১.
বছর খানেক আগের কথা। মুখ ভচকিয়ে ল্যাবে ঘুরে বেড়াই। কাজে যুত করতে পারছি না। দেড় বছরের কাজ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আবার নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছি। পিএইচডি নামের এই সুড়ঙ্গের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। কাজটা ফুসফুসের ক্রনিক রোগ নিয়ে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিড়ি-সিগারেট ধরিয়ে ইঁদুরের বাক্সের সামনে বসে থাকি। বেচারাদের ফুসফুসের বারোটা বেজে গেলে তাদের কেটেকুটে চলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই করে করে জীবন চিরতার মত তিতা হয়ে যাচ্ছে।
তেমনি একদিন সকাল। খিটখিটে মেজাজে ল্যাবে ঢুকেছি। দুনিয়াদারি চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কে জানত এমন একটা খবর অপেক্ষা করছে আজকে। ‘ও মাগো’ বলে গালে হাত দিয়ে ধপ্ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। কিছুটা নাটুকে হয়ে গেল বোধহয়। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও অকৃত্রিম প্রতিক্রিয়াটা লুকানো গেল না। তুর্কি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম কিছু একটা উত্তর শোনার অপেক্ষায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বাংলা ‘ওমা গো’ সে বুঝতে পারে নি। ভেবেছে খুশিতে খাবি খেয়ে হেঁচকি তুলেছি।
কাহিনী হচ্ছে গিয়ে, আমার হেঁজিপেঁজি রদ্দি মার্কা কাজটা কিভাবে কিভাবে যেন আমেরিকান থোরাসিক সোসাইটির কনফারেন্সের ‘বেস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট’ বিভাগে প্রথম হয়েছে। বিশাল বড় পরিসরের কনফারেন্সটা এ বছর পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগোতে। সব শুনে আনন্দে ফড়িং নাচ দেয়ার বদলে কেমন দুঃখ দুঃখ লাগছে। কারন, এমন দারুন সুযোগ পেয়েও হারাবো। প্রথম কথা, মাত্র চার সপ্তাহের ভেতরে জার্মানি থেকে আমেরিকার ভিসা পাব কিনা কঠিন সন্দেহ আছে। দুই নম্বর হল, খরচে কুলাবে না। ট্যাঁকের পয়সা ফেলে পাগলেও কনফারেন্সে যায় না। বাকি থাকে তুর্কি বদান্যতা। কিন্তু সেও বলে দিয়েছে হাতে টাকা নেই। রিসার্চ গ্রান্টের খরা চলছে। এদিকে প্রাইজ মানিতেও চিড়া ভিজবে না। প্লেনের টিকেট হবে টেনেটুনে। কিন্তু হোটেল আর হবে না। হোটেলের অভাবে রাতে ফুটপাথে চিৎ কাৎ হয়ে কাটিয়ে দিতে হলে মুসিবত।
কথাগুলো আহমেদ সাহেবকে রাতে খাবার টেবিলে পিনপিনিয়ে বলে স্বান্তনা আদায়ের চেষ্টা চালালাম। বছরখানেক হল এই ভদ্রলোকের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চেপে বসেছি। বিনিময়ে তার পদবীটা নিজের নামের সাথে জুড়ে নেবার সৌজন্যতাটুকুও করি নি। বরং বারো হাত চওড়া সরকারী নামটাই বহাল রেখেছি। তো সিন্দাবাদের ভূত দিন কয়েকের জন্যে বিদায় হবার সূক্ষ্ণ সম্ভাবনা দেখে স্বান্তনার বদলে বিরাট উৎসাহ দিয়ে বুদ্ধি বাতলে দেয়া হল যেন রিসার্চ সেন্টারের লুকানো চুরানো কোনো ফান্ড আছে কিনা তার খোঁজ নেই। আহমেদ সাহেবের ভূত তাড়ানোর দোয়া কবুল হল কিনা জানি না, কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে ব্যবস্থা একটা হয়েই গেল। ভিসাও বাকি থাকলো না। এক ভোরে আলো ফোঁটার আগেই চামবাদুড়ের মত ডানা ঝটপটিয়ে উড়াল দিলাম আটলান্টিক নামের বড় পুকুরটার ওপাড়ে।
একাবোকা যাচ্ছি। সঙ্গী সাথী শূন্য। যাওয়া একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক হওয়ায় এই দশা। ল্যাবের সব কলিগদের বন্দোবস্ত মাস খানেক আগেই করা ছিল। তাদের ফ্লাইট, হোটেল সব আলাদা ব্যবস্থা। একদিন আগেই তারা হল্লা করে দল বেঁধে রওনা দিয়েছে। গিয়ে একটু ধাতস্থ হতে পারবে। আর আমি পৌঁছানোর পরের দিনই পড়িমড়ি করে ছুটবো কনফারেন্সে যোগ দিতে। জেটল্যাগ হলেও কিছু করার নেই।
আটলান্টায় ট্রানজিট। এয়ারপোর্টে দোজখের গরম। তার উপর ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন দেখে অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। পরের ফ্লাইট ছুটে যাবে না তো? ভাবতে ভাবতে ঘেমে কুলুকুলু হয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম। এদের সন্দেহপ্রবন সিস্টেম আবার কাঁধে পোস্টারের খাপকে রকেট লঞ্চার ভাবে কিনা, তাই আলপটকা নামিয়ে ফেলতে গেলাম। তড়িঘড়িতে শক্ত প্লাস্টিকের খাপটা মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পুরানো নকিয়া ফোনের মত তিন টুকরো হয়ে তিন দিকে ছড়িয়ে পড়লো। ঘাবড়ে গিয়ে আমি পুরো হাঁ। বোয়াল মাছ লেভেলের হাঁ দেখে অফিসারের মনে দয়ামায়া হল বোধহয়। হাত বাড়িয়ে ধরা কাগজগুলো নিয়ে বললেন, ‘তোলো তোমার জিনিস আস্তে ধীরে, আমি কাগজ দেখি ততক্ষনে’।
উবু হয়ে পোস্টার গুছিয়ে নিয়েছি, ভদ্রলোক সহাস্যে বললেন, ‘আরে তুমি দেখছি ইঁদুরের ডাক্তার।‘ মৃদু প্রতিবাদ করতে গেলাম, ‘কোন দুঃখে ইঁদুরের ডাক্তার হতে যাবো? আমি বায়োলজির ছাত্র। ইঁদুর আমার গবেষনার মডেল মাত্র’। লাভ হল না, তবে পার পেয়ে গেলাম এই দফায়। ইঁদুরের ডাক্তারের তকমা গলা ঝুলিয়ে দৌড় দিলাম পরের প্লেনটা ধরতে। পোস্টার খাপের গলাটা এবার দু’হাতে ক্যাঁক করে চেপে ধরেছি। বেচারার দম বলে কিছু থাকলে যেকোনো সময়ে ঠুস্ করে বেরিয়ে যেতে পারে।
২.
