ছোট বেলায় যখন কাল বৈশাখী ঝড় হতো ঝড় থামলে সবাই গাছপালা বিদ্যুতের খুটি উপড়ানো দেখতে যেত, আর আমি যেতাম স্কুল দেখতে, উপড়ে কাত হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে কিনা ৷ বিরক্তিকর একটা বিল্ডিং বানিয়ে রেখেছে, এত্ত ঝড় হয় একটুও ভেঙ্গেও পড়েনা এমন কি কাত ও হয়না ৷ আমার জন্ম ও ছোটবেলা কেটেছে কুষ্টিয়া জেলার চৌড়হাস সিএন্ডবি কোয়াটারে, তিন তলা কোয়াটারে আমরা থাকতাম দোতলায়, আমি পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে ৷ কোয়াটারের সামনে বড় পুকুর, পিছে সীমানার ওপাশে একটা খাল, আমরা যাকে ক্যানেল বলি, ক্যানেলের ধার ঘেষে বস্তি, বস্তির সমবয়সী সব উড়নচন্ডী ছেলে ছিল আমার বন্ধু ৷ আমার হাতেখড়ির স্কুলের নাম চৌড়হাস মুকুল সংঘ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কোয়াটারের প্রধান গেট থেকে বেরিয়ে সামনেই চৌড়হাস মোড়, মোড়ের ধারেই স্কুল ৷ স্কুলটা আসলে তৎকালীন সময়ে আমার জন্য একটা দুঃসময় ছিল ৷ আসলে স্কুলে যখন ভর্তি হই, শিশু শ্রেনীতে, তখন শুরুর কয়েকটা দিন খুব আগ্রহ নিয়েই গেলাম, নতুন জিনিস দেখি কি হয়, ভালোই লাগতো, পাড়া প্রতিবেশীর বন্ধুরা ও যেত, গল্প গুজব করতাম, হালকা পাতলা মারামারি ও করতাম ৷
10647145_458967774246545_4735528050226561146_n
দিন যত যায় স্কুলের সাথে সম্পর্ক টা ছিন্ন করার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম ৷ স্কুল শব্দের সমার্থক শব্দ ছিল বিরক্তিকর সারাদিন ৷ ততক্ষনে কয়েক বছর উতরে গেছে, আমি ও মুড়ামুড়ি করতে করতে কয়েক ক্লাশ টপকে গেছি, দিন মাস বছরের গতির সাথে সাথে সাথে বলপয়েন্ট কলমের কালিতে বুক পকেটের কালো দাগ টা ঘন হতে থাকলো, ফাইনালি বেকে বসলাম ক্লাশ থ্রী থেকে ৷ কারন হচ্ছে ক্লাশ টু পর্যন্ত ক্লাশ ডিউরেশন ছিল সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা, কিন্তু থ্রী থেকে ডিউরেশন সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা ৷ আনার কাছে এটা অনেক লম্বা সময় ৷ আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল এতটা সময় এক জায়গাতে অনড় বসে স্যারদের বকর বকর শোনা ৷ আসলে লম্বা সময় টিচারদের বকবক শুনলে বিরক্তিতে মাথা ধরে যেত ৷
10468070_458968894246433_5369702286634921358_n
এদিকে মা আমার নাছোরবান্দা, তার ভাব খানা দেখলে এমন মনে হতো, আমাকে ধরে বেধে স্কুলে পাঠানোই তার এম ইন লাইফ ৷ জীবন যখন ওষ্ঠাগত, পালিয়ে বেড়ানো শুরু করলাম, সকাল বেলা ঠিক স্কুলে যাবার আগ মুহুর্তে বেড়িয়ে যেতাম, আশে পাশে ঝোপঝাড় দেখে লুকিয়ে পড়তাম, মা দেখতাম একটা লাঠি হাতে আমাকে খুজে বেড়াচ্ছে ৷ গাছের আড়ালে লুকিয়ে এমনো দিন আছে ঘুমিয়ে যেতাম ৷ এভাবে সর্বোচ্চ বিশ দিন পর্য্ন্ত মাকে পরাস্ত করতে পেরেছি ৷ আমার আব্বা আবার এদিক দিয়ে সরেষ ৷ মা আমাকে মেরে ধরে বেধে আব্বার হাতে ধরিয়ে দিত, আব্বা অফিস যাবার পথে আমাকে সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেত, মাঝে মাঝে আব্বা সফল ভাবে স্কুলের গেট দিয়ে