জার্মানির দিনলিপি–পথলিপি ০১
আজ আমরা প্রায় ১৫ জন ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট Cottbus শহরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক Branitzer পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে পার্কটি প্রায় ৫ কি.মি পায়ে হাটা পথের দূরত্বে অবস্থিত। এখানে ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে সব ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরাই হাটতে খুব পছন্দ করে। প্রত্যেকের ফ্রি ট্রান্সপোর্ট কার্ড থাকার পরেও ৫ কিমি রাস্তা তাদের কাছে হাটা কোন ব্যাপারই না, বরং দল বেধে নতুন নতুন রাস্তা দিয়ে হাটাই সবার কাছে অনেক বেশি উপভোগ্য, একেবারেই ঠিক যেমন একটা গ্রুপ আমি সবসময় চেয়ে এসেছি। দুপুর দুটোর দিকে (তখন তাপমাত্রা প্রায় ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সাথে প্রচন্ড বাতাস আবার অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়ছিল) পূর্বের নির্ধারিত সময়ে সবাই ঠিক সময়েই উপস্থিত হয়ে গেল, এখানে ছেলে–মেয়ে নির্বিশেষে সবাই খুব সময় সচেতন, মাত্র দুজন ৫মিনিট দেরি করে আসাতে সরি বলতে বলতে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। এখানে ছেলে মেয়ে সবাই সমান, মেয়েদের মাঝে এধরনের স্বাভাবিক ঘুরাফেরায় আটা–ময়দা–সুজি মাখার মত কোন বালাই নেই। সবাই পরিচয় পর্ব সেরে ফেলার পর রওনা দিলাম পথ ধরে। আমাদের দলের কেউ এসেছে সেই সূদুর চিলি থেকে, কেউ প্যারাগুয়ে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে, কেউ এসেছে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ইরান থেকে, কেউ এসেছে ফ্রান্স, রাশিয়া থেকে আর বাংলাদেশের ছিলাম আমি। যেহেতু আমাদের দলের কারোরই আগে ওই পার্কে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই তাই দু–একজন গুগল ম্যাপ দেখে দেখে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এখানে প্রত্যেকের মাঝেই একধরনের জ্ঞানচর্চার প্রবনতা রয়েছে, যা আমি বাংলাদেশের ছেলে–মেয়ে নির্বিশেষে সবার মাঝে খুব অভাব লক্ষ্য করেছি। আমাদের দলের সবারই একজনের সাথে আর একজনের আলোচনার বিষয় ছিল নিজ নিজ পড়ালেখার বিষয়, নিজ নিজ দেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য। এখানে একজন কেমিক্যাল ইজ্ঞিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আগ্রহ নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কথা বলছে বা শুনছে, এনভায়রোনমেন্টাল সায়েন্সের ছাত্র আর্কিটেকচার বিষয়ে আলোচনা করছে কিংবা ইতিহাসের ছাত্র আরবান প্লানিং নিয়ে আলোচনা করছে। কথা বললাম চিলি থেকে আগত Karla’র সাথে চিলির ভূ–প্রকৃতি নিয়ে, তাকে আগ্রহের সাথে জানালাম যদি কখনো সামর্থ হয় তাহলে অবশ্যই চিলির ইস্টার আইল্যান্ড ঘুরতে যাবো। ইরানের Najmeh’র সাথে কথা হলো বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থা ও ইরানের সামাজিক অবস্থা ও রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। ইন্দোনেশিয়ার Adi’র সাথে কথা হচ্ছিল বরবুদুর মন্দির নিয়ে, থাইল্যান্ডের Nan বর্ননা দিচ্ছিল কি ধরনের পদক্ষেপের কারনে থাইল্যান্ড ট্যুরিজমের জন্য পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত হয়েছে।
প্রায় ১.৩০ঘন্টা হাটার পর (মাঝে যদিও পথ হারিয়েছি অনেকবার) অবশেষে পৌছালাম কাঙ্খিত পার্কে। পুরো পার্ক সুন্দর উচুঁ–নিচু টিলা দিয়ে সাজানো, রয়েছে সবুজ ঘাসে ছেয়ে থাকা চত্বর, পাথুরে রাস্তার দু–পাশে ভয়ানক রকম বিশাল বিশাল উচু গাছ, বিচিত্র রঙয়ের সব গাছের পাতা, স্নিগ্ধ পরিবেশ চারপাশে। হাটতে হাটতে আরও প্রায় আধঘন্টা পর আমরা পার্কের মূল আকর্ষন লেকের মাঝে অবস্থিত পিরামিডের কাছে পৌছালাম। Branitzer পার্ক হলো উনিশ শতকেরতো বটেই, পৃথিবীর ইতিহাসের সেরা ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনিংয়ের নিদর্শন। Prince von Puckler-Muskau (১৭৮৫–১৮৭১) নিজ উদ্দ্যোগে এই বিশাল বাগান তৈরীর কাজ শুরু করেন ১৮৪৬ সালে। প্রায় ৬০০ হেক্টর আয়তনের