আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশ গুলা থেকে যখন আমরা প্রথম বারের মত উন্নত দেশে পাড়ি জমাই, আমরা যতটাই সভ্য সমাজে থাকিনা কেন, দেশে থাকতে বন্ধুমহল বা পরিচিত জনের মাঝে যতটাই স্মার্ট থাকিনা কেন, আমাদের কে উন্নত দেশে উন্নত পরিবেশে প্রাথমিক অবস্থায়, ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে হয় ৷ রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পের ফটিকের মত কিছুটা কৃত্রিম বন্দী দশা বা অনভিপ্রেত জীবন তৈরী হয় ৷ নিজেকে উন্নত শহরের চাকচিক্যের সাথে অনেক বেমানান মনে হয় ৷ যেমন টা সিনেমাতে দেখতাম, গ্রাম থেকে চপ্পল পায়ে কাধে ছেড়া ব্যাগ ঝুলিয়ে নায়ক মান্না গ্রামের বাবা বা চাচার দেয়া ছোট্ট চিরকুট হাতে ঢাকায় চৌধুরী সাহেবের চকচকে ডুপ্লেক্স বাড়ি তে উঠতো ৷
জীবনে প্রথমবার জার্মানী নামের উন্নত দেশে পাড়ি জমানো, বার্লিনের টাগেল বিমান বন্দরে ল্যান্ড করার পর থেকেই সভ্যতার সাথে অসম যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় ৷ প্রথমে ইমিগ্রেশন সেরে লাগেজের জন্য অপেক্ষা, তখনো আসে পাশের মানুষ গুলার সাথে নিজেকে তুলনা করলে মনে হচ্ছিল, মাথার তালুতে এক খাবলা সরিষার তেল চটচটে করে মাখিয়ে পরিপাটি সিথি, সাথে জামার কলারের শেষ বোতাম টি গলায় লাগিয়ে দাড়িয়ে থাকা গ্রামের সহজ সরল যুবক ৷ এটা আসলে এক রকম অদৃশ্য হীনমন্যতা, যদিও সেদিন আমি জিন্স টিশার্ট পায়ে নাইকি ব্রান্ডের কেডস পড়া ছিলাম, তারপরেও মধ্যবিত্ত দেশ থেকে ধনী দেশে প্রবেশের পরে এই হীনমন্যতা থাকা টা অস্বাভাবিক কিছুনা ৷ মিনিট পাঁচেক পরেই লাগেজ হাতে পেলাম, ইয়া বড় দুইটা লাগেজ, নিজের শরীরের তুলনায় অসম্ভব ভারি, ছোট্ট ছোট্ট চাকা লাগানো ব্যাগ দুটো ঠেলে নিয়ে যাওয়া কষ্ট সাধ্য ৷ লক্ষ্য করলাম সবাই ভারী লাগেজ বহনের জন্য ট্রলি ব্যবহার করছে, কোন সিঙ্গেল ট্রলি চোখে পড়লোনা ৷ ট্রলি গুলা একে অপরের পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে মোটা চেইন দিয়ে ক্লিপ তালার মত আটকে রাখা ৷ লাগেজ দুটো রেখে এগিয়ে গেলাম ট্রলি আনতে, ট্রলি আলাদা করার সিস্টেম টা অজানা ছিল, বেশ কিছুক্ষন টানাটানি করলাম, ছাড়াতে পারলাম না, ততক্ষনে লক্ষ করলাম, বাহির থেকে গ্লাসের ভিতর দিয়ে কিছু দর্শক তাদের পরিচিত যাত্রীকে সনাক্ত করার বদলে বেশ মজা করে আমার কান্ডকীর্তি দেখছিল, তাদের চোখে চোখ পড়তেই চরম লজ্জা পেয়েছিলাম, কিছুটা ভাব করলাম ট্রলি আমার লাগবেনা, এমনিতেই নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম, আস্তে করে আড়ালে চলে গেলাম ৷ অবশেষে একটু ভিতরে গিয়ে ওখানকার একজন ভদ্রলোক কে ডেকে সমস্যার কথাটা বললাম, একটা ট্রলি কিভাবে নিবো, তার কাছে চাবি ছিল, চাবির পিছন দিকটা দিয়ে ট্রলির হ্যান্ডেলের কাছে ফুটোতে একটা গুতা দিল, চেইনের লক খুলে ট্রলি আলাদা হয়ে গেল, কোন রকম ইজ্জত বাচিয়ে ট্রলিতে লাগেজ উঠিয়ে দে ছুট ৷ পরে জেনেছি ট্রলি গুলাতে এক টাকার কয়েন ঢুকিয়ে আলাদা করতে হয় ৷ বর্তমানে সুপারশপের শপিং ট্রলি গুলাও একই সিস্টেমে ব্যবহার করতে হয় ৷
দেশে থাকতেই খবরে, সিনেমাতে জেনেছিলাম, পশ্চিমা দেশের বিমান বন্দর গুলাতে মুসলিম নাম আগে পিছে জোড়া থাকলেই ঐ দেশ গুলাতে হেনস্তার শিকার হতে হয়, এমন কি মাই নেম ইজ খান খ্যাত শাহরুখ খান যেখানে হেনস্তার শিকার হয়, সেখানে আমার তো সিরিয়ালেই নাম থাকার কথা না, যদিও এই রেসিজম এর সব কাহিনী ঐ নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরে ৷ তাতে কি পশ্চিমা তো পশ্চিমা ই ৷ বের হবার আগে ফাইনাল চেকিং এ যেয়ে দেখি বিশেষ পোশাক পড়া দুই দুধ সাদা ভদ্রলোক, লাগেজের দিকে তাকাতেই, পকেট থেকে ছোট্ট ছোট্ট চাবি বের করে, লাগেজ দুইটাই চিচিং ফাক করে দিলাম, তারা জামা কাপড় নেড়ে চেড়ে নিচ থেকে খুজে খুজে ছোট ছোট মশলার প্যাকেট গুলা দেখতে লাগলো, ভুত দেখার মত প্যাকেট টিপে টিপে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছে, অবশ্য আমাকে তারা কিছুই জিগেস করছেনা, নিজেদের মত করে নিজেরাই দেখছে, একগাদা মশলা কিনেছিলাম, লোক মুখে শুনেছি এখানে মশলার আকাল ৷ মশলা নিয়ে গবেষনার পর ধরলো গোসলের মগ, নীল রংয়ের বড় মগ, সেটা রেখে ধরলো মাল্টিপ্লাগ ৷ জায়ান্ট সাইজের একটা মাল্টিপ্লাগ নিয়েছিলাম, সঙ্গে করে, সেটা নেড়ে চেড়ে কানে ঝাকিয়ে ভেতরের দুর্বল নাট বল্টুর ঝনঝন শুব্দ শুনে রেখে দিয়ে আমাকে প্রস্থান করার আদেশ দিল, এভারেস্ট জয়ের হাসি দিয়ে লাগেজ ট্রলিতে গুছিয়ে আবার সেমি দৌড় ৷

