A Tale of lakes and mountains

Original post: https://medium.com/tripsharebd/salzburg-and-around-austria-f7c7d940abbf

Salzburg and around, Austria

শুরুর কথা

ডিসেম্বর মাস, দেখতে দেখতে আরেকটি বছর ২০১৯ শেষের দিকে, অফিসের কাজের প্রেশার ও বেশ কম, আর চারদিকে বড়দিন বড়দিন একটা আমেজও চলে এসেছে। তো এই ডিসেম্বরে কম বেশি সবারই ছুটি থাকে, আর ছুটি যেহেতু আছেই, তাই একটা ছোটখাট ট্রিপ এর প্লানও করে ফেললাম। আমার ছুটিটা একটু অড টাইমেই বলা চলে — ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এই সময়ের সুবিধা হচ্ছে সবখানেই কিছুটা বড়দিনের ভাব এবং উৎসবের পরিবেশটা থাকে, কিন্তু ক্রিসমাস এর ছুটির উপচে পড়া ভিড় এবং অতিরিক্ত খরচটা থাকেনা। তবে এর আগে যেহেতু কখনো একা কোথাও যাইনি, তাই জার্মানির ধারে কাছে অস্ট্রিয়ায় নিশানা লাগালাম।

আমার হিস্ট্রি, আর্কিটেকচারের প্রতি বিশেষ টান নেই, তবে খারাপ লাগে না। তাই অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ এবং এর আশেপাশেই ঘোরার প্লান করলাম যেহেতু সালজবুর্গ বেশ হিস্ট্রি, মিউজিয়াম, মিউজিক, ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ এবং এর আশে পাশে আবার লেক-পাহাড়ের প্রাচুর্যও রয়েছে। প্রস্তুতি হিসেবে ট্রান্সপোর্ট টিকিট এবং হোস্টেল বুকিং দিয়ে দিলাম প্ল্যান মতন। যেহেতু উইন্টার এর শুরুর দিকে এবং আবহাওয়া বার্তায় দেখলাম ট্রিপ এর মাঝে বৃষ্টি এবং স্নোফল আছে, তাই ভারি কাপড়চোপড়ও সব রেডি করলাম।

দিনঃ ০ | কোলন — মিউনিখ

জার্মানির সবচেয়ে ভাল এবং দ্রুতগতির ট্রেন হচ্ছে ICE (Intercity Express), আমি এর আগে কখনো এই ট্রেনে উঠিনি। সাদা রঙের ট্রেন কোলন সেন্ট্রাল স্টেশনে আসল রাত ১০ঃ৩০ এ, গন্তব্য — মিউনিখ। ট্রেনে উঠে পড়লাম, আর কপাল ভাল থাকায় পাশাপাশি দুইটা সিট ফাকা পাওয়ায় বেশ আরামেই বসা গেল। প্রথম দ্রুতগতির জার্নি, ট্রেন যখন ২৫০ কিমি/ঘন্টা স্পীডে ছুটে চলেছে, তখন ভেতরে বসে বোঝাও যায়না যে এত বেগে ছুটে চলেছি। ট্রেনে ওয়াইফাই, প্লেনের মতন টয়লেট, আলাদা ডাইনিং, কি নেই!

Cologne Central Station
দ্রত গতিতে ছুটে চলা by ICE

তবে জার্নি যতই আরামের হোক না কেন, আমার ঘুম আসতে তো চায় না। একটু ছাড়া ছাড়া ভাবে ঝিমাতে ঝিমাতে একসময় ভোর ৬ঃ৩০ এ ট্রেন তার শেষ গন্তব্য মিউনিখ সেন্ট্রাল স্টেশনে পৌঁছে গেল। ঠাণ্ডাটা বেশ ভালই মনে হল, শূন্যের কাছাকাছি। ব্যাগে হাল্কা খাবার ছিল, স্টেশনেই একটা দোকানে দাড়িয়ে খেয়ে নিলাম। মিউনিখে একটা বেশ বড় সুবিধা হচ্ছে সেন্ট্রাল ট্রেন স্টেশন এবং বাস স্টেশন পাশাপাশি, যেটা খুব একটা কমন না আমার নিজের এবং আশেপাশের শহরে । বাস স্টেশনগুলো অনেক সময়ই একটু বাইরের দিকে থাকে মূল সিটি সেন্টার থেকে।

