লেই ভাল লাগে।

Leave a Reply