দুই কদম হাঁটতেই দেখি মোটাসোটা এক ভদ্রলোক চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একটা থাম্বা থাবড়ে ক্রমাগত আউড়ে যাচ্ছেন, ‘ট্রানজিটের যাত্রী বামে যাবে, ট্রানজিট বামে…’। ধরন ধারন পুরোপুরি গাবতলীর বাস কন্ডাক্টরের মত। ট্রানজিট বামে না বলে ‘আয়া পড়েন, সিট খালি, ডাইরেক্ট গুলিস্তান…আয়া পড়েন…’ বললেই বেশি মানাতো। যাহোক, বাস, থুক্কু প্লেন কন্ডাক্টরের কথা মেনে শ’খানেক লোকের সাথে পা মিলিয়ে বামেই ছুটলাম।
ঝামেলা ঝামেলা লাগছে। প্রথম ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেয়া স্যুটকেস খুঁজে নিয়ে পরের বিমানে চেক ইন করতে হবে। ল্যাও ঠ্যালা! এত দৌড়াদৌড়ি কচ্ছপ গতির আমার সাথে যায় না। অন্য সময়ে যাত্রাপথে কেউ না কেউ সাথে থাকে। আমি শুধু নিশ্চিন্তে ঝিমাতে ঝিমাতে পিছু পিছু যাই। সেখানে আজকে নিজের বুঝ বুঝে নিয়ে হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হচ্ছে। আবার এতো প্যারার ভেতরেও চোখ ভেঙ্গে ঘুম আসছে। বেশি টেনশনে কাজ করলে খালি ঘুম পায়। জীবনের যাবতীয় পরীক্ষার ভোরে বন্ধুরা যখন আখেরি চোখ বুলানো বুলাতো, আমি তখন প্রচুর টেনশনের কারনে নাক ডেকে বালিশ আঁকড়ে সিন্ধুঘোটকের মত ঘুমাতাম। আজকেও তেমনি একটা ঘুম দিয়ে টেনশন-ফেনশন বাইপাস করে দিতে ইচ্ছা করছে।
ঘুমটা আমি দিয়েই ফেললাম। তবে পরের প্লেনটা ধরার পর। বরফকুঁচি দেয়া এক গ্লাস টমেটোর জুস আর এক মুঠ বাদাম চিবিয়ে ইকোনমির সিটে যতদূর সম্ভব হাত-পা ছড়িয়ে, গা এলিয়ে টপ্ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
এক ঘুমে একঘেয়ে উড়াল পথ পাড়ি দিয়ে সান ডিয়াগো বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। বিকালের নরম রোদ মুখে এসে পড়েছে। অপেক্ষাটা তাই খারাপ লাগছে না। দাঁড়িয়ে আছি ইউনিভার্সিটির বন্ধু মাহদির জন্যে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চালু হওয়া জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগে আমাদের ব্যাচে মাত্র তেরো জন ছিলাম। সেই থেকে সবাই হরিহর আত্মা। মাহদি বিভাগের তুখোড় ছাত্র। পিএইচডি করে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইন্সটিটিউটে। পেপারের সংখ্যা তখনই কয়েক ডজন। সব হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর। আমার ধারনা বছর খানেকের ভেতর সে “বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর অভাবনীয় আবিষ্কার” ধরনের শিরোনাম হবে পত্রিকার পাতায়। সাথে বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুনের ছবি। তখন পরিচিত মহলে আমি সেই খবর ভাঙ্গিয়ে ভাব নেবো, ‘’আরে আমার ক্লাসমেট তো। কার্জন হলের কত চা-সিঙ্গাড়া খেয়েছি একসাথে…’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আসার খবর মাহদী আগে থেকেই জানে। প্লেন থেকে নামার আগেই সে পার্কিং লটে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। ফোন পেয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘নড়বে না একদম, আসছি‘। পৃথিবী জুড়ে বন্ধুবান্ধব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার সুবিধা অনেক। পাঁচ মিনিটের মাথায় চিকন ধূলার পরতে ঢাকা আপাত ধূসর একটা টয়োটা এসে দাঁড়ালো। বলেই তো নিয়েছি গাড়ির মালিক তারছেড়া বিজ্ঞানী টাইপ লোক। ধূলা মোছার ফালতু সময় তার নেই। গাড়িতে উঠে শুরু হল বেদম হাঁচি। হাঁচির তোড়ে ছোটখাট একটা বালিঝড় বয়ে গেল। রাগি চোখে তাকালাম। উত্তরে ধূলার সওদাগর চাঁটগায়ের ছেলেটা ফিঁচেল হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে এক্সিলেটর চাপলো।
প্যাঁচার মত ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন দেশের নতুন শহরটাকে দেখছি। প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ের সৈকত শহর সান ডিয়েগো। ঝকঝকে চওড়া রাস্তার দু’ধারে সারি সারি পাম গাছ মাপা দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আকাশে নীলের মাঝে সাদা মেঘ কাশফুল হয়ে ভাসছে। একেবারে তুলির আঁচড়ে আঁকা ছবি। দেখে শুনে পলক আর পড়ে না আমার। বিস্ময় ভেঙ্গে মাহদি জানালো, পুরো শহরটা নিখুঁত নকশার ফসল। গাছপালাও বাইরে থেকে এনে লাগিয়ে বড় করা। কিছু আনা হয়েছে সীমান্তের মেক্সিকো থেকে। সাথে এও বলল যে, হলিউডের আস্তানা লস অ্যাঞ্জেলস শহর নাকি মাত্র দু’শো কিলোমিটারেরও কম দূরে এখান থেকে। চাইলে ঘুরে আসতে পারি এক ফাঁকে। মনে মনে ভাবলাম, আগে তো কনফারেন্সের পাট চুকাই। গলার কাটা নেমে গেলে ঘোরাঘুরি পরে দেখা যাবে নে।
হোটেলের নাম ভারিক্কি গোছের। ডে’স ইন হারাবার ভিউ। তবে চেহারা দেখে দমে গেলাম। টান বারান্দা দেয়া সাদামাটা তিনটা তলা। হোটেলের বদলে মোটেল ভাব প্রকট। মাহদি সযত্নে স্যুটকেস তুলে দিয়ে বাসায় নাকি ল্যাবে ফেরত গেল। আর বলে গেল ঘন্টাখানেক বাদে আবার এসে ডিনারে নিয়ে যাবে। চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে বহুদিন পর।
মোটেলবেশী হোটেলের ঘর যথেষ্ট সাজানো গোছানো। বাইরের রূপের উল্টোটা। আর পুরো হোটেল ভর্তি কনফারেন্সের লোকজন। বেশিরভাগই জার্মানি থেকে এসেছে। কি কাকতাল! কিন্তু মিউনিখের কাউকে চোখে পড়লো না। তাতে কিছু যায় আসে না। ল্যাবের কলিগ আর সুপারভাইজারকে জানিয়ে দিলাম, বহাল তবিয়তে পৌঁছে গেছি; কালকে দেখা হচ্ছে।
রাতে লেবানিজ এক রেস্তোরায় রাতের খানাপিনা সেই মাপের হল। মোরগ-পোলাও জাতীয় খাবারটার দেড় প্লেট নামিয়ে দিয়েছি। গল্প-আড্ডার চাইতে আধা লিটারের কোকের বোতলে সুরুৎ সুরুৎ টানই বেশি পড়েছে। চুর চুর লাগছে এখন। হোটেলে নামিয়ে দিয়ে মাহদি আজকের মত বিদায় নিল। আর বলে গেল, যেকোনো সমস্যায় ফোন দিতে যেন দু’বার না ভাবি।
হাতে ক’টা ইন্সট্যান্ট নুডুলসের প্যাকেট আর টুকিটাকি নিয়ে ওপরে উঠলাম। মাঝপথে ওয়ালমার্টে থামা হয়েছিল। হোটেল রুমের ইলেক্ট্রিক কেতলিটা দেখে মনে হয়েছিল, কালকে সারাদিন জ্ঞান কপচানো শেষে ঘরে ফিরে খিদে পেলে চটজলদি নুডুলস করে নেয়া যাবে। প্রবাসে এসে একটা বড় অংশ কেটেছে এই ইন্সট্যান্ট নুডুলসের উপর ভরসা করে। আর এখন তো প্রবাসের ভেতর প্রবাস। জার্মানি থেকে আমেরিকা। সফদার ডাক্তার তো আর নই যে ‘খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে’ হয়ে বসে থাকবো। তার চেয়ে চিবোলাম না হয় আরো খান কতক ইন্সট্যান্ট নুডুলস।
রাতের ঘড়ি এগারো ছুঁয়েছে। এক মগ হট কোকো নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। মে মাসের হালকা মিষ্টি হাওয়া বইছে। হঠাৎ দেখি অন্ধকার ফুঁড়ে নাকের ডগায় বিশাল মাস্তুল! ভড়কে গিয়ে মগ ছলকে পড়ার দশা হল। তারপর চোখ সয়ে নিয়ে কাহিনী বুঝলাম। হোটেলের নামে হারবার ভিউ কথাটা আছে কেন স্পষ্ট হল। রাস্তার ওপাশ ঘেঁষেই বন্দর। তাতে নোঙ্গর ফেলে ভাসছে পালতোলা সৌখিন কতগুলো নৌকা। সাথে স্পিডবোট আর ছোট-মাঝারি ইয়টও আছে। এই নিশুতি রাতের আবছায়ায় কাঠের শরীরগুলোর হালকা দোলাচল মুগ্ধ হয়ে দেখছি। এই সৌন্দর্যের কোন ভাষা হয় না। এই রুপ কলমের আঁচড়ে বন্দী করা যায় না। এমন একটা নৌকার মাস্তুলে পাল উড়িয়ে যদি পালিয়ে যাওয়া যেত ডাঙ্গার গৎবাঁধা জীবনটা থেকে, কেমন হত তাহলে? পাগলাটে রোমাঞ্চের জলজ ঘ্রান সপাটে ঝাপটা মেরে গেল নাকে।
বেশি আগড়ুম বাগড়ুম ভাবার সময় পেলাম না। সকালে সান ডিয়াগো কনভেনশন সেন্টার খুঁজে বের করে হাজির হতে হবে। সমান্তরালে চলতে থাকা অনেকগুলো সেশনের কোন কোনটা শুনলে আখেরে কাজে দিবে তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলা দরকার। তাহলে হয়তো পরের দিন নিজের কাজের উপর বকবক করতে সুবিধা হবে। কইয়ের তেলে কই ভাজার বুদ্ধি আর কি। খালি মগটায় মনের ভুলে আরেকবার চুমুক দিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
ল্যাপটপ বের করতে গিয়ে দেখি স্যুটকেসের তালা দারুন মুন্সিয়ানার সাথে ভাঙ্গা। ভেতরে এক টুকরো নোট পাওয়া গেল। তাতে লেখা, ‘নিরাপত্তার খাতিরে তালা ভাঙ্গতে হয়েছে বলে দুঃখিত। তবে মূল্যবান কিছু খোয়া গেলে আমরা কিন্তু দায়ী নই।‘ বাহ! খোঁড়া যুক্তির বাহার দেখে রাগ লাগার বদলে হাসি পাচ্ছে। আবার দুঃখও লাগছে। ল্যাপটপটা নিরাপত্তার অজুহাতে রেখে দিলে বেশ হত। পাঁচ কেজি ওজনের শিল-পাটার পাটা আকৃতির এই যন্ত্রটা কাজের খাতিরে সবখানে বয়ে বেড়াতে হয়। হারিয়ে গেলে পলকা দেখে একটা কিনবো ভেবে রেখেছি। কিন্তু বদখত জিনিসটা তো হারাচ্ছে না! হতাশ হয়ে দ্রুত লিস্টি ফিস্টি বানিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম সে রাতের মত।
৩.
মাথার ভেতর একজন ইবনে বতুতা বগলে জুতা নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ পেলেই সে জুতা ফটফটিয়ে বেরিয়ে আসে। আজকেও তাই হয়েছে। হাতের মুঠোয় গুগল ম্যাপ নামের মানচিত্রের বাপ থাকতেও লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করে করে হেলেদুলে হাঁটছি। অচেনা দেশে নিজেকে বোহেমিয়ান ভাবতে ভাল লাগে। সকালের মিষ্টি রোদ, ভেসে থাকা নৌকার ভিড়, নতুন শহরের পথঘাট, দালানকোঠার নকশা, মানুষজন-সব দেখতে দেখতে বিশ মিনিটের হাঁটা পথ আধা ঘন্টা লাগিয়ে পৌঁছালাম জায়গামত।
অতিকায় সান ডিয়াগো কনভেনশন সেন্টার কিছুতেই চোখ এড়াতে পারে না। আমেরিকান থোরাসিক সোসাইটির বিশাল ব্যানারে ছাওয়া পুরো কাঠামোটা। খুঁজে পেতে পরিচিত সবার দেখা মিলল অবশেষে। আমাদের রিসার্চ গ্রুপের হেড, আমার পিএইচডি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম চোখ নাচিয়ে খুব সাগ্রহে জানতে চাইল, ‘কি, কেমন ধরাটা খেলে এয়ারপোর্টে? আটলান্টায় ধরে নি তোমাকে?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘কিসের ধরা খাওয়া, আমাকে তো আরো ইঁদুরের ডাক্তার ভেবে ঝামেলা ছাড়াই আস্তে করে ছেড়ে দিল। কিন্তু, তুমি কোথাও আটকেছো মনে হচ্ছে?‘ উত্তরে তার চোয়াল ঝুলে গেল। জানালো, বেচারার তুর্কি চেহারা আর জার্মান পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে তাকে দলছুট করিয়ে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে নিয়ে গিয়েছিল। হাজার প্রশ্নের জবাব নিয়ে তারপর নাকি ছেড়েছে। ফ্লাইট মিস একদম কানের পাশ দিয়ে গিয়েছে।
টম আর গেরিট হাতের ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। সুপারভাইজারকে পাশ কাটিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের ল্যাবের দুই পোস্টডক। গেরিট চোস্ত জার্মান, ধারালো চেহারা। জার্মান স্বভাব মোতাবেক সারাক্ষন খঁচে থাকে। টম আইরিশম্যান, গোলগাল ভালোমানুষ। তবে ব্রিটিশ বললে ক্ষেপে যায়। তাই তাকে আমরা নিষ্ঠার সাথে ব্রিটিশ ব্রিটিশ বলে ক্ষ্যাপাই। কাছে এগোতেই খবর দিল, সেভেন-সিটার একটা পাওয়া গেছে। অমুক দিন সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়া যাবে। সময় মত যেন পার্কিংয়ে অপেক্ষা করি।