দিনঃ ১ | মিউনিখ — সালজবুর্গ

আমার পরবর্তি গন্তব্য সালজবুর্গ (Salzburg), মিউনিখ থেকে ফ্লিক্সবাসে দুই ঘণ্টার জার্নি। সকাল ৮ টায় বাস ছাড়ল, সবার আগে বাসে চেক ইন করায় নিজের পছন্দমতন সিটে বসে পড়লাম। দুইতলা বাস, ওয়াইফাই, টয়লেট, পাওয়ার সকেট, সবই আছে। রাতে ঘুম ভাল না হওয়ায় চেষ্টা করলাম একটু ঘুমিয়ে নেবার, তবে মিউনিখ থেকে সালজবুর্গ এর রাস্তার দুইদিকের অতীব সুন্দর প্রকৃতি ঘুমাতে দিল না তেমন একটা। আগে টিভিতে কিংবা ইউটিউবে দেখে এসেছি যে পাহাড়ের গায়ে সবুজ ঘাসের চাদর, আবার বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়াগুলো। মাঝে একটা বড় লেকও পরে, নাম তার Chiemsee। দেখতে দেখে কখন যে বর্ডার ক্রস করে বাস জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়া ঢুকে গেছে টেরই পেলাম না, একই ভাষার সাইনবোর্ড, একই সুপারশপ ব্রান্ড, তাই এক্টু ভাল করে না দেখলে বুঝারও উপায় নেই।

সালজবুর্গের বাস স্ট্যান্ড শহরের একটু বাইরের দিকে। বাস থেকে নেমেই চোখে পড়ে আশেপাশের পাহাড়গুলো। তো সিটি সেন্টারে যাবার লোকাল বাস এ উঠলাম, ফোনের এপ এ টিকিট কেটে। সিটি সেন্টারে যেতে যেতে পরিচয় হল আরেক ভারতীয় দম্পতির সাথে আর দিল্লি থেকে অফিসের কাজে আসা প্রিয়াঙ্কা নামে আমার সালজবুর্গে বাকি দিনের বন্ধুর সাথে।

সালজবুর্গে (Salzburg) শহরের নামটা এসেছে সালজ (salz) শব্দ থেকে যার অনুবাদ হচ্ছে সল্ট বা লবণ। জার্মানির একদম সীমান্ত ঘেঁষা এই শহর ডেভেলপ হয়েছে সল্ট মাইনের কারণে। তবে একজন বিশেষ মানুষের কারণে সালজবুর্গ অনেক বেশি জনপ্রিয়তা পায় — Wolfgang Amadeus Mozart। মোজার্টের জন্মস্থান এই সালজবুর্গ শহরেই এবং তারই স্মৃতিচিহ্নগুলোকে ঘিরে অনেক ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে উঠেছে। এমনকি সালজবুর্গে একটা খুবই পরিচিত ট্যুর র‍্যুট রয়েছে যার নাম — The Sound of Music. মোজার্টের জন্মস্থান থেকে শুরু করে একজন গাইড একে একে সবগুলো জায়গা স্টোরি এর মতন করে ভ্রমণ করিয়ে থাকেন।

যেহেতু সালজবুর্গে কি করব কোথায় যাব আগে থেকে প্ল্যান করিনি, তাই আমি আর আমার সদ্যপরিচিত ভারতীয় বন্ধু হাটা শুরু করলাম। সালজবুর্গ এর মাঝে দিয়ে বয়ে গেছে সালজাক নদী, যার উপরে দিয়ে এক্টু পর পরই ব্রিজ। এর মাঝে একটা ব্রিজ স্পেশাল, লাভ লক ব্রিজ। পুরো ব্রিজে রংবেরঙের তালা ঝুলানো আর তাতে মানুষ তাদের ভালবাসার মানুষের নাম লিখে তালা বন্ধ করে চাবিটি নদীতে ফেলে দেয়। ব্রিজ পেরিয়ে নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখছিলাম আশে পাশে রঙ্গিন বাড়িঘর গুলো। একসময় পৌঁছে গেলাম মিরাবেলে গার্ডেনে, সুন্দর সাজানো গোছানো আর নান্দনিক ইউরোপিয়ান আর্কিটেকচার সমৃদ্ধ মিরাবেলে প্যালেসকে ঘিরে এই বাগান। একটু ঘুরে ফিরে ছবি তুলে আরেক্টু এগোতেই পৌঁছে গেলাম মোজার্টের বাসভবন এ। খুব যত্নের সাথে তার সকল স্মৃতি সংরক্ষণ করা আছে সেখানে। শহরের এই অংশটাই ওল্ডটাউন বলা হয় কারণ আগে এইটাই মুল শহর ছিল তাই বেশিরভাগ পুরনো স্থাপত্যকলা এই অংশটাতেই দেখা যায়।