বার্লিন থেকে দুই ঘন্টার পথ, হালে (যালে) শহর, সাজানো গোছানো পরিপাটি ছোট্ট একটা সুন্দর শহর ৷ জার্মান ভাষার শব্দ গুলা কিছুটা কিম্ভুতকিমাকার হলেও বর্ণ গুলো ইংরাজী থাকাতে সহজে পড়া যায়, যদিও বর্ণ গুলার উচ্চারনে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে ৷ সেটা নিয়ে ও মজার কাহিনী ছিল, পরে বলছি ৷ যাই হোক হালে (যালে) শহরে আমার বাসা যেখানে নিয়েছিলাম, স্থানটার নাম তখনো জানতাম না, মানে আর কি আয়ত্ব করতে পারিনি ৷ আগেই বলেছি, শব্দ গুলার উচ্চারন যথেষ্ট জটিল ৷ স্থান টার নামটা উচ্চারন করতে গেলে আমার দাঁত আর জিহবাতে প্যাঁচ লেগে যাবার দশা, নামটা ছিল An der feuerwache, বাংলা উচ্চারন আন দেয়ার ফয়ার ভাঁখে, ইংরাজী মানে দাড়ায় at the fire station. নিরুপায় হয়ে ট্রাম স্টপেজের বোর্ড থেকে উদ্ভট উচ্চারনের নামটা একটা কাগজে লিখে নিয়েছিলাম ৷ ঐ স্থানে যে ট্রাম গুলা যাতায়াত করে, ঐ ট্রাম নাম্বারগুলাও লিখে নিয়েছিলাম৷ কাগজ দেখে দেখে ট্রাম নাম্বার গুনে গুনে ট্রামে উঠতাম, বসতাম, ট্রামের জানালার ধারে, আর বিভিন্ন স্টপেজে পৌছলে জটিল জটিল নাম গুলোর সাথে আমার স্টপেজের নামের বানান টা মিলিয়ে নিতাম, কিন্তু এতেও হলোনা, আমার আরো সমস্যা দেখা দিল, সমস্যা টা একটু অদ্ভুত, বাসা থেকে অচেনা শহরে একমাত্র গন্তব্য ছিল আমার ভার্সিটি, শহর টা খুব ছোট হওয়াতে বাংলদেশী তেমন কেউ ছিলনা, বা চিনতাম না, একটা ছেলের সাথে কালক্রমে পরিচিত হলাম, ওর নাম ছিল, নাসিফ অভি, জুনিয়র একটা ছেলে, ব্যাচেলরে পড়ে ৷
এবার সমস্যার কথাতে আসি, বাসাতে উঠার প্রথমের পরপর তিন থেকে চার দিন ভার্সিটির পথের দিকের ট্রামে না উঠে উল্টো পথের ট্রামে উঠে পড়েছিলাম ৷ আসলে নতুন পরিবেশে কোন টা উত্তর, দক্ষিন, পুর্ব, পশ্চিম কিছুই বুঝতাম না ৷ উল্টো পথে দুই স্টপেজ পরে অনেক বড় একটা সুপার মার্কেট ছিল, ঐখানে পৌছানোর পর বুঝতাম, উল্টা পথে চলে আসছি, মার্কেট টা চোখে পড়লেই দাত দিয়ে জিভ কাটতাম, নিজে নিজে লজ্জা পেয়ে, তড়িঘড়ি করে নেমে গিয়ে অন্য পাশের ট্রামে উঠতাম ৷ এর পরে বুদ্ধি করে যে পথে যাবো সেই দিকে উচু বিল্ডিং গুলো মার্ক করে নিয়েছিলাম, এভাবে ভুল শুধরেছিলাম ৷

