তখন আমি কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। নীলক্ষেত। রিকশায় বসে আছি। আব্বা কী যেন কিনতে গিয়েছেন। চারপাশের মানুষগুলো দেখছি। একটা ‘ইতালিয়ান’ রেস্টুরেন্টের সামনে বেশ বড় করে সাইনবোর্ড টাঙানো—‘সংগ্রাম হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ। দেশীয় যেকোনো খাবার অর্ডার নেওয়া ও সরবরাহ করা হয়ে থাকে।’ লেখাটার দুই পাশে যথারীতি হাস্যময়ী ছাগল আর মোরগের ছবি। মোরগটাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। মোরগের আর্টিস্ট মনে হয় বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে কাজে এসেছিল। আনমনা থাকায় মোরগ আকারে ছাগলের প্রায় আড়াই গুন হয়ে গেছে। ছাগলটার আবার দাঁড়িও আছে। ইন্টারেস্টিং!

ঢাকায় পাগলের সংখ্যা বাড়ছে এই ব্যাপারটা কি কেউ খেয়াল করেছেন? শেরাটন হোটেলের সামনে এই ধরনের কয়েকজনের দেখা মেলে। আর শাহবাগের চারুকলা তো এদের কাছে মোটামুটি তীর্থস্থান বলা যায়। এখানে আমি একজনকে চোখাচোখা কাঁটাওয়ালা মোটা এক লাঠি হাতে ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। উদাস উদাস চেহারা। ভয়ংকর দর্শন লাঠিটা বাদ দিলে তাকে মোটামুটি নিরীহই দেখায়। আবার পান্থপথের রাস্তায় একজনকে বেশ রাশভারী সাজে দেখা যায়। সাদা ধুতি হাঁটু পর্যন্ত। চকচকে পিতলের শিকল তার কাঁধ থেকে নেমে এসেছে। সেখান থেকে ততোধিক চকচকে একটা ঘটি ঝুলছে। দামি মান ইজ্জতওয়ালা ঘটি। বোধ হয় টাকা পয়সা রাখা হয় তার ভেতর। লোকটার বা হাতে লম্বা বেতের লাঠি। সব মিলিয়ে রামকৃষ্ণ রামকৃষ্ণ একটা ভাব আছে। যদিও শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস শেকল দেওয়া ঘটি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আবার বেড়াতেও পারেন। গান্ধী যদি ছাগল নিয়ে ঘুরতে পারেন তাহলে রামকৃষ্ণের ঘটি থাকলে দোষ কোথায়?

সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে একদিন এক আর্কিমিডিসকে দেখলাম নির্বিঘ্ন চিত্তে রাস্তা পার হচ্ছেন। আমি একটু দূরে ছিলাম। তাই ওনার ‘ইউরেকা’ কানে এসে পৌঁছায়নি। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। সবাই বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে তাকে পথ ছেড়ে দিলেন। এর আগেও দেখেছি নাঙ্গা বাবাদের প্রতি জনসাধারণের একধরনের শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে। হাইকোর্টের গেটের সামনে এক ভদ্রলোককে দেখতাম মাঝে মাঝে। বস্ত্রসম্ভারের দিক থেকে তিনি আর্কিমিডিসের থেকে উচ্চপর্যায়ের। কতটা উচ্চপর্যায়ের সেটা প্রমাণ করার জন্য জ্যৈষ্ঠের গরমেও আধময়লা ফুলহাতা শার্টের ওপর কমলা সোয়েটার আর তার ওপর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে বসে থাকতেন। পুরো ব্যাপারটা আলাদা মাত্রা পায় যেদিন তিনি এর সঙ্গে শিয়াল রঙের চাদর আর গামছাটা যোগ করেন। ভদ্রলোকের বোধ হয় কোনো মাফলার নেই। থাকলে নির্ঘাত গলায় পেঁচিয়ে জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা দুপুরে ঠোঁটের কোণে একটা অপার্থিব শান্তি ফুটিয়ে বসে থাকতেন।

আমার ধারণা ঢাকা শহরে উন্মাদের সংখ্যা বাড়ার পেছনে কয়েকটা গূঢ় কারণ আছে। এক. হতে পারে এরা সাদা পোশাকধারী পুলিশ। আমরা ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়লে শিয়াল চাদর ফেলে দৌড়ে আসবেন সাহায্য করতে। আবার হতে পারে এরা আমাদের দেশের মাননীয় মন্ত্রীরা। মহান শাসক হজরত ওমর ফারুক যেমন প্রজাদের দুঃখ-কষ্টের খোঁজ নিতে ফকির মিসকিনের ছদ্মবেশে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরেছেন, তেমনি দেশের মানুষের অবস্থা জানার জন্য মন্ত্রীরাও উন্মাদের ভেক ধরতে পারেন। আবার বাংলা সিনেমার প্রযোজকও এরা হতে পারেন। ‘ফায়ার’ টাইপের দুই নম্বরী ছবি করে ধরা খেয়ে চাট্টিবাটি গোল করে সবশেষে উন্মাদের মহান পেশায় আবির্ভূত হয়েছেন।

যা হোক, বিচিত্র মানুষের প্রতি আমার অপার কৌতূহল। আমি উন্মাদপ্রিয় বটে কিন্তু নিজে উন্মাদ না। তবে হতে কতক্ষণ?

— — —

উল্লেখ্য, লেখাটি ইতোপূর্বে দৈনিক প্রথম আলোর দূর পরবাস পাতায় ছাপা হয়েছিল।

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

Leave a Reply