সালজাক নদী | মোজার্টের জন্মস্থান

নদীর ওপারের অংশটাতেই মোজার্টের জন্মস্থান, সেখানে বেশ ভালই টুরিস্ট এর ভিড়। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গ্রুপগুলোকে গাইডরা মোজার্টের বিভিন্ন নিদর্শন দেখাচ্ছেন এবং সেগুলোর পেছনের গল্পগুলো শোনাচ্ছেন। আমরাও দাড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনে হাটাহাটি কন্টিনিউ করলাম। এখানেই শহরের একটা অংশ পাথরের পাহাড়ের গা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে, দেখে মনে হয় যেন বাড়িঘরগুলো পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে।

ওল্ডটাউন | পাথরের পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাড়ি

সামনে বড়দিন, তাই এই ওল্ডটাউনে একটু উৎসব ভাব। উপরে নানা রঙের বাতি দিয়ে সাজানো রাস্তা, আর দোকান-রেস্টুরেন্টগুলও বেশ সুন্দর করে সাজানো। একটু সামনেই দেখতে পেলাম ক্রিসমাস মার্কেটের। নানা রকম জিনিসের পসরা সাজিয়েছে দোকানিরা। বিভিন্ন রকম মোমবাতি, পুতুল, শো-পিস, আরো কত কি! মার্কেটের এরিয়া বেশ সরগরম, এখানের সবচেয়ে কমন স্ট্রিট ফুড হচ্ছে হট ওয়াইন (gluhwein) আর সসেজ-ব্রেড (bratwurst)। আমার ভারতীয় বন্ধু সুভেনিয়র হিসেবে কয়েকটা ফ্রিজ ম্যাগনেট কিনে নিল।

ক্রিসমাস মার্কেট থেকে বেড়িয়ে গেলাম পাহাড়ের একদম সাথে ঘেঁষা একটা পুরাতন চার্চ এ। এখানেই আশে পাশে বেশ কয়েকটা চার্চ বা ক্যাথেড্রাল রয়েছে, যার মধ্যে সালজবুর্গ ক্যাথেড্রাল দেখার মতন একটা নিদর্শন। ভেতরের বাইরের আর্কিটেকচার, বিভিন্ন পেইন্টিংস, আর অগণিত ভাস্কর্যের কারুকাজ দেখে মুগ্ধ হতেই হয়।

পুরাতন একটা আন্ডারগ্রাউন্ড টানেলকে এখানে এডভারটাইজিং এভেনিউ হিসেবে ট্রান্সফর্ম করা হয়েছে, যেটা এক এক দিকে এক একটি ক্যাসেল বা পুরাতন নিদর্শন এর দিকে নিয়ে যায়। দুইটা বড় ক্যাসেল একটু পাহাড়ের উপর, অনেক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। সারাদিন ধরে হেঁটে বেড়িয়ে এতোগুলো সিঁড়ী ভাঙ্গার আর এনার্জি হলনা বলে নিচে থেকেই দেখে শান্ত থাকতে হল। তবে পড়ন্ত বিকেলের আলোয় সালজবুর্গের আশেপাশে পাহাড়ের উপর থাকা ঘরবাড়ি গুলোকে বেশ সুন্দর লাগছিল, আর দুরের বরফ ঘেরা পাহাড়ের চূড়াগুলো যেন খানিক সময়ের জন্য রোদে জ্বলে উঠল।

