দেশ থেকে প্রথমবার আসার পর এক বছরের মাথায় দেশে গিয়েছিলাম, সেও প্রায় পাঁচ বছর ২ মাস আগের কথা। এবারে দেশে গেলাম গুনে গুনে পাঁচ বছর দেড় মাস পর। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে বাস করে দেশে ফেরার পর যা কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছে, তাই নিয়েই আজকের লেখা। লেখাটি নিয়ে যেকারো ভিন্নমত থাকতে পারে, কারণ দেখার চোখ আর বোঝার ক্ষমতা জনে জনে ভিন্ন। তাই যেকোন ভিন্নমতকে সাগ্রহে স্বাগত জানাই।

বাংলাদেশ নিয়ে যেকোন কথার শুরুতে রাজনীতি বিষয়টি না আসলে শুরুটা যেন জমে না। একারণে রাজনীতি দিয়ে শুরু করছি। রাজনীতি দিয়ে শুরু করলেও প্রথমেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনীতি বলতে কিছু নেই। অকার্যকর একপক্ষীয় সংসদে কি হয় না হয়, আগেও যেমন মানুষের সেসব নিয়ে আগ্রহ ছিল না, আজকে তা শূন্যের কোঠায়। ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগকে