পাঠকগণ সম্ভবত জানেন যে, জার্মানিতে সবার জন্য হেলথ ইনস্যুরেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। সারা বছর ডাক্তারের কাছে না গেলে কিছু কোম্পানী মোটামুটি ভাল অংকের টাকা ফেরত দেয়। আমাদেরটা এক্ষেত্রে অনেক অদ্ভুত শর্ত জুড়িয়ে দেওয়ায় আমি কোন টাকা ফেরত পাইনা।
আমার এক বন্ধু বাংলাদেশের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে এখানে আমার সাথে মাস্টার্স করত। আমরা অন্যায্য আচরণের শিকার হচ্ছি ভেবে সে সামান্য কিছু হলেই ডাক্তারের চেম্বারে দৌড় দিত। যেনতেন ডাক্তার হলে চলবে না, এলাকার সবচেয়ে ভাল ডাক্তার চাই।
বছর শেষে আমার কাছে এসে বলত,”তুমি মিয়া এবছর ৮০ হাজার টাকা লস খাইলা, আর আমি সব টাকা উসুল করেছি, তোমার মত লোকের জন্যই এরা এখনো টিকে আছে!”
আমি মন খারাপের ভান করে বলতাম, “ঠিকই বলেছ, হে।”

একদিন সে ফোন করে বলল, “একটা সুখবর আছে।”
মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, “মার্সিডিজ বেঞ্জে চাকরি পাইছ নাকি?”
“আরে না, আমার বা হাতের বৃদ্ধাংগুলির পাশে যে টিউমারের মত কিছু একটা আছে সেটা অপারেশনের ব্যবস্থা হয়েছে।”
“তাই নাকি। খুব ভাল খবর। তবে তুমি বলেছিলে যে এটা তোমার জন্ম চিহ্ন।”
“তাতে কি হয়েছে? অপারেশনের পরে আমার হাতের সৌন্দর্য বাড়বে আর সবচেয়ে বড় কথা হল যে, ঐ ইনস্যুরেন্স কোম্পানীর বারোটা বাজবে। ব্যাটাদের চরম শিক্ষা দেওয়া সময়ের দাবি।”
“কিন্তু এত দামি অপারেশনের পরে তোমাকে বেশ কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, অনেক টাকার ব্যাপার, তাই না?”
“এখানেই তো আসল খেল। আমাকে এক বেডের একটা কেবিনে রাজার হালে রাখা হবে আর ওরা সবকিছুর বিল দেবে। আমাকে শুধু খাবারের জন্য প্রতিদিন ৫ ইউরো পরিশোধ করতে হবে।ডাক্তার বলেছে যে, দুই-তিন দিনের মধ্যেই ঘা শুকিয়ে যাবে।”
“প্রভু তোমার মনোবাসনা পুর্ণ করুন” বলে ফোন রেখে দিলাম।

এক সপ্তাহ পরে অপারেশন হল। হাসপাতালে গেলাম বন্ধুকে দেখতে। গিয়ে দেখি কথা সত্যি। চার তারার হোটেলের মত হালচাল , ২৪ ঘন্টা নার্সের সুব্যবস্থা। ঢাকার যেকোন দামি প্রাইভেট হাসপাতালের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বন্ধুর বিচক্ষণতার প্রশংসা না করে পারলাম না।

দুইদিন পরে তাকে আবার দেখতে গেছি। ওর মন খারাপ। কারণ জিজ্ঞেস করতেই বলল, “ডাক্তার বলেছে ঘা শুকাতে আরো কয়েকদিন লাগবে। আর সকাল দুপুর রাতে রুটি, ফলের জেলি আর কলা খেতে দেয়। এগুলো মানুষে খায়?”
বন্ধুর প্রতি মায়া লাগায় এরপর প্রায় প্রতিদিন খাবার রান্না করে নিয়ে যেতাম। এভাবে দুই সপ্তাহ কেটে গেল। টেনশনে এবং সুস্বাদু খাবারের অভাবে তার ওজন কয়েক কেজি কমে গেল।
জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি না বলেছিলা যে, সব মিলিয়ে তিন দিনের বেশি লাগার কথা নয়?”
“আরে, ডাক্তার ব্যাটা তিন সপ্তাহের কথা বলেছিল। ভাষাগত কারণে ভুল বুঝেছিলাম” বন্ধুর চাপা ক্ষোভের বহির্প্রকাশ।

কিছু দিন পরে অনেক কষ্টে ডাক্তারকে রাজি করিয়ে বাসায় ফিরল সে। হিসাব করে দেখা গেল, খাবার বিল ও কাজে অনুপস্থিত থাকায় তার ৯০০ ইউরোর মত ক্ষতি হয়েছিল, যা দিয়ে দিব্যি দুইমাসের খরচ চালানো যায়।

এরপর সে খুকখুক করে কাশলেও জিজ্ঞেস করি, “লাগবে নাকি সেরা ডাক্তারের নাম্বার”?
লজ্জিত ন্যাড়ার প্রতুত্তুর, “বেলতলায় দ্বিতীয়বার যাওয়ার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই!”

mm

By Shariat Rahman

আমি বর্তমানে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্সে সায়েন্টিফিক এসিস্ট্যান্ট (Wissenschaftlicher Mitarbeiter) হিসেবে কাজ করছি। ২০০৯ সালে বুয়েট থেকে আইপিইতে ব্যাচেলর আর ২০১২ সালে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্স থেকে বায়োনিক্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। অবসর সময়ে সোস্যাল মিডিয়া, আড্ডাবাজি আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি।

3 thoughts on “জার্মান হেলথ ইনস্যুরেন্স ও পয়সা উসুল”
  1. লজ্জিত ন্যাড়ার প্রতুত্তুর, “বেলতলায় দ্বিতীয়বার যাওয়ার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই!” :v

Leave a Reply to Sunjida Afrin Cancel reply