আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যাবস্থা অনুযায়ী খুব কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী ই পারে আগে থেকে জীবনের লক্ষ উদ্যেশ্য ঠিক করতে। ক্লাশ ফাইভ থেকে পরীক্ষায় মুখস্থ রচনা লিখে আসতাম আমি একজন ডাক্তার হব, সবাই এইটাই শুধু স্বপ্ন দেখত এর বাহিরে কোন স্বপ্ন দেখা সত্যিই অসম্ভব ছিল, এখন তো তথ্য প্রযুক্তির যুগে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবক রা অনেক সচেতন,গুগলে সার্চ দিলেই ইনফরমেশন এর অভাব নাই। আমাদের সময়, আমি যখন ক্লাশ ফাইভ/সিক্সে পড়তাম তখন আমাদের ফ্যামেলি তে মনে হয় ১২০০০ টাকা দিয়ে গ্রামীন সিম কিনে আনা হয়েছিল আর একটা নকিয়া ১১০০ ফোন ছিল তা ও আম্মুর হাতে থাকতো এটা৷
তখন গুগলের নাম ই শুনি নাই । সে জন্য আমরা চাইলে ও ছোট বেলা থেকে জীবনের লক্ষ উদ্যেশ্য ঠিক করতে পারি নাই। যাই হোক বলতে গেলে উদ্যেশ্য বিহীন পড়াশোনা করেই ক্লাশ ফাইভ এবং পরবর্তীতে এস এস সি তে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে খুব ভালো রেজাল্ট করি। এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট টা এস এস সি র মত ভালো হয় নাই, সেজন্য মনটা ভীষণ খারাপ ছিল, বলতে গেলে মনে হইছিল পড়াশোনা ই ছেড়ে দিব। তখন বয়স কম থাকায় বাস্তবতা এতোটা বুঝিনাই বিধায় ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষার কোচিং এ ভর্তি হয়ে ও ভালো করে প্রিপারেশন নেই নাই, আমার আব্বু ইউকে তে থাকতেন, আমাকেই আমার আম্মু,ছোট ভাই বোনদের দেখাশুনা করতে হত যেহেতু আমি পরিবারের বড় ছেলে ছিলাম। সেজন্য আমার সিলেটের বাহিরে কোন পাবলিক ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া হয়নাই। শুধু মাত্র সাস্টে একটা ইউনিটে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, যেখানে প্রিপারেশন ই নাই সেখানে চান্স পাওয়ার তো প্রশ্নই উঠেনা৷ কিছুদিন যাওয়ার পরে দেখলাম কিছু বন্ধুবান্ধব যারা পাবলিকে পড়তে পারেনাই তারা ঢাকায় ভালো ভালো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হচ্ছে, আমি ও সিদ্ধান্ত নিলাম তাহলে আমিও ওদের সাথে ভর্তি হব কিনতু আমার আম্মু, ছোট ভাই বোন কিছুতেই রাজি হল না, বিধায় আর ঢাকায় পড়াশোনা করার জন্য যাওয়া হলোনা।

এ সময় আমার পরিচিত কিছু বড় ভাইরা ছিলেন যারা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিভিন্ন সরকারী বে-সরকারী ব্যাংকে জব করতেন উনারা আমাকে পরামর্শ দিলেন আমি যাতে সিলেটের কোন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হই, তাহলে অনার্স শেষ করার পর ব্যাংকে, কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভালো জব পাওয়া যাবে। উনাদের পরামর্শ অনুসারে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম এবং প্রথমে রাষ্ট্র বিজ্ঞান এ চান্স পেলাম কিনতু এই সাব্জেক্টে পড়লাম না যেহেতু এটা মানবিক বিভাগের সাব্জেক্ট ছিল, পরবর্তীতে মাইগ্রেশন করে পেলাম প্রাণিবিদ্যা সাব্জেক্ট, শুরু করলাম এই সাব্জেক্ট নিয়ে পড়াশোনা কিনতু কিছু দিন যাওয়ার পর কেন জানি আমার ন্যাশনাল ভার্সিটিতে পড়তে ভালো লাগছিলো না, তাছাড়া সেশনজট এর কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে সিলেটের একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে BBA নিয়ে ভর্তি হলাম, আস্তে আস্তে পড়াশোনায় মন বসল সাথে ভালো কিছু বন্ধুবান্ধব ও পেলাম। নিজেকে পার্সোনালি ডেভোলাপ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ক্লাব, যেমন ডিভেটিং সোসাইটি, সোসিয়াল সার্ভিসেস ক্লাব, রোটারেক্ট ক্লাব সহ অন্যান্য ক্লাবে নিজেকে সম্পক্ত করলাম সক্রিয় ভাবে পাশাপাশি পড়াশোনা ও চালিয়ে গেলাম। খুব সম্ভবত ২০১২ কিংবা ২০১৩ সালে ফেইসবুকে একটি গ্রুপে মেম্বার হলাম যে গ্রুপটি জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষায় বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করে। এই গ্রুপে মেম্বার হওয়ার কিছু দিন পরে নিজেকে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম, গ্রুপের পোস্ট দেখতাম আর ভাবতাম হ্যা আমি ও মাস্টার্স দেশের বাহিরে করব এবং জার্মানি তে ই বিনা টিউশন ফি তে করব৷ আস্তে আস্তে এক্সটা কারিকুলার এক্টিভেটিজ ও পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম এবং এবং নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম যে গ্রাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্স আমি দেশের বাহিরে করব ই। ভার্সিটিতে ১১ সেমিস্টার শেষ করে সিলেটে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চে ইন্টার্নশিপ শুরু করলাম, ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন খুব কাছের একজন বড় ভাই, ইন্টার্নশিপ শেষ করে রিপোর্ট সাবমিট করার পর উনি আমাকে অফার দিলেন যে এক বছর যদি উনার ব্যাংকে মার্কেটিং কিংবা সেলস এ কাজ করি তাহলে এক বছর পর আমার জব পার্মানেন্ট হয়ে যাবে ক্যাশ অফিসার কিংবা রেমিট্যান্স অফিসার হিসেবে। আমি ভাইয়াকে বললাম আমি বাংলাদেশে জব করব না, আমি বিদেশে মাস্টার্স করব, কারন আমার নিজের উপর আত্নবিশ্বাস ছিল যে আমি যেটা কর‍তে চাচ্ছি সেটা আমি করতে পারব হয়তোবা সময় কম কিংবা বেশি লাগবে। আমার সাথে যারা ইন্টার্নশিপ শেষ করেছিল তারা ঠিকই ব্যাংকে জয়েন করেছিল সেলস অফিসার হিসেবে। অন্যদিকে কাছের বন্ধুবান্ধবরা BBA শেষ করেই সাথে সাথে MBA তে ভর্তি হল, সবাই আমাকে তাদের সাথে ভর্তি হলে বলল কিন্তু আমি ভর্তি হই নাই, কারন আমার স্বপ্ন ছিল আমি বিদেশে মাস্টার্স করব, সেটা করবই আজ কিংবা কিছু দিন পর৷ আমি MBA তে ভর্তি না হয়ে একটা ইন্সটিটিউট এ IELTS এ ভর্তি হলাম৷
তিন /চার মাস IELTS কোর্স করলাম খুব মনযোগ দিয়ে, আলহামদুলিল্লাহ IELTS পরীক্ষার এক্সপেকটেড রিজাল্ট আসলো মনে হল স্বপ্ন পূরনের অনেক বড় একটি ধাপ শেষ করলাম।

আরেক টি কথা, ব্যাচেলার এ থাকা অবস্থায় আমার আব্বু আমাকে অনেক বার বলছেন ইউকে তে আন্ডারগ্রাজুয়েট এ এপ্লাই করার জন্য কিন্তু আমি প্রত্যেক বার ই বলেছি আমি মাস্টার্স করব দেশের বাহিরে, কারন গ্রপের বিভিন্ন পোস্টে পড়েছিলাম জার্মানি তে ব্যাচেলর থেকে মাস্টার্স এ পড়তে আসা তুলনামূলক সুবিধার। ইভেন যখন জার্মানি তে মাস্টার্স এ এপ্লাই করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন ও আমার পরিবার চেয়েছে আমি ইউকে তে যাই যেহেতু পরিবারের সবাই এখন ইউকে তে থাকে, কিন্তু আমার কাছে ব্যাক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে যেখানে আমি পুরোপুরি ফ্রি তে পড়াশোনা করতে পারব সেখানে কেন ৩০/৩৫ লক্ষ টাকা খরছ করব, সেজন্য অন্য কোথাও না গিয়ে জার্মানিতেই আসি।

যাই হোক সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, পরিবার কে বুঝিয়ে উইন্টার ২০১৯ সেমিস্টার এ ইউনি এসিস্ট এর মাধ্যমে মাত্র ৩ টা ইউনিভার্সিটিতে তে এপ্লাই করেছিলাম কারন IELTS পরীক্ষা দিতে অনেক বেশি সময় নিয়েছিলাম যার কারনে অনেক ইউনিভার্সিটি তে ভর্তির ডেডলাইন শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহর রহমতে ও মা, বাবার দোয়ায় এবং সিজিপিএ মোটামুটি সন্তোষজনক থাকায় ২ টি ইউনিভার্সিটি থেকে অফার লেটার পাই। অফার লেটার পেলে ও এম্বেসির এপায়ন্টমেন্ট পাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব হয় নাই, পরবর্তীতে এম্বেসিতে মেইল দিয়ে স্পেশাল এপায়ন্টমেন্ট পেয়েছিলাম, যেখানে মানুষ সারা রাত জেগে ট্রাই করে এপায়ন্টমেন্ট পায় নাই সেখানে স্পেশাল এপায়ন্টমেন্ট পাওয়া খুব সহজ বিষয় ছিলনা, সত্যি ভাগ্য সহায়ক ছিল। ভিসা ইন্টারভিউ দেওয়ার ২৯ দিন পর স্বপ্নের দেশ জার্মানির ভিসা হাতে পেলাম। ভিসা হাতে পাওয়ার ৪ দিন পরই ফ্লাই করেছিলাম।

স্বপ্ন যদি হয় স্বপ্নের মত সেটা আজ হোক কাল হোক অবশ্যই পূরণ হবে। হাল ছাড়বেন না, অনেক বাধা আসবে, তবুও আপনি পৌছে যাবেন আপনার গন্তব্য স্থানে৷ শুধু নিজের উপর বিশ্বাস রাখবেন এবং মনে রাখবেন আপনি যা করতে যাচ্ছেন সেটা আপনার ভালোর জন্যই, তাহলে কোন বাধাই আপনাকে আটকাতে পারবে না।

বিঃদ্র – হয়তো বা এত ভালো ভাবে গুছিয়ে লিখতে পারি নাই, ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমার ব্যাক্তিগত স্টোরি শেয়ার করলাম, আপনাদের উৎসাহ পেলে IELTS থেকে শুরু করে জার্মানি তে এপ্লাই সহ জার্মান লাইফের অভিঙ্গতা শেয়ার করব, ইনশাআল্লাহ।

ধন্যবাদান্তে :

খয়রুল ইসলাম
এম এস সি ইন ইকোনমিকস এন্ড ফাইনান্স
রাইন ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লাইড সাইন্ড
জার্মানি

4 thoughts on “একটি সঠিক সিদ্ধান্ত ও আত্নবিশ্বাস ই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে”
  1. bhai Ami ow BBA korteche, so journey sharw korle amar jonno valo hobe…Germany te business niya etto resources nai ja science niya thake..so agiye ashon please… thank you..

  2. Pls tell me ur whole story how is possible? How to get german visa? I am completed my graduation from Chittagong university (Zoology). Pls help me is this issue. Advance thanks.

  3. ভাইয়া আমার সংশোধন কৃত পাসপোর্ট দিয়ে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করলে, আমি কি ভিসা পাবো বা কোন সমস্যা হবে কিনা ?

Leave a Reply to MD Nahid Hasan Cancel reply