এই বুদ্ধি আগেই আঁটা। শেষের একটা দিন কনফারেন্সে ক্লিনিকাল আলোচনাই বেশি চলবে। আমাদের মত মৌলিক গবেষনার লোকের জন্যে তেমন একটা জরুরী না। সেদিন আমরা ফাঁকি দিবো। সারাদিনের জন্যে গাড়ি ভাড়া নেয়া হয়েছে। আরেক ল্যাবের দুই একজনকে জুটিয়ে সদলবলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। সুপারভাইজার যাবে না জানিয়ে দিয়েছে। সে যাবে মেক্সিকোর সীমান্তের দিকে, যেখানে ব্রান্ডের জিনিস জলের দামে পাওয়া যায়। শুনে খুশিই হলাম। নেতা গোছের কেউ থাকলে স্বাধীনতা খর্ব হয়। ভেড়ার পাল বানিয়ে হ্যাঁট হ্যাঁট করে যে দাবড়ানিটা সে সারাক্ষন দেয় আমাদেরকে, সেটার হাত থেকেও বাঁচা যাবে।
এলোমেলো ঘুর-ঘুরান্তির দিনটা আর আসে না। এদিকে সকাল-সন্ধ্যা জ্ঞানের ঘ্যানঘ্যান আর কাঁহাতক সহ্য হয়! নিজের পোস্টার প্রেজেন্টেশন না হয় এরকম উৎরে গেল। বাকিরাও ভাল করল। তবু সুপারভাইজার লোকটা গাঁয়ের পাঠশালার পন্ডিতের মত পিছে লেগে থাকে। অমুক নামকরা বিজ্ঞানীর আলোচনায় আমরা যেন বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে তাক লাগিয়ে দেই। নইলে ‘কিন্তু কপ্ করে খেয়ে ফেলবো’ জাতীয় হুমকি চলে। তাই কিছুটা প্রানভয়ে কোন সেশনে বোকাটে বোকাটে সব প্রশ্ন ছুড়ি। আবার কোনটায় সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করি। কাউকে কাউকে তো স্টেজ থেকে কফির টেবিল পর্যন্ত ধাওয়া করলাম। তবে বেশির ভাগ সময়ে সামনের সারিতে বসে হাঁ করে আধ খোলা মুখে ঘুমিয়ে কাটালাম।
সারাবেলা কনফারেন্সের পর রাতে আশেপাশের রেস্তোরায় হানা দিয়ে পেটচুক্তি খেয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল এক রকম। এক আধ দিন মাহদি এসে আবার সেই লেবানিজ রেস্তোরায় নিয়ে গিয়েছিল। নাম যার সুলতান। একদিন সেখানে চোখে পড়ল, এক ধারের দেয়ালে প্রায় সব দেশের খুচরো টাকার নোট ফ্রেম বন্দী হয়ে ঝুলছে। বাংলাদেশের দুই টাকার নোটও আছে দেখলাম। দোয়েল পাখিটা পরিচিত ভঙ্গিতে উঁকি দিচ্ছে। তার একটু বাদেই এক দল দেশী ভাই জাতীয় পোশাক চেক লুঙ্গি বিপজ্জনক উচ্চতায় তুলে গটগট করে ঢুকলো। নোয়াখালীর ভাষায় চলা আড্ডা দেখে বোঝা গেল তারা নিয়মিত কাস্টমার। ‘এটাই আমেরিকার মজা, বুঝলা?’, চওড়া হাসিতে মাহদি দুই মহাদেশের উদারতার ফারাক ইঙ্গিত করল। দেশি ভাই আর তাদের লুঙ্গীর বদৌলতে সম্পূর্ণ ঘরোয়া আমেজে সারলাম সেদিনের ডিনার। মনে হল, লেবাননি রেস্তোরা সুলতানে না, বসে আছি ‘ইয়ান তুন খাই যান’ জাতীয় দেশি কোনো ভাতের হোটেলে।
৪.
এরই মাঝে একদিন কনফারেন্সের ইচিং বিচিংয়ের ফাঁকে মিলে লাঞ্চে বেড়িয়েছি কয়েকজন। কাছেই রালফস্ নামের বড়সড় একটা সুপারমার্কেট আছে। স্যান্ডুইচ কিনে চিবোতে চিবোতে ফেরত যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, ফুটপাথে এক উশকো খুশকো লোক কম্বল টম্বল বিছিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তার কোলে হেলান দেয়া কাগজের সাইনবোর্ডটায় লেখা, ‘আমাকে রালফস্ থেকে চিকেন উইংস কিনে দিয়ে যাও’। গেরিটকে ইশারা করে বললাম, ‘বস তো দেখছি সেই রকম’। খঁচে থাকা গেরিট গাঁক গাঁক করতে করতে বলল, ‘কেন, অসুবিধা কি? যা খেতে চায়, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।‘ একটু দম নিয়ে যোগ করল, ‘আর ওর জায়গায় তুমি হলে তো ঠিকই লিখে রাখতে, ‘আমাকে বাসমতি চালের এক থালা ভাত দিয়ে যাও। নইলে চিকেন উইংসগুলো দিয়ে তাড়া করবো’। বলেই মুখ টিপে মশকরার হাসি হাসলো ল্যাবের বাঁজখাই মেজাজের পোস্টডক গেরিট। গালে বিশাল এক কামড় স্যান্ডুইচ থাকায় ঠা ঠা করে হাসতে পারছে না। হায়, আলুখেকো জার্মান এই বাঙ্গালকে ভাতের খোঁটা দেয়!
