আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগে যখন বিদেশ বিভুঁইয়ে পাড়ি দিচ্ছিলাম দেশ ছেড়ে যাবার এক ধরণের কষ্টের সাথে সাথে নতুন দেশ, নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবার এক ধরণের রোমাঞ্চ অনুভূত হচ্ছিলো। একই সাথে আমার শহর পাল্টানোর এই অভ্যাস নতুন নয়, বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে আমি নিজেও দিপু নম্বর ২ এর মতো এক শহর থেকে অন্য শহরে ছুটে বেড়িয়েছি। সেই সুবাদে নদী আর পাহাড়ের সাথে আমার অদ্ভুত যোগাযোগ। ডুসেলডর্ফ এয়ারপোর্ট থেকে যখন ট্রেন এ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, জানালার দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম আর বুকে এক ধরণের হাহাকার বেজে উঠলো, কেননা গাছ পালার কোনো পাতা নেই, সূর্যের তীব্রতা নেই বললেই চলে, রাস্তা ঘাটে মানুষ নেই বললেই চলে, আর মনে মনে চিন্তা করছি এ কোন পৃথিবীতে আমার ঠাঁই হলো আমার।

যাই হোক কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই জায়গা হলো NRW এক ছোট্ট শহরে। নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হলো, NORMA তে বাজার করতে গিয়ে এটা খুঁজে পাই তো ওটা খুঁজে পাই না, দোকানদারনী কে অনেক কষ্টে বোজানোর পরে কিছু জোগাড় করতে পারলাম। এক ছোট ভাই এর সাথে যৌথ প্রযেজনায় প্রথম মুরগি রান্না আজও অমৃত মনে হয়। কেন জানি আজ অব্দি ওর থেকে সুস্বাদু মুরগি রাঁধতে পারি নাই। ওটাতে কি শুধু রান্নার কেরাসমতি ছিল না ক্ষুদার তীব্রতা বেশি ছিল বলতে পারবো না। আর রাঁধতে রাঁধতে মাকে সারা জীবন কি রকম কষ্ট দিয়েছি, আজ এটা খাবো না, কাল ওটা খাবো না বলে চিন্তা করতে গিয়েই এক ধরণের অপরাধ বোধ কাজ করলো। কেন জানি মাকে আজ বলতে পারি নাই “আম্মু, I am sorry”। এই পাপ বোধ ঘুঁচাতে চেয়েছিলাম এক দিন বাসায় আম্মু কে রান্না করে খাওয়াবো কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আম্মু কে রাজি করতে পারিনি. এটাই হয়তো মা। গুটি গুটি পায়ে নতুন জীবনের পথচলা শুরু হলো আর মনের কোনে পরে রইলো মা আর মাতৃভূমি।

কিছু দিন পরে এক ধরণের ক্লান্তি অনুভব করলাম। দেশে যখনি সময় পেতাম নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম, এটা আমরা শৈশব থেকে অভ্যাস। কোনো ভাবে জানতে পারলাম আমার শহরের খুব কাছেই রাইন নদী নামে একটি নদী আছে। যেই শোনা সেই কাজ, কিছু দিন এর মধ্যে রওনা দিলাম নদী দেখার উদ্দেশে। নদীর পাড়ে গিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছিলাম আর ধরণের শান্তি অনুভব করলাম। আর চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো সিলেটের-কমলগঞ্জ ধলই নদী- প্রাইমারি স্কুল এর খুব কাছেই থাকতে কত যে বিকেল কাটিয়েছি তাই ইয়াত্তা নাই। ভেসে উঠলো শ্রীমঙ্গলএ BTRI স্কুল এর পাশের চা বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট পাহাড়ি ছড়া- বালুময় স্বচ্ছ পানিতে গ্রীষ্মের তীব্র রোদে পা ভিজিয়ে রাখার মত অনুভূতি জানি না আর কোনো দিন পাবো কিনা। ভেসে উঠলো নানু বাড়িতে নৌকায় বেড়াতে যাওয়ার সময় জীবনান্দর বিখ্যাত ধানসিঁড়ি নদী- আজও আমি নদীর পাড়ের পাঁকা ধানের গন্ধ আর ঘুঘু পাখির ডাক শুনতে পাই। ভেসে উঠলো দাদু বাড়ির পাশেই বয়ে চলা অসম্ভব শান্ত-সুন্দর বেলুয়া নদী আর ভেসে উঠলো বুড়িগঙ্গা আর শীতলক্ষা-মাঝে মাঝেই শহুরে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আশ্রয় নিতাম যাদের কাছে। চোখ খুলতেই আমার সব ভ্রম ভেঙে গেলো, এটাকেই বলে হয়তো দুধের স্বাদ ঘোল এ মেটানো।

. . জামান, ম,গ্লাডবাখ

 

One thought on “আমার দেখা শীতলক্ষ্যা”

Leave a Reply