প্রথম ট্রামে চড়ার অভিজ্ঞতা টাও খুব একটা সুবিধার ছিলনা ৷ প্রথম যেদিন ট্রামে উঠবো, আমি জানতাম না আসলে ট্রামের গেট কি করে খুলতে হয়, ট্রামের দুই গেটের মাঝখানে মোবাইলের টাচস্ক্রিনের মত একটা ছোট একটা সুইচ আছে, আমার জানা ছিলনা এটার ব্যবহার, আসলে প্রথমবার, দ্বিতীয়বার, সহ বেশ কয়েকবার ট্রামে যখন উঠে ছিলাম, সবার সঙ্গে গণহারে উঠে পড়েছিলাম তাই গেট আগে থেকেই খোলা পেয়েছিলাম, গেট খোলার কৌশল টা তখনো জানতাম না ৷ ভেবেছিলাম গেটের সামনে গিয়ে দাড়ালে ড্রাইভার মামাই গেট খুলে দেয়, কিন্তু যেদিন একা উঠতে গেলাম সেদিনই ঘটলো বিপত্তি, ঐ মুহুর্তে স্টপেজে যাত্রী আমি একা, ট্রাম থামা মাত্র সেই রকম ভাব একটা নিয়ে গেটের সামনে গিয়ে দাড়ালাম, কিরে গেট খোলেনা কেন? একটু এপাশ ওপাশ করে সরে দাড়ালাম, পাশ ফিরে দাড়ালাম, আগে পিছে করে দাড়ালাম, গেট আর খুলেনা, এদিকে লক্ষ করলাম, ট্রামের ভিতরের সাদা সাদা যাত্রী, সবাই হা করে আমার নড়া চড়া পর্যবেক্ষন করছে ৷ অনেকে আবার সরাসরি না তাকিয়ে আড় চোখে দেখতে লাগলো, যেহেতু বাঙ্গালী তাই নিজেও ভাব নিতে কম করা যাবেনা, শেষ মেষ মিঃবিনের মত এমন একটা ভাব দেখালাম, ট্রামটা পছন্দ হয়নি, যাত্রীগুলাও সুবিধার না, নাহ এই ট্রামে যাবো না, তাই উঠলাম না, পরের টাতে যাবো ৷ আসলে গেট কেমনে খুলতে হয় সেটাই জানতাম না ৷ কিছুক্ষন পরে স্টপেজে কিছু লোক আসলো, এবার একটু দুরে গিয়ে দাড়ালাম, ওদের দেখলাম, কেমন করে গেট খোলে, ট্রাম দাড়ানো মাত্র কেউ একজন মাঝের ঐ সুইচে টিপ দিল, দরজা চিচিংফাকের মত দু দিকে সরে গেল ৷ তারপরেই জিনিসটা আয়ত্ব করতে পারলাম ৷