যেহেতু বছরের এই সময়ে দিন ছোট, বিকেল চারটাতেই সন্ধ্যা হয়ে এল। চলে গেলাম সালজবুর্গ সেন্ট্রাল স্টেশনে। আমার হোস্টেল স্টেশনের কাছেই, আর আমার সাথে সারাদিন ঘোরাঘুরি করা ভারতীয় বন্ধু এখান থেকেই রাতের বাসে ফিরে যাবে মিউনিখে। বেশ সুন্দর করে সাজানো এবং বেশ ব্যস্ত এরিয়া বলা চলে। রাতের খাবার একটু আগেভাগেই খেয়ে নিয়ে, বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম হোস্টেলে। আমার প্রথম হোস্টেলে থাকা, তবে বেশ ভালই সুযোগ সুবিধা মনে হল, আর খরচও কমই বলা যায়। ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম রাত আটটা নাগাদ। রুমে একে একে বাকিরাও ১০টা পর্যন্ত চলে এল, তবে ঘুমের ঘোরে আর দেখা হয়নি কে এল বা গেল।

দিনঃ 2 | সালজবুর্গ — বাড ইসেল

সকাল ৬টা নাগাদ উঠে পড়লাম ঘুম থেকে, আবহাওয়া মেঘলা। উঠে ফ্রেশ হয়ে সব গোছগাছ করে বেড়িয়ে পড়লাম, সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশেই বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে ৭ঃ১৫ এর বাস ধরলাম। বাসে চড়ার আগে একটু খাবার কিনে নিলাম সাথে। আমার প্রথম গন্তব্যস্থল ফুসেল (Fuschl) লেক, কিন্তু লোকেশন ঠিকমতন বুঝার আগেই বাস লেকের এই মাথা থেকে প্রায় ওই মাথায় চলে গেল। তারাহুরা করে পরের স্ট্যান্ডে নেমে গেলাম। তবে তাড়াহুড়ায় লেকের ওইপাশের স্ট্যান্ড এর এক স্ট্যান্ড আগেই প্রায় ১ কিমি আগে মেইন রোডেই নেমে গেলাম। বাইরে ঠাণ্ডা প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টি। তবে যেখানে নামলাম সেখানের একপাশে তাকাতেই চোখ আটকে গেল। নীল রঙের পানির ছোট্ট একটা পুকুরের মতন মাঝে একটা রিসোর্ট টাইপ কিছু একটা। পাহাড়ের মাঝে দেখার মতন একটা জায়গা। পরে ম্যাপ ঘেঁটে দেখলাম এটা আসলে রেড বুল (Red Bull) এনার্জি ড্রিংকস কোম্পানির অফিস!!!

রাস্তা পার হয়ে হেঁটে এগিয়ে গিয়ে লেকের পাড়ে যাবার রাস্তা খুঁজলাম। রাস্তায় আমি ছাড়া আর কাউকে এই সকাল সকাল বাজে ওয়েদারে হাঁটতে দেখলাম না। বেশ কিছুদূর গিয়েই একটা ছোট্ট বিচ টাইপের খোলা জায়গা পেয়ে গেলাম। পাহাড়ে ঘেরা স্বচ্ছ পানির লেক, এক অসাধারণ দৃশ্য। কিন্তু বৃষ্টি আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে বেশিক্ষন দাঁড়ানোর জো হল না। কয়েকটা ছবি তুলে লেকের ধারের বাড়িঘর দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এইখানে আসলে বেশিরভাগই হোটেল বা গেস্টহাউস টাইপের বাসা বাড়ী। শহর না হলেও দামি ভাল পুরাতন ধাঁচের হোটেল রয়েছে পাহাড়-লেক ঘেঁষেই। হেঁটে হেঁটে এই ছোট্ট পর্যটন ভিলেজের অন্যপ্রান্তে একটা চার্চ দেখলাম, বেশ সুন্দর এবং সামনে ক্রিসমাস উপলক্ষে সাজানো। চার্চের একটা দুটো ছবি তুলতে তুলতেই পাশে বাস এসে হাজির। উঠে পড়লাম পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।

