একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণের খবর শুনে একুশের প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী।
ভাষার দাবিতে তখন সারাদেশ উত্তাল, রাষ্টভাষা বাংলার দাবিতে চট্টগ্রামে গঠিত হয়েছে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। এই কমিটির আহবায়ক এর দায়িত্ব নিলেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী । জোর বেঁধে প্রস্তুতি চলছে ভাষা আন্দোলন সফল করার। কিন্তু বিধি বাম। দিনরাতের এত ধকলে কবি অসুস্থ হয়ে পড়লেন জ্বর এবং জলবসন্তে। প্রচণ্ড জ্বরে শয্যাশায়ী কবি খবর পেলেন ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর খবর, শুনলেন রফিক, বরকত সালামের আত্মত্যাগের খবর। ক্রোধান্বিত বেদনাতুর কবি হাত বাড়ালেন কাগজ কলমের খোঁজে। এতটাই অসুস্থ ছিলেন তিনি যে লেখার ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু আবেগ বিহ্বল কবিকে রোধ করার সাধ্য নেই, রাগে ক্ষোভে উদ্বেলিত কবি মুখে মুখেই বলতে থাকলেন একের পর এক লাইন-
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার উর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতো
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।
জন্ম নিল একুশের প্রথম কবিতা “কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি”।
সেসময় কবির পাশে ছিলেন আরেকজন নিবেদিত সহকর্মী ননী ধর। কবির মুখে বলা কবিতা তিনি লিপিবদ্ধ করে রাখলেন। কিচ্ছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সাংবাদিক-সাহিত্যিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। সিদ্ধান্ত হল কবিতাটি দ্রুত প্রকাশ করার। ঠিক হল আন্দরকিল্লায় কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকা আকারে ছাপা হবে। তবে পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজটি সমাধান করাও এক দুরূহ ব্যাপার। তাই পরিকল্পনা নেয়া হল সারারাত গোপনে প্রেসে কাজ করে সকালেই পুস্তিকাটি প্রকাশ করার। শীতের গভীর রাত, কম্পোজ ও প্রুফের কাজ প্রায় শেষ- এমন সময় পুলিশ হানা দিল প্রেসে। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস লুকিয়ে পড়লেন। প্রেসের কর্মচারীরা অতি দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেললেন যে পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার পুরোদমে শুরু হল ছাপার কাজ। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্মচারীদের উদ্যম এবং তৎপরতায় গোপনে পুস্তিকাটির প্রায় ১৫ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরণের জন্য মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ হয়। এর দাম রাখা হয় দুআনা। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদিঘীর ময়দানে কবিতাটি প্রথম জনসম্মুখে আবৃত্তি করলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে ময়দানে জড়ো হওয়া জনতা ফেটে পড়ল বিক্ষোভে। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে উঠল পাক মসনদ। শত সহস্র বুলেটের চাইতেও এই ক’টি লাইন কত শক্তিশালী তার প্রমাণ মিলল – পাক সরকার কবিতাটি কিছু দিনের মধ্যেয় বাজেয়াপ্ত করলেন। কবিতাটি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ.-র বিরুদ্ধে জারি করা হল গ্রেফতারি পরোয়ানা। চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে দ্রুত গ্রেফতারও করা হয়।
দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পরে চৌধুরী জহুরুল হক এই কবিতার দুর্লভ কপি উদ্ধার করেন।
ইউটিউবের এই লিংকে goo.gl/Jym08i কবিতাটির কিছু অংশ শুনতে পারবেন।
পুনশ্চঃ ছোটবেলায় একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় কবির হাত থেকে পুরষ্কার নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। প্রাক পুরষ্কার পর্বে কবি একুশের স্মৃতিচারণ করছিলেন, ”ছোট আমি-র” কাছে মনে হচ্ছিল বুড়ো আর কত বকবক করবে। ছোট বয়সে বক্তৃতা জিনিসটা খারাপ লাগা স্বাভাবিক, তবুও আজ পেছনে ফিরলে সেইদিনগুলোর জন্য আফসোস হয়। সেদিন মন দিয়ে শুনলে হয়ত আজ এই লেখাটির জন্য ইন্টারনেট ঘাঁটতে হত না।
.