ঢুকিয়ে যেতে পারতো, আমাদের স্কুলের গেট ছিল দুইটা পয়তাল্লিশ ডিগ্রি এঙ্গেলে দুইটা গেট, আব্বা এক গেট দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে চলে যেত, আমি অন্য গেট দিয়ে ভদ্র লোকের মত হেটে বেরিয়ে যেতাম, আবার কোন দিন আমি মাঝ পথে পেট ধরে বসে পড়তাম, খুব দুর্বল লাগছে দাড়াতে পারছিনা, আব্বা বোকার মত আমাকে নিয়ে উল্টো পথে রওনা হতো, মানে বাসার দিকে ৷ এসে মায়ের বকুনী শুনতো, আমি তখনো অসুস্থ, মা কি আর বুঝেনা? আব্বা চোখের আড়াল হলেই কান চেপে ধরতো, কানের লতিতে কট করে শব্দ হতো, ব্যাথা পেতাম তাও ভালো লাগতো আজ স্কুলে যেতে হবেনা ৷
10563127_450611025082220_2267748756821920411_n
আমার খেলার সাথী জুটলো কোয়াটারের পাশের বস্তির ছেলে গুলা ৷ ওরাও স্কুলে যায়না, আমিও যাইনা ৷ একসঙ্গে ঠাটানো রোদে ঘুড়ি ওড়াতাম, গুলি (মার্বেল) খেলতাম, আমার গায়ের রং ফর্সা থাকাতে রোদে পুড়লে তেমন এসে যেতনা, গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা পুকুরের পানিতে গা ডুবিয়ে রাখতাম, পানির মধ্যে ধরাধরি খেলতাম দীর্ঘ সময় পর হাত পায়ের নখ হলুদ হয়ে যেতো ৷ এদিকে আব্বা আর মায়ের সাথে স্কুলের শিক্ষকদের পরিচয় ভালো ছিল, প্রতি বছর ডিসেম্বরের শেষের দিকে শিক্ষকদের বাসায় দাওয়াত করে খাওয়ানো হতো, উপলক্ষ্য ছিল প্রায় সব ক্লাশেই বড় ভাইয়ের মেধা তালিকাতে প্রথম হওয়া আমার কথা শুনে মনে হতে পারে আমি ছাত্র হিসেবে একেবারেই গন্ড মুর্খ, সত্যি বলতে আসলে তা না, কোন ক্লাশে আমি জীবনে প্রথম বা দ্বিতীয় হতে পারিনি তবে সব সময় দশ জনের মধ্যেই থাকতাম ৷ আমি তাতেই খুশি ছিলাম ৷ নির্লোভ মানুষ আর কি ৷ আসলে ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাশে সময় নষ্ট না করে ঐ সময়টা খেলা করে পরীক্ষার আগের কয়দিন পড়েই পরীক্ষা দেবার ব্যাপারে আমার আগ্রহ বেশী ছিল ৷
10599639_450654781744511_6646881460944075924_n
যাই হোক মা একেবারে চুড়ান্ত কমপ্লেইন করলো স্কুলের একজন শিক্ষক কে, নাম ছিল অশ্বিন কুমার, আমরা বাবু স্যার বলে ডাকতাম, স্যার মাকে বললো, একদিন খালি স্কুলে ধরিয়ে দিয়ে যান, সাইজ করে দিচ্ছি ৷ এরপর থেকে আমার বড় ভাই (তিন বছরের বড়) একটা দল বানাইলো, আমাকে ধরার দল, দলে তার সব বন্ধুরা ছিল, সকাল বেলা পালানোর জন্য নিচে নামলেই ঝাপিয়ে পড়ে দাবড়ে ধরতো, মিশনের প্রথমদিন ই ধরে ফেললো, হাত পা ধরে পাজা কোলে করে স্কুলে নিয়ে গেল, বাবু স্যারকে ডাকলো, ততক্ষনে আমার দশ দিন পেরিয়ে গেছে স্কুলে যাইনি, ক্লাশ টিচার ছিল হুনু স্যার (আব্দুল খালেক) ৷ খুব ভয়ংকর বদরাগী স্যার ছিল, স্যার করলো কি আমার হাত চেপে ধরলো, বাইরে নিয়ে রোদের মধ্যে দুই হাতে দুইটা আধলা ইট চাপিয়ে, এক পায়ে দাড় করিয়ে রাখলো, কি বলবো আর, ঐ দিন টা ছিল এখনো পর্যন্ত জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিন বেইজ্জত হবার দিন, ছেলে মেয়েরা ক্লাশের জানালা দিয়ে দেখতেছিল, আর হাসতেছিল ৷ রোদে দরদর করে ঘামতেছিলাম, আর ঐভাবেই মারা যেয়ে মাকে কঠিন একটা শিক্ষা দেবার সংকল্পে ছিলাম, দুয়া পড়তেছিলাম, আল্লাহ আমি যেন এই অবস্থা তেই মরে যাই, মা তো শিক্ষা পাক ৷ যাই হোক সেদিন আর মরিনি ৷ পরের কয়দিন নিয়মিত স্কুলে গেলাম ৷
10678615_458968490913140_6816263225791002862_n
কিছুদিনের মাথায়, আমার এক ক্লাশের এক ছেলের সাথে মারামারি করে তার গায়ে প্রসাব করে দিয়ে পালিয়ে চলে এসেছিলাম, ঐ ছেলেও আমাকে মারার জন্য খুজতেছিল, ওদিকে স্যারের কানেও পৌছে গেছিল ও দিকে মা, মা কিছু আর বলেনি, পরে স্কুলে যেতেই লজ্জা পাচ্ছিলাম ৷ কোয়াটারের ছাদে টাদে পালিয়ে কিছুদিন বেচে ছিলাম, পরে আবার ধরিয়ে দিয়ে আসলো, এবার স্কুলের অফিস বিল্ডিং এর সামনে কান ধরে দাড় করিয়ে দিল ৷ এমন সময় দেখি চা ওয়ালা বাবলু ভাই, স্যারদের চা দিতে এসে আমাকে ঐ অবস্থাতে দেখে মিট মিট করে হাসতেছিল ৷ ওনার দোকানে প্রতিদিন আব্বার সাথে চা খেতে যেতাম ৷ ওনার সামনেও মান সম্মানের বিসর্জন দিয়ে দিলাম, কি আর করার, জজ বারিস্টার যে হতে হবে পড়াশোনা করে ৷ কিছুদিন পর আবার হারিয়ে গেলাম, পুরানা হিরো সাইকেলে চেপে এদিক সেদিক পালিয়ে কুল পেলাম, এবার বড় ভাই তার দলবল নিয়ে এমন ধাওয়া দিল, পিচের রাস্তায় দৌড়াতে যেয়ে হোচট খেয়ে পড়ে গিয়ে হাতের চামড়া টামড়া ছুলে মুলে একাকার, রক্ত বেরিয়ে দুই হাতের কনুই ছিদ্র হয়ে গেলো, কুচি পাথর ঢুকে গেলো কনুইয়ের কাটা জায়গাতে ৷ মায়ের সে কি কান্না আমাকে জড়িয়ে ধরে, সেদিন খুব মায়া লাগছিল মায়ের জন্য ৷ মা কানছে আর আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবিস্কার করার চেষ্টা করছি পরবর্তী পদক্ষেপ মা কি নিতে পারে? যাইহোক মায়ের দয়া হলো, হাত ভালো হবার জন্য এক সপ্তাহ সময় পেলাম ৷ এভাবেই ধুকে ধুকে পার করলাম প্রাইমারী জীবন, সত্যি বলতে যা সাজা পেয়েছিলাম সব ই দুষ্টামি করার জন্য, কখনো পড়া না পারার জন্য পিটুনী খাইনি ৷ পরে ভর্তি হলাম কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ৷
kushtia_zilla_school
জিলা স্কুলে ও খুব বিশ্বস্ত ও সিনসিয়ারলি ক্লাশ টিলাশ করতাম, কারন স্যার গুলা ভয়ংকর কিসিমের, চেহারা দেখলে মনে হতো পিটিয়ে হাড় মাংস এক করে ফেলবে ৷ ক্লাশ সেভেনে থাকতে ক্লাশ টিচার নাসিমা বুলবুল বুঝে গেছিলো, আমি মিচকা শয়তান এটাও জানতো বাড়ির আদরের ছোট ছেলে, তাই নাম দিয়েছিল রাজধর (রবীন্দ্রনাথের মুটুক গল্পের শয়তান রাজকুমার টা) ৷ ক্লাশ এইটে থাকতে ছেলেরা দেখতাম শেষ ক্লাশের আগে স্যারদের চোখ ফাকি দিয়ে পালিয়ে বাড়ি চলে যেত, আমি ও একদিন একজনের পামে পড়ে চলে গেলাম ৷ পরের দিন দেখি এক টিচার ক্লাশের গর্ব করে কিছু সৎ ও সিনসিয়ার ছেলেদের নাম বলতেছিল, আমার নাম ও আসলো, এক বদমাইশ সাথে সাথে বলে ফেললো, স্যার ও গত কাল ও পালিয়েছে ৷ স্যারের ইজ্জত আর আমার ইজ্জত একসাথে ঘেটে ঘ হয়ে গেল ৷

মাহবুব মানিক
গবেষনা সহকারী
ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লাইড সাইন্স, মারসেবুর্গ ৷
হালে (জালে)
জার্মানী

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

Leave a Reply