সেদিন বিকালেও আমরা চরম খোশ মেজাজে ছিলাম। চার কি পাঁচ তারা এক হোটেলে আফটার পার্টি হবে। ডিজে সহ। আগ্রহ নিয়ে এসেছি। এসে দেখি ডিজে ফিজে ঘোড়ার ডিম। লবিতে এক ছোকরা গিটার বাজিয়ে অনুরোধের গান গাইছে। ওদিকে যাদের জন্যে পার্টি সেই বিজ্ঞানীদের দঙ্গল ওয়াইন হাতে নিয়ে আমশি মুখে নিঃশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছে। যেন মুখ খুললেই জ্ঞান উবে গিয়ে কলসি খালি হয়ে যাবে। গিটারওয়ালা ছেলেটা খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নিচু স্বরে বলে যাচ্ছে, পরের গানে শ্রোতারা কি শুনতে চায়। ভেবে দেখলাম, আরে মওকা তো দারুন! উড়া ধুরা ঢিশটিং ঢিশটিং গান হাতড়াচ্ছি মনে মনে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। গেরিট ততক্ষনে পিঙ্ক ফ্লয়েডের একটা ক্লাসিকের নাম চেঁচিয়ে ছুড়ে দিয়েছে। উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে ছোকরাও বাজালো জান প্রান দিয়ে। এদিকে আমি তক্কে তক্কে আছি। গান পেয়েছি। গানস ‘ন রোজেস। সুইট চাইল্ড ও’মাইন। ছেলেটা প্রশস্ত হাসিতে জানিয়ে দিল, অনুরোধ তার মনে ধরেছে। এক মুহূর্ত কি ভেবে সে হাওয়াই গিটার নামিয়ে পাশে রাখা ইলেক্ট্রিক গিটারটা প্লাগ-ইন করে নিল। বয়সে বছর সাত-আষ্টেকের বড় গেরিট অবাক হয়ে বলল, এ্যাই, তুমি আমাদের সময়ের গান টান শোনা শিখলে কোত্থেকে? তোমার তো পুরানো গান বলতে বড় জোর ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ আর ব্রিটনি স্পিয়ার্স শোনার কথা। বাঁকা হেসে বললাম, তোমার সমান আমার একটা ভাই আছে। সেই সুবাদে টিনেজ পপ না শুনে ক্লাসিক রক শুনে বড় হয়েছি। শুনে গেরিটের কিছুটা হলেও তাক লেগে গেল। বেশ আমোদ পাচ্ছি। সায়েন্টিফিক আফটার পার্টি ব্যাপারটা একেবারে খারাপ লাগছে না। চলে। পরের ঘন্টা দুয়েক কলিগদের ওয়াইন গ্লাসের সাথে আমার কোল্ড কফির চিয়ারস চিয়ারস ঠোকাঠুকি আর গান বাজনা-দু’টোই চলল সমান তালে।
তারপর এক সকালে বহু অপেক্ষার সেই দিন চলে আসল। ঠিক হল উদেশ্যবিহীন ঘুরে ফিরে তারপর সোজা চলে যাব সাগর পাড়ে। বেশ খানিকটা দূরে নাকি দারুন একটা সৈকত আছে। ভাড়া করা বিশাল গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। গাড়ির কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দেখি বাইরেটা। দক্ষিন এশীয় আন্টিরা বেজায় রঙ্গিন সালোয়ার কামিজের সাথে ধবধবে সাদা কিংবা কটকটে গোলাপি কেডস পরে অলি গলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। শহর ঘেষা সাগর পাড়ে অলস সীল মাছ বড় পাথরের গায়ে পেট ভাসিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কি অদ্ভূতই না দেখাচ্ছে দৃশ্যগুলো।
বড় সৈকতটা খুঁজে পেয়ে আমরা হই হই করে নেমে পড়েছি। কি ভেবে চপ্পলজোড়া আঙ্গুলে ঝুলিয়ে নিলাম আমি। বালি ওম ওম গরম। কুসুম কুসুম উষ্ণতায় ছেয়ে গেল মনটা। দলের আর মেয়ে দুইজন খুব দ্রুত হেঁটে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে এর ভেতর। টম আর গেরিটও যে যার মত হেলেদুলে ঘুরছে। একা পড়ে যাওয়াতে আমি এক রকম খুশি। বার কয়েক পানিতে পা ভিজিয়ে ক্ষান্ত দিয়ে বালির ওপর কায়দা করে ডান হাতে ভর রেখে বাম দিকে এমনভাবে কেৎরে বসেছি যেন সৈকত, সাগর আর ঢেউয়ের একটা আনুভূমিক ছবি পাওয়া যায়।
ছবিটা প্রায় তুলে ফেলেছি, আর দুম্ করে গেরিট ফ্রেমে ঢুকে পড়ল। তাও আবার আদুল আদুল খালি গায়ে। শর্টস বাদে বাকি সব সে ঢেউয়ের ডগায় রেখে এসেছে আল্লাহর ওয়াস্তে। যে কোন মুহূর্তে সেগুলো জলের পেটে চলে যেতে পারে। সেদিকে থোড়াই কেয়ার করে বলল, সাগর পাড় থেকে সে স্লো মোশনে দৌড়ে আসবে আর আমি যেন পটাপট ক’টা ফটো খিঁচে দেই। অনিচ্ছাভরে আড়মোড়া ভেঙ্গে আলসেমির বিশাল কুমির হাই তুলে বললাম, ‘এটা তো টমকে বললেই পারতে। আমাকে জ্বালানো কেন?’। কিন্তু টমের দিকে তাকাতেই দেখা গেল তার প্রাগৈতিহাসিক দুই বাই তিন ইঞ্চি ফিচার ফোনটা হাতে নিয়ে সে অপরাধী হাসি হাসছে। এই দিয়ে আর যাই হোক ছবি খেঁচা যাবে না। অগত্যা, আরামের কেৎরে বসা বাদ দিয়ে হাতের ফোনটায় টোকার পর টোকা মেরে গেলাম। পার্টনারকে পাঠানোর জন্যে তোলা ছবিগুলো কেমন হয়েছে দেখার আর ফুসরৎ মিলল না গেরিট মিয়ার। উল্টো দিকে রাম দৌড় লাগিয়েছে ততক্ষনে। পাগলাটে একটা ঢেউ বেসামাল ধেয়ে আসছে। সমুদ্দুরে জামাকাপড় হাতিয়ে নিলে তাকে আদুল গায়েই হোটেলে ফিরতে হবে। কারো কাছে জ্যাকেট নেই। সান ডিয়াগোর আবহাওয়া আজকে খারাপ রকমের ভাল।
৫.