সেন্ট গিলগেন

ফুসেল থেকে মাত্র ১০-১২ মিনিটের বাস জার্নি, আরও উঁচু পাহাড়ে ঘেড়া আরেকটি বড় লেক। নেমেই ক্যাবল কারের কাউন্টার, তবে কাউন্টারের সামনে গিয়েই একটু মন খারাপ হল। নোটিশ টানানো যে খারাপ ওয়েদারের কারণে আজকে ক্যাবল কার বন্ধ! আর কি করার হেঁটে হেঁটে সেন্ট গিলগেনের লেক ঘেরা ছবির মতন সুন্দর বাড়িঘর দেখে দেখে একসময় লেকের পাড়ের চলে গেলাম। এখানেও বেশিরভাগই গেস্টহাউস। আসার পথে এখানেও একটা ছোট্ট চার্চ দেখলাম, পাশে একটা কবরস্থানও, সেখানে ফলকগুলোও সুন্দর করে সাজানো। আর বড়দিনের ভাবটা যেন এখানে ভাল করেই বুঝা যাচ্ছে। ছোট ছোট ক্রিসমাস ট্রি, লাল-সাদা রঙ, সবার বারান্দা সাজানো।

লেকের পাড়ে দাড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম এদিক সেদিক, আসলে যেদিকে তাকাই সেদিকেই সুন্দর, ছবিও কিসের আগে তুলা উচিত সেটাও ঠিক করা কঠিন। স্বচ্ছ নীল লেক, চারিদিকে পাহাড়ের চূড়ায় সাদা বরফ, আর লেক এর ধারে কাঠের রঙ্গিন বাড়িঘর — সব মিলিয়ে চমৎকার লোকেশন। অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে ক্লান্ত, আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঠাণ্ডা বাতাস থেকে বাঁচতে একটা ছাউনিতে গেলাম, সেখানে বসে লেক দেখতে দেখতে ব্যাগে থাকা খাবার খেয়ে নিলাম। যেহেতু ক্যাবল কার এ চড়া হয়নি তাই আমার হাতে অনেক সময় আছে। তাই, এই লেকে চলা ফেরিতে উঠব বলে টিকিট কাটলাম কাউন্টার থেকে। এতক্ষণ ঘুরাঘুরিতে তেমন ট্যুরিস্ট চোখে পড়েনি, কিন্তু ফেরি আসার পরে একদল জার্মান বয়স্ক ট্যুরিস্ট গ্রুপ হাজির। তাদের গাইড তাদের সব বুঝিয়ে দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ফেরি ছাড়ল, চলল লেকের মাঝে দিয়ে, চারিদিকের সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। ফেরিতে ওই গ্রুপ ছাড়া আমি আর আরেকটা মধ্যবয়সী কাপল। ফেরি মাঝে একটা ভিলেজ এ থামল — সেন্ট ওলফগাং (St.Wolfgang)। বুড়োবুড়ির দল এখানে নেমে গেল গাইডের সাথে। এত সুন্দর জায়গা দেখে আমারও নেমে ঘুরতে ইচ্ছা হল, কিন্তু টিকিট কাটা আর আরও ১ ঘণ্টা পরে পরের ফেরি, তাই ৫ মিনিট নেমে একটু ছবি তুলে আবার ফেরিতে উঠে পড়লাম। ফেরি নামিয়ে দিল লেকের অপর প্রান্তে, বেশ বড় লেক, প্রায় ২০-২৫ মিনিট লাগল একমাথা থেকে অন্য মাথায় আসতে।

এই পাড়ে অনেকগুলো কাঠের ব্রিজ টাইপের ঘাট। দেখে বুঝলাম সামারে এখানে ভালই ট্যুরিস্ট আগমন হয় আর ওয়াটার স্পোর্টস এরও বেশ ব্যাবস্থা থাকে। তবে এই সিজনে মরুভূমি টাইপ অবস্থা, আর অনেক গেস্টহাউসই আসলে ক্রিসমাস এর বন্ধের সিজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পাড়ের নাম স্ট্রবল (Strobl)। এখানে ক্রিসমাস এর জন্য একটা জায়গায় বিভিন্ন প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে, একটা কাঠের মঞ্চে কাঠের মুর্তি বানিয়ে সাজানো হয়েছে।

স্ট্রবল এর বাসস্ট্যান্ড থেকে আবারও বাসে চড়ে বসলাম বাড ইশেল (Bad Ischl) এর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ে ঘেরা ছোট্ট শহর, মাঝে বয়ে গেছে ছোট্ট একটা নদী। বড়দিনের বেশ আমেজ এখানেও। আমি একটু আগেই পৌঁছে গেছি এখানে। তাই এক টার্কিশ দোকানে খাবার খেয়ে দোকানির সাথে আধ ঘণ্টা গল্প করে, আর পাশেই ম্যাক ডোনাল্ডস এ গিয়ে কফি খেয়ে আর ইন্টারনেট ব্রাউস করে একটু সময়ও কাটল আর বৃষ্টি থেকেও একটু রেহাই মিলল। আমার হোস্টেল এ চেক ইন ছিল পাঁচটায়, কিন্তু ঠাণ্ডা বেশি লাগায় আর বৃষ্টিতে বাইরে ঘুরতে ভাল লাগছিলনা বলে চলে গেলাম আগে আগেই হোস্টেলে। লোকেশন শহরের এক দিকে, কিন্তু সেখান থেকে ভিউ খুবই সুন্দর। হোস্টেলে সেদিন আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তাই একরকম হোটেল ই বলা চলে। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে বাইরে বৃষ্টি কমলে বের হলাম। মেইন রাস্তাগুলো বাতি দিয়ে সাজানো আর শপিং ব্লকেও মানুষজন কেনাকাটায় ব্যাস্ত। নদীর পাশের রাস্তা ও ব্রিজগুলোতেও বাতি জ্বলজ্বল করছে। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে ক্ষুধা লেগে গেল, তাই পেট ভরে খেয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। ফিরেই যেন জগতের সকল ক্লান্তি চোখে জেঁকে বসল, আর ঘুমের মাঝে এদিনের জন্য হারিয়ে গেলাম।

দিনঃ ৩ | বাড ইসেল — হলস্টাট — বাড গইসার্ন

আজকে ঘুম থেকে উঠলাম একটু লেট এ, রেডি হয়ে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে গেলাম। ম্যাক ডোনাল্ডস থেকে সকালের নাস্তা কিনে বাসে উঠে পড়লাম। তবে বাস আসার ৫ মিনিট আগে থেকেই হঠাত বৃষ্টির ফোটা ভারি হতে শুরু করে একসময় স্নোফল শুরু হয়। আমি এর আগে স্নো দেখলেও স্নোফল কখনো দেখিনি, তাই এক্সট্রা উৎসাহ নিয়ে একটু ছাতা বন্ধ করে খোলা আকাশের নিচে দাড়িয়ে রইলাম। বাস চলল পাহাড়ের মাঝে দিয়ে, আর পথে শুরু হল আরও ভারি স্নোফল। মাঝে একবার বাস পরিবর্তন করা লাগল। প্রায় ১ ঘণ্টা পরে বাস নামিয়ে দিল হলস্টাট ভিউ পয়েন্টে। নেমেই যেন আমার চোখে খুশিতে জ্বলে উঠল, এই দৃশ্য ইন্টারনেটে কত দেখেছি, আর আজ নিজের চোখের সামনে দেখছি! আর বাড়তি হিসেবে স্নোফল তো আছেই। ঠাণ্ডা বাতাস, স্নো — কোনকিছুই আমার উৎসাহের পারদ ঠাণ্ডা করতে পারল না। এদিক সেদিক ঘুরে ছবি তুলে বেড়ালাম। যদিও নেমে পয়েন্ট থেকে সবাই হলস্টাট এর ভেতরের দিকে যায়, আমি গেলাম উল্টো দিকে, যেখানে মেইন হলস্টাট এর শেষ। স্নোফোল আর কুয়াশা থাকায় পাহাড়ের উপরে উঠার লিফট এ চড়লাম না, হেঁটে একদম শেষ মাথায় গেলাম। সেখানে একটা পরিত্যক্ত চার্চ আছে যেখানে উঠলে পুরো হলস্টাট দেখা যায়। আমি একাই সেখানে, একটু ছবি তুলে আবার নিচে নেমে এলাম।

একটা ছোট আইল্যান্ড দেখলাম, সবুজ ঘাসের, এইদিকে কোন ট্যুরিস্টও নেই। জায়গাটা বেশ সুন্দর, বরফে ঢাকা পাহাড়, স্বচ্ছ লেক, লেকের ধারের রঙ্গিন ঘরবাড়ী — সবকিছুই ভাল করে দেখা যায় এখান থেকে। ঘুরে ফিরে এদিক সেদিক করে এই জায়গাটায় অনেক সময় কাটালাম, ছবিও তুলা হল বেশ।

দেখলাম আবহাওয়া একটু ক্লিয়ার হচ্ছে, তাই তাড়াতাড়ি চলে গেলাম পাহাড়ের উপরে উঠার লিফট এর কাছে। টিকিট কেটে কাচের লিফট দিয়ে চারিদিক দেখতে দেখতে একসময় পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের উপরে। এখানে দুইরকম টিকিট পাওয়া যায়, একটা শুধু উপরের স্কাই ওয়াক এর, আরেকটা স্কাই ওয়াক + সল্ট মাইন ট্রিপ এর। আমি শুধু স্কাই ওয়াক এর জন্য টিকিট কেটেছি। স্কাই ওয়াক এ থেকে চারিদিকের যে সুন্দর ভিউ পাওয়া যায় তা বর্ণনাতীত। তবে সেই ক্লিয়ার ভিউ এর স্থায়িত্বকাল মাত্র পাঁচ মিনিট। এর পরেই আবার শুরু স্নোফল। স্কাই ওয়াকে ছবি তুলার সময় পরিচয় হয় আমার সেদিনের বন্ধু, দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক চুং ডি’র সাথে। স্কাই ওয়াকে ঘুরে এবার পাহাড়ের উপরে হেটে চললাম। দুইদিকে গাছ, আর সবকিছু সাদা হয়ে আছে বরফের আবরণে। প্রায় ১৫ মিনিট আপহিল উঠার পরে পৌঁছে গেলাম সল্ট মাইনের শুরুতে, যেহেতু আমার টিকিট এই পর্যন্তই তাই এর পরে আর যাইনি। তবে এই জায়গাটাই অনেক সুন্দর, চারিদিকে পাহাড়ের উপরে বরফ, তার মাঝে হলুদ রঙ্গা একটা বাড়ি।

ঘুরে ফিরে দেখে লিফট দিয়ে আবার নেমে গেলাম নিচে, মজার ব্যাপার এখানে তেমন একটা স্নোফল হচ্ছে না! প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছিল, তাই হেঁটে হেটে এবার হলস্টাট মুল ভিলেজ এর পুরোটা দেখতে দেখতে স্কয়ারে পৌঁছে একটা রেস্টুরেন্ট এ ঢুকে গেলাম। আমি অর্ডার করলাম একটা জার্মান বিফ গোলাস (গরুর মাংস দিয়ে তৈরি ঘন স্যুপের মতন) আর আমার কোরিয়ান বন্ধু অর্ডার করল একটা স্পিনাচ পিজ্জা। খেয়েদেয়ে ক্ষুধা মিটিয়ে আবারও হেঁটে একদম শেষ মাথায় চলে গেলাম হলস্টাট এর। পথে একটা ভিউপয়েন্ট পড়ে যার নাম পোস্টকার্ড ভিউপয়েন্ট। অষ্ট্রিয়া লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করলে এই ভিউপয়েন্ট থেকে নেয়া ছবিগুলোই আসে প্রথমদিকে। আমরাও কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম, আসলেই সুন্দর জায়গা।

আসার পথেই একটু ফেরত গিয়ে নেমে গেলাম ফেরির ঘাটে। সেখানেও ৩০ মিনিট অপেক্ষা করে ছোট্ট একটা টাইমল্যপস করলাম। তারপর ফেরিতে উঠলাম অপরপাড়ে ট্রেন স্টেশনে যাবার জন্য।

ফেরি থেকে সন্ধ্যা নেমে আসা পাহাড়ের বুকের হলস্টাট এর বাড়িঘরের আলো জ্বলে উঠার দৃশ্য সত্যিই চমৎকার।

ফেরির টাইমিং ট্রেনের শিডিউল এর সাথে মেলানো, ট্রেন আসল ৫ মিনিট পরেই। আর এরই সাথে সাথে অপরূপ সুন্দর হলস্টাটকে বিদায় জানালাম। আমার জন্য বাড়তি পাওনা হল আসা যাওয়ার রুট ভিন্ন, আসার পথে বাস, যাবার পথে ট্রেন, লেকের দুই দিকই দেখা হল। এই দিনের জন্য আমার থাকার বন্দোবস্ত করেছি বাড গইসার্ন (Bad Goisern) নামক ছোট্ট শহরে। হলস্টাট থেকে ট্রেন জার্নি মাত্র ১০ মিনিট। আমার কোরিয়ান বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে নেমে পড়লাম, আমার হোটেল ট্রেন স্টেশন থেকে নেমে ১০ মিনিট হাঁটার পথ। পথিমধ্যে তেমন কিছু চোখে পড়ল না। তবে এই রাতেও শহরের আশে পাশে জেগে থাকা সাদা পাহাড়গুলো ঠিকই বুঝা যায়। হোটেলে চেক ইন করে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের খোঁজে। একটাই মেইন স্ট্রিট যেটার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত যেতে ৫ মিনিট লাগে এত ছোট শহর। খেয়ে তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরলাম ঠাণ্ডার কারণে। তারপর সারাদিনের সকল সুন্দর জিনিসের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লাম একসময়।

বাড গইসার্ন

দিনঃ ৪-৫ | বাড গইসার্ন— মিউনিখ — কোলন

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে দেখলাম বেশ রোদ্দুর ঝলমলে দিন। তবে তাপমাত্রা মাইনাস ৬! ফ্রেশ হয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে বেরুনোর পরে সাদা পাহাড়ের চূড়াগুলো সোনালি আলোয় ঝলমল করছে দেখে মন ভাল হয়ে গেল। তবে পকেট থেকে হাত বের করে যে মোবাইলে কয়টা ছবি তুলবো সেটার জো নেই, হাত জমে যায় ঠাণ্ডায়। পাহাড়ী নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর গেলাম, তারপর ঘুরে ফিরে ট্রেন স্টেশনে। ট্রেন স্টেশনের লোকেশন একটু বেশিই ভাল বলতে হবে।

ট্রেন ছুটে চলল পাহাড়ের মাঝে দিয়ে। আর একটু পড়েই নেমে গেলাম আগের দিনের বাড ইসেল শহরে। এখানে থেকে বাস ধরে চলে গেলাম সেন্ট গিলগেন লেক এ। এই লেকে আগে যেদিন এসেছিলাম তখন আবহাওয়া খারাপ ছিল, কিন্তু আজ চকচকে সবকিছু। বেশ কিছুক্ষণ ঘুরাফেরা আর নীল জলের লেক দেখে, ছবি তুলে ১ ঘণ্টা পরে আবার বাসে।

সালজবুর্গ পৌঁছালাম দুপুর ১২ঃ৩০ এ । আমার ১ টায় বাস সালজবুর্গ — মিউনিখ। তড়িঘড়ি করে কিছু ফাস্টফুড কিনে নিয়ে রওনা দিলাম বাস স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আবারও সেই ফ্লিক্সবাস, দুইতলায় এবার দুই সিটে একা আরাম করে বসলাম।

অস্ট্রিয়া ঢুকার সময় বর্ডারে কিছু টের না পেলেও জার্মানিতে ঢুকার সময় বর্ডার পুলিশ বাস থামিয়ে সবার পাসপোর্ট চেক করল। তারপর আবারও সেই সুন্দর পাহাড়ি পথে ছুটে চলা। মিউনিখ পৌছাই বিকেলে, তারপর হোস্টেলে চেক ইন করে রেস্ট। পরিচয় হয় হোস্টেলে সপ্তাহে 5 দিন থেকে উইকেন্ডে বাড়ি চলে যাওয়া দুইজন স্টুডেন্ট এর সাথে। মিউনিখে বাসা ভাড়া অনেক বেশি হবার কারণে ওরা এভাবে পড়ালেখা করছে বলে জানলাম।

সন্ধ্যায় মিউনিখ ক্রিসমাস মার্কেটে ঘুরে ফিরে খেয়ে দেয়ে হোস্টেলে ফিরলাম। বেশ বড় এলাকা আর উৎসব উৎসব আমেজ। হোস্টেলে ফিরে ঘুম।

পরদিন সকাল ৮ঃ৪৫ বাসে করে আমার শহর কোলন এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। প্রায় ৯ ঘণ্টার বাস জার্নির পরে অনেক অনেক সুখ স্মৃতি নিয়ে ঘড়ে ফেরা, আর পরের বারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণা…

Leave a Reply