দিন টি ছিল রবিবার ৷ জার্মানীতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন ৷ সকাল সাত টায় ঘুম ভেঙ্গে ফোনের স্ক্রিন টা অন করেই প্রতিদিনের মত করে একটি পরিচিত মুখের ছবি দেখি, সাথে প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট একটি চিঁঠি “গুডমর্নিং” ৷ প্রিয় মুখটির সঙ্গে আমার পরিচয় মাত্র দুই মাসের ৷ অথচ অনুভব করি তার সাথে যেন আমার পরিচয় বহু যুগের ৷ সকালে উঠে ঘুম ঘুম চোখেই তার একটি ছবি সাথে গুড মর্নিং লেখা একটি বার্তা ৷ সাথে থাকে দুঃখের কিছু ইমো ও স্টিকার ৷ এটি ছিল রিপার প্রতিদিনের রুটিন ৷ রিপার ওখানে যখন সকাল আমার তখন মাঝ রাত ৷ যদিও সকালে উঠেই রিপার ঘুমে ক্লান্ত মুখটি দেখে শান্তি পাই ৷ রিপার পাঠানো ইমো তে দেখা যায় চাঁদের মত হলুদ গোল মুখের গোল গোল চোখ ভর্তি পানি, আর স্টিকারে ছোট একটি ফ্রক পড়া মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে বৃষ্টির পানিতে তার চোখের পানি হারিয়ে যাচ্ছে ৷ রিপা খুব বুদ্ধিমতি মেয়ে সামান্য দুটো ইমো আর স্টিকারে তার দুঃখ কষ্টের সবটুকু অনুভুতি আমায় জানিয়ে দিতো ৷ আমি পাঁচ হাজার মাইল দুর থেকে অসহায়ের মত বুকে পাথর বেধে সেই ভারী কষ্ট দুঃখ গুলা বুকে লেপ্টে রিপার অজান্তেই তার কষ্ট, দুঃখ হালকা করার চেষ্টা করতাম ৷ আমার ও রিপার সময়ের ব্যবধান চার ঘন্টা ৷ কর্ম দিবসের ব্যাস্ত দিন গুলোতে ঘুম ভেঙ্গে রিপার মুখ টি দেখার ফুরসৎ ও অনেক সময় হয়ে ওঠেনা ৷ লাফিয়ে ঝাপিয়ে অফিসে যাবার তাড়া থাকে ৷ তবুও ভালো লাগে মোবাইল স্ক্রিনে যতক্ষন রিপার ছবিটি তাজা ফুলের মত ফুটে থাকে ৷

দুরের ভালোবাসা গুলো খুব অদ্ভুত হয় ৷ সব সময় এক ধরনের অভিমানের প্রতিযোগিতা ৷ যে যত অভিমান করতে পারে সে ততই বেশি ভালেবাসা পায় ৷ পৃথিবীতে সব মানুষ ই ভালোবাসা পেতে চায়, আমি ও রিপা এর ব্যতিক্রম নই ৷ দুজনই কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে ঐচ্ছিক ঝামেলা বাধিয়ে অভিমান করে ফোনের কাছে একটি ম্যাসেজ অথবা ফোন কলের অপেক্ষার প্রহর গুনি ৷ অভিমানের প্রতিযোগিতায় আমি সব সময় ই হেরে যেতাম, নিজেকে হারিয়ে রিপাকে জিতিয়ে দিতাম ৷ রিপা খুব খুশি হতো ৷ রিপার হাসি মুখ টি আমি মোবাইলের স্ক্রিনে দেখে স্বর্গীয় শান্তি পেতাম ৷ কোন একরাতে আভিমানের প্রতিযোগিতায় আমি জিতে রিপাকে হারিয়ে দিয়েছিলাম ৷ সকালে ঘুম থেকে উঠে রিপাকে ফোন দিয়ে শুনি সে রাত থেকেই প্রচন্ড অসুস্থ ৷ প্রচন্ড বিচলিত মন নিয়ে সেদিন ই শপথ করেছিলাম রিপাকে আমি হারতে দিবোনা ৷ আর হারতে দিইনি ৷

আজকে আমার আকাশে অনেক মেঘ ৷ কালো ঘন মেঘ ৷ দানবের মত পুরো আকাশ টা ঢেকে রেখেছে কুচকুচে কালো ঘন মেঘ ৷ থেকে থেকে আকাশ বাতাস কাপিয়ে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ৷ এ যেন প্রকৃতির এক ভয়ংকর রূপ ৷ এই বুঝি বৃষ্টি নামবে ৷ ঝম ঝম করে বৃষ্টি নামবে ৷ ভারী ভারী বৃষ্টির ফোটা ৷ রিপার সঙ্গে আমার সংসার ছিল মাত্র এক মাসের ৷ দেশে থাকতে খুব ইচ্ছা ছিল রিপার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো ৷ ঝম ঝম বৃষ্টিতে বাসার ছাদে রিপা আর আমি ভিজবো, কাক ভেজা ভিজবো ৷ বিদ্যুতের চমকে বাসার ছাদের ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিবো ৷ ভয়ার্ত ও রোমাঞ্চকর মুহুর্তের সাথে ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টিতে ভেজার তালে তালে চলবে একটি রবীন্দ্র সংগীত ৷

“মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।।
হৃদয় ও গগনে সজলও ঘন
নবীনও মেঘে রসের ও ধারা বরষে
মোর ভাবনারে কি হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
তাহারে দেখি না যে দেখি না
শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ঐ শোনা যায়
বাজে অলকিত তার চরণে।”

আমাদের বৃষ্টি বিলাস নিষ্ফল হয়েছিল ৷ রিপার সাথে আমার বৃষ্টিতে ভেজা হয়নি ৷ দেশে থাকতে তখন তেমন একটা বৃষ্টি হয়নি ৷ এক রকমের মানসিক কষ্ট নিয়েই দেশে ছেড়েছিলাম ৷ কবে রিপার সাথে বৃষ্টি স্নান করবো ৷ রিপা, আমি কেউ জানিনা ৷

হালে শহরের পাঁচ তলা কংক্রিটের বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে, কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা আকাশের দিকে তাকিয়ে রিপার কথা ভাবছি ৷ আমার দৃষ্টি তখন শূন্যে ৷ রিপার আকাশে ও কি কালো মেঘ করেছে? রিপা ও কি আমার কথা ভাবছে? মুহুর্তটা জীবনের সেরা একটি রোমান্টিক মুহুর্ত মনে হচ্ছিলো ৷ আসলে প্রকৃতির অলৌকিক কিছু ক্ষমতা রয়েছে যে ক্ষমতায় প্রকৃতি মানুষের মনের কষ্ট, দুঃখ ভাসিয়ে দিয়ে জীবনের সব হিসাব নিকাষ ওলোট পালট করে দিতে পারে ৷ মুহুর্ত টি ঠিক তেমনি ই মনে হচ্ছিলো ৷ মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে আমি ই একজন মানুষ যার জীবনে কোন কষ্ট নেই ৷ রিপা কে আজ পাশে পেলে খুব ভালো হতো, প্রকৃতির সাথে মনের আনন্দ দুজন ভাগাভাগি করে নিতাম ৷ জানালার চৌকাঠে হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে দুজনে দু’মগ ভর্তি দুধ চায়ে চুমুক দিয়ে কালো মেঘের আকাশ দেখতাম ৷ কালো মেঘের নিচে ভয়ংকর প্রকৃতি দেখতাম ৷ রিপা বলতো প্রকৃতির এই মুহুর্ত গুলো সে খুব উপভোগ করে, যদিও বাস্তবে তা দেখার সুযোগ আমার কখনো হয়নি ৷ রিপাকে পাশে নিয়ে কালো মেঘে ঢাকা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলকানি, থেকে থেকে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ, ঝম ঝম বৃষ্টি খুব দেখতে ইচ্ছা করছে ৷

রিপা আমার পাশে নেই ৷ রিপা কে ফোন করলাম, রিপা ফোন টি রিসিভ করেই আমার সুন্দর মুহুর্তে নিমিষে বজ্রপাত করেই বললো বাসায় বিদ্যুৎ নেই খুব গরম পড়েছে, গরমে খুব কষ্ট হচ্ছে ৷ বাইরে প্রচন্ড রোদ ৷ তখন অজান্তেই মনে পড়লো সময় আর দুরত্বের ব্যবধানের কথা ৷ আমি ভুলে গিয়েছিলাম রিপা আমার থেকে চার ঘন্টা এগিয়ে, আমার থেকে রিপা পাঁচ হাজার মাইল দুরে ৷ আমার আকাশে মেঘ ৷ কুচকুচে ঘন কালো মেঘ আর রিপার আকাশে রোদ ৷ ঝকঝকে সোনালী রোদ ৷ তাতে কি? হোক না সময় আর দুরত্বের ব্যবধান, হোক না প্রকৃতির আচরণে বিস্তর ব্যবধান, রিপা তো আমার হিয়ার মাঝেই লুকিয়ে আছে ৷ সাদা-কালো জীবনে এখন শুধুই অপেক্ষা ৷ রঙধনুর অপেক্ষা ৷ পরবর্তী ঝম ঝম বৃষ্টির অপেক্ষা ৷ রিপার সাথে বৃষ্টি বিলাসের অপেক্ষা l

মাহবুব মানিক
সাইন্টিফিক রিসার্চার
মার্সেবুর্গ ইউনিভার্সিটি অব এপ্লাইড সাইন্স ৷
হালে, জার্মানী ৷

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

Leave a Reply