সৈকত থেকে শুরু হওয়া কাঠের ছোট্ট সেতুটা একটুখানি এগিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে। সেতুর মাঝপথে দাঁড়ালে মনে হয় নীল সাগরের একেবারে গহীনে দাঁড়িয়ে আছি। দুপুর হয়ে গেছে দেখে টুকটাক হাবিজাবি খেয়ে নিচ্ছি কেউ কেউ। কারো হাতে এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, নয় তো আইস্ক্রিম। দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়ার কুন্ডুলী পাক খেয়ে উড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের ধোঁয়া?’। টমের কাছ থেকে উত্তর আসলো, ‘খবর টবর পড়া ছেড়ে দিয়েছো মনে হয়? এটা হল ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত দাবানল। এ বছরেরটা শুরু হল মাত্র‘। ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম, দুয়েকটা হেলিকপ্টারের আনাগোনা। আগুন নেভানোর চেষ্টা আর কি। আগুন দেখে বেখাপ্পাভাবে বলে ফেললাম, ‘আচ্ছা, আজকে ওদিকে বন বাদাড় পুড়ছে আর আমরা কপ্কপিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছি। কেমন যেন রোম পোড়ে, নিরো বাঁশী বাজায় টাইপ হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা? অনেকগুলো আলু ভাজা একবারে মুখে পুরে দলের বাকিরা রে রে করে উঠল, ‘দেখো, ফটকা লোক নিরোর প্যাঁ পোঁ’র সাথে আমাদের কপ্কপ্ মেলাবে না খবরদার। আর আগুন আমরা লাগাই নি। সুতরাং তোমার মন কেমনের গুষ্ঠি কিলাই’। গুষ্ঠি কিলানোর হুমকিতে চুপ মেরে গেলাম।
তবে চুপ মেরেছিল আরো কয়েকজন। সেতুর এক পাশে তিন চারটে পেলিক্যান। তাদের চেহারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের গাম্ভীর্য। তাদের পাশে কমলারঙ্গা সাইনবোর্ড পতপত করে উড়ছে। তাতে ছোট করে কি যেন লেখা। কৌতূহলী হয়ে পড়তে গেলাম। কিন্তু সাথে সাথে খটাস ঠোকর! আর্কিওপ্টেরিক্স সাইজের ধুমসো একটা পেলিক্যান মাথা ঠুকে দিয়েছে। দিয়ে আবার জায়গায় মত ফিরে গিয়ে আধবোজা চোখে ঝিমাচ্ছে। যেন কিছুই হয় নি। এদিকে চোখে সর্ষে ফুল দেখার মাঝেও পেলিক্যানের গুষ্ঠি কিলাতে কিলাতে লেখাটা পড়ে ফেললাম। ‘প্লিজ সরে দাঁড়াও। বুনো বাদামী পেলিক্যান। আমরা বেকুব কিসিমের লোকজনকে কামড় দেই…উই বাইট স্টুপিড পিপল’। গা টা অপমানে টং করে জ্বলে গেল। কারন, কথা অতীব সত্য। কিন্তু ঘটে ঘিলু মিলু যে কিছু নেই, সেটা পাখিগুলো জানলো কি করে? যাহোক, মাথা ডলতে ডলতেই দেখলাম, লেখাটা টমের চোখে পড়েছে। খুলে আসা ভারি চশমাটা নাকে এঁটে সেও এদিকে আসছে। আজকে তারও ঠোকরকপাল। ভং ধরে থাকা পেলিক্যানটা আধবোজা চোখ খুলে নড়ে চড়ে বসেছে। পরের দৃশ্য দেখার জন্যে অপমান ভুলে বাকিদের সাথে ঠোঁট টিপে হাসি আটকিয়ে নিষ্পাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ফেরার পথে সাগরের তাজা হাওয়ায় লাগা খিদেটার গতি করার জন্যে গাড়ি থামাতে হল। শুধু বেচারা টম কিছুই না খেয়ে হাত গুটিয়ে উদাস বসে থাকলো। ছোটবেলায় বাদাম দেয়া কি যেন খেয়ে অ্যানাফাইলাক্টিক শকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স-হাসপাতাল করতে হয়েছিল। সেই থেকে খাবার নিয়ে তার নখড়ার শেষ নেই। একবার চটপটি বানিয়ে ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্যই ঝালশূন্য। বিচিত্র নতুন খাবারটা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে খেল। আর টম এসে প্রবল বেগে টেবিলের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে বলল, ‘বাহ্ বাহ্, স্যাভরি স্ন্যাকস! ওয়াও, ওয়াও, লুকিং স্ক্রামশাস’। কিন্তু তাকে বাটি-চামচ ছুঁতে দেখা গেল না। এই হল আমাদের আইরিশম্যান টম। এখানে আসা অবধি সাবওয়ে নামের রেস্তোরা ছাড়া কোথাও তাকে খেতে দেখা যায় নি। তাদের খাবারে নাকি বাদামের ব্যাপার নেই।
দেখতে দেখতে সান ডিয়াগোর সূর্যের দিনগুলো ফুরিয়ে এল। আজকে ফেরার দিন। ফ্লাইট ভোর রাত চারটায়। মাহদি দায়িত্ববান বন্ধুর মত দিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পারলো না। তার বদলে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল সন্ধায় দেখা করতে এসে। সেই রাতেই তাকে অতি জরুরী একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হবে তার ল্যাবে। ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানী বলে কথা।
ট্রানজিট আটলান্টায় এসে এবার আর ভয় পেলাম না। বরং একটু ঘুরে টুরেও বেড়ালাম। ঠিক সময়ে মিউনিখের প্লেন খুঁজে নিলাম। পাশের সিট খালি দেখে হাত পা ছেড়ে দেবো দেবো করছি। কিন্তু না। কোত্থাকে সাড়ে ছয় ফুট দশাসই এক তরুন প্রায় দেড়টা আসন দখলে নিয়ে ফেলল। ওদিকে আমি যে চিপায় পড়ে আছি, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বিমান ছেড়ে দেবার প্রায় আধ ঘন্টা পর তার মুখ ফোটা শুরু হল। ‘ভাগ্যিস তুমি শুটকো পটকা আছো। তাই জায়গা নিয়ে বসতে পারছি। হাই, আমি রবার্ট।‘ চিপা থেকে চিঁ চিঁ করে নিজের নাম বললাম। এর পরের পাঁচ-দশ মিনিটের আলাপে রবার্ট সম্পর্কে চমক লাগানো তথ্য বেরিয়ে আসলো। সে এক আফগানিস্তান ফেরত আমেরিকান সৈনিক। আমেরিকান ঘাঁটিতে কিছু বছর সৈনিক জীবন কাটিয়ে দেশে চলে গিয়েছিল। তারপর টিভি সাংবাদিকের কাজ নিয়ে আবার ফিরে গেছে সেই আফগান দেশেই। এখন জার্মানি যাচ্ছে ফুটবল খেলতে। জার্মান এক দল সাংবাদিকের সাথে প্রীতি ম্যাচ। কিছুটা যেচে পড়ে জানতে চাইলাম, ‘আফগানিস্তান কেমন দেখেছো? যুদ্ধ আসলে কেমন?’ সপ্রতিভ রবার্ট এক মুহূর্ত আনমনা থেকে গলা খাঁকরি দিয়ে বলল, ‘সাধারন আফগান মানুষ খুব সহজ সরল। আর ওদের কাবাব খুব মজার।‘ বলেই সে আচমকা ফুল স্টপ হয়ে গেল। বোঝা গেল, এই প্রসঙ্গের আলাপে তার খুব একটা উৎসাহ নেই। আমিও আর প্রশ্ন বাড়ালাম না। তাছাড়া, যোদ্ধাকে ‘যুদ্ধ কেমন’ জিজ্ঞেস করা বাতুলতা। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা আর নিষ্প্রোজনীয়তা তাদের থেকে ভাল আর কেউ জানে না।
ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম বোধহয়। নিজের নাম শুনে সোজা হয়ে বসলাম। কাগজ মিলিয়ে এয়ার হোস্ট ভদ্রলোক বলছেন, ‘হ্লালব্রিনি ফর মিস সারকার’। ‘হ্লালব্রিনি’ বস্তুটা যে কি বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। পাশ থেকে রবার্ট ধাঁধাঁটা ভেঙ্গে দিল, ‘হালাল খাবার প্রি-অর্ডার করেছিলে মনে হয়। চলে এসেছে তোমার হালাল বিরিয়ানি।‘বাড়িয়ে দেয়া ট্রে নিলাম। আগুন গরম অ্যালুমিনিয়ামের ভান্ড থেকে ভুরুভুরে সুঘ্রান আসছে। আফগান কাবাবের পাঁড় ভক্ত রবার্ট জুলজুল করে চেয়ে আছে এদিকে। তাকে দেয়া হয়েছে শুকনো রুটি, মাখন ইত্যাদি অখাদ্য। ভদ্রতা করে হ্লালব্রিনি সাধতে গিয়ে ভুল করলাম। পলকেই বিরিয়ানির অর্ধেকটা তার প্লেটে লাফিয়ে পড়লো। বাকিটা পথ বিরিয়ানির জোরেই কি না জানি না, রবার্টের মুখ চলল তুফান মেলের গতিতে। খাজুরে আলাপের ফাঁপরে পড়ে একবার ঘুমের ভান করলে খুঁচিয়ে উঠিয়ে কফি কাপ ধরিয়ে দিল। নিস্তারবিহীন বিমানযাত্রার পুরোটা রবার্ট নামের মূর্তিমান যন্ত্রনায় অস্থির। মিউনিখে নেমে হাসিমুখে তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসছি, আর কানে ভেসে এল আমেরিকান সৈনিক তার দলের বাকিদের পেয়ে বলছে, ‘উফ্, কি একটা মেয়ের পাশে যে বসেছি, কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। কথার মেশিন। খালি পটরপটর আর পটরপটর…’।
মাথা নেড়ে আপনমনে হেসে বাড়ির পথ ধরলাম। (সমাপ্ত)
-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
গবেষকঃ ইন্সটিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি
২৭.০৫.২০১৯
পুরোলেখা টা আপনাকে ছেলে ভেবে পরা শেষ করলাম আর শেষ এ এসে জানতে পারলাম আপনি মেয়ে, যাক ভালো লাগলো লেখা টা পরে।
দারুন বলেছেন তো। তবে আসলেই, মাথার ভেতর একটা দস্যি ছেলের দুষ্টুমি বাস করে।
আমারও একই মনে হচ্ছিলো, কথাবার্তা গুলো, বাই দা ওয়ে, ভালো লাগছে
মজারু মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ। হাহা…।