ভার্সিটিতে ভর্তি হতে যাবো ৷ ঐটা ছিল আমার প্রথম গন্তব্যের প্রথম দিন ৷ পথ ঘাট কিছুই চিনিনা, সাথে নেই ইন্টারনেট ৷ আগে থেকে ইন্টারনেটে ভার্সিটি এডমিন ভবনের লোকেশন দেখে নিয়েছিলাম, ভার্সিটির এডমিন ভবনে যাবার পথে saline ( জালিনে) নামে একটা জায়গায় ভুল করে নেমে পড়লাম, আসলে জানতাম না কিভাবে, কোন পথে যাবো, ভেবেছিলাম বেশি চলে গেছি, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, পরে জার্মানীর সেই জার্মান পাড়ার পরিচিত ছোট ভাই নাসিফ অভি কে ফোন করলাম, জাহাজ রুস্তমের মত আমাকে উদ্ধারের জন্য, ভয়ার্ত হয়ে তাকে ফোন দিলাম, সে ফোনে বললো ভাই আপনি কোন স্টপেজে আছেন? আমি স্টপেজের নাম পড়ে বললাম স্যালাইন (saline), ও হাসলো, বললো ভাই ঐটা স্যালাইন না জালিনে (saline), আসলে জার্মান রা “s” কে “ছ” বা “স” বলেনা, বলে “য” বা “জ”, আমার এত সব জানা ছিলনা, সে বললো “ভাই আপনি ঐখানে থাকেন আমি আসতেছি”, পরে জাহাজ রুস্তম মানে সেই ছোট ভাই টা এসে উদ্ধার করে এই অভাগা কে বাসায় নিয়ে গেল ৷
জার্মানীর আধুনিক জীবন প্রবাহের প্রথম কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ার পরে আরেক টা ঘটনা ঘটিয়ে বসলাম, ট্রামে বসে আছি, ট্রামে তখন অনেক মানুষ, ভিড়ের মধ্যে নড়া চড়ার জায়গা কম, তখন হঠাৎ একজন সাদা বয়স্ক মহিলার গায়ে আচমকা পা লেগেছিল, সাথে সাথে হাত দিয়ে গা ছুয়ে আমার হাত টা চুমু খেয়েছিলাম(যেমনটা আমরা সবাই দেশে করে থাকি) উনি হা করে কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে ছিলেন! হয়তো ভাবছিলেন, এই ননব্রান্ডের জিনিস টা কইত্থেকে আইলো আবার হয়তো ওনার মনে ততক্ষনে শাহরুখ খানের দিলওয়ালে দুলহানিয়ার গান বাজছিল, পরক্ষণে আমার মনে পড়লো, ছিঃ ছিঃ ছিঃ এইটা কি করলাম, আমি তো বাংলাদেশে নাই ৷বদঅভ্যাস টা ত্যাগ করার জন্য তখন ই মৌন শপথ করে ফেললাম ৷ এরপরে কখনো এমন হয়েগেল অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছি ৷

Mahbub Manik
Research Assistant
Polymer Engineering
University of Applied science, Merseburg
Halle, Germany
FB ID: www.fb.com/mahbub.manik1

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

One thought on “প্রথম জার্মানীতে বিচিত্র কিছু অভিজ্ঞতাঃ”

Leave a Reply