এই সুবিশাল পার্কে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর একটি প্যালেস, প্রাকৃতিক লতা–গুল্মোর সমন্বয়ে গড়ে তোলা ওয়াক–ওয়ে ও চার্চ এবং দুটি সুদৃশ্য পিরামিড। অসংখ্য দর্শনার্থী পার্ক ও এর ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখতে আসছে অথচ কোথাও সামান্যতম কোন কাগজের টুকরো বা পলিথিন পড়ে নেই (আহ! আমাদের দেশের মানুষগুলোও যদি তাদের দর্শনীয় স্থানগুলো এমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন রাখতো)। Prince von Puckler-Muskau ১৮৩৪–১৮৪০ সালের মাঝে মিশর, সুদান, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া ও নুবিয়ার ঐতিহাসিক স্থানসমূহে ভ্রমন করেন। পরবর্তীতে পার্কটি তৈরীর সময় তিনি তার মিশরের পিরামিড দেখার অভিজ্ঞতার আলোকে দুটি পিরামিড তৈরী করেন। অন্যান্য পিরামিড পাথরের তৈরী হলেও তিনি তার পিরামিড দুটি তৈরী করেন সম্পূর্ণ মাটি দিয়ে। পিরামিডের আসল সার্থকতা হলো এতে থাকবে কারো সমাধি।
মজার ব্যাপার হলো, ১৮৭১ সালে Puckler মারা যাওয়ার পর তাকে সমাধিত করা হয় লেকের মাঝে অবস্থিত অপেক্ষাকৃত বড় Tumulus পিরামিডটিতে। পরবর্তীতে তার সহধর্মিনী খঁপরব Lucie Countess ১৮৮৪ সালে মারা যাওয়ার পরে তাকেও তার স্বামীর পাশে পিরামিডের মাঝে সমাহিত করা হয়। আমরা সবাই অনেক্ষণ লেকের পাশে বসে পিরামিড দেখছিলাম আর কথা বলছিলাম Branitzer পার্কের ইতিহাস, তার তৈরী প্রনালী নিয়ে। সবারই একই প্রশ্ন ভদ্রলোককে পিরামিডের উপরে নাকি ভেতরে কোন গোপন চেম্বারে সমাহিত করা হয়েছে। আমি ও আমার পুরাতাত্ত্বিক আমেরিকান বন্ধু Kenneth অনেকক্ষন ধরেই চেষ্টা করছিলাম বিষয়টা বোঝার যদিও আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুজে পাইনি। এরই মাঝে আমাদের কাছে লেকে বসবাসকারী এক রাজহাঁস দম্পতি আমাদের কাছে এসে হাজির খাবারের আশায়।
থাইল্যান্ডের বন্ধু Pond কিছু ব্রেড তাদেরকে খেতে দিল আর আমরা সবাই নিজেদের মত ছবি তুলে হাটা দিলাম প্যালেস ও পার্কের অন্যান্য স্থাপনা দেখার জন্য। ফ্রান্সের আর্কিটেক্ট Soizic আমাদের সামনে নেতৃত্ত্ব দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্যালেস যতটানা সুন্দর তার চাইতে বেশি সুন্দর তার সামনের লতা–গুল্মের সমন্নয়ে তৈরীকৃত ওয়াক–ওয়ে। আমাদের সবারই ইচ্ছে হচ্ছিল প্যালেসের ভেতরটা ঘুরে দেখার কিন্তু স্টুডেন্টদের জন্য ডিসকাউন্টেড এন্ট্রি ফি ৪.৫ ইউরো, বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৪৫০ টাকা, কেউই কেন যেন আর আগ্রহ দেখালো না।
তাই প্যালেসের সামনে কিছুক্ষন সবাই মিলে ছবি তুলে আবার নতুন আরেক পথ দিয়ে ২য় পিরামিডের দিকে হাটা শুুরু করলাম। দ্বিতীয় পিরামিডের উপর কবর ঘিরে রাখার মতো কিছু একটা ছিল, কিন্তু বর্ননা লেখা জার্মান ভাষায় যার কিছুই আমরা বুঝলাম না। দ্বিতীয় পিরামিডে আরও কিছুটা সময় কাটিয়ে এবারে রওনা দিলাম স্প্রী নদীর তীর ধরে গড়ে ওঠা বনাঞ্চলের ভেতর দিয়ে প্রায় হাজার কিমি দৈর্ঘের ট্রাকিং ট্রেইল। প্রায় ঘন্টাখানেক পাইন বনের ভেতর দিয়ে হাইকিং করার পর পাশে বড় সড়ক দিয়ে উঠে শহরের ভেতরে প্রবেশ করলাম।
আবারো প্রায় ৫ কি.মি পথ আরও হেটে পৌছাতে হবে ইউনিভার্সিটির ডর্মিটরিতে, প্রায় ৫ ঘন্টা ধরে হাটছি সবাই অথচ কারো মাঝে সামান্যতম কোন ক্লান্তিবোধ বা বিরক্তি নেই। সবাই শহরের বিভিন্ন নতুন নতুন রাস্তা ধরে হেটে হেটে প্রায় সন্ধ্যার সময় নিজ নিজ ডর্মিটরিতে ফিরে গেলাম আবার নতুন কোন জায়গায় একত্রে ঘুরতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
ভাইয়া উচ্চতর শিক্ষার জন্য জার্মানিতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে। যদি যাওয়ার সুযোগ হয় তবে অনেক, অনেক বন্ধু বানানোর ইচ্ছে আছে। যদি বন্ধু বানানোর কোন আলাদা নিয়ম থাকে তাহলে জানাবেন। জানি প্রশ্নটা একটু সিলি হয়ে যায়। তারপরও বললাম এই কারণে যে আমি কি কারও সামনে গিয়েই আগন্তুকের মতো বলব যে আমি তোমার সাথে পরিচি হতে চাই নাকি কোন কমিউনিটি আছে যেখানে আমি যোগ দিতে পারি। বা সার্বিক অবস্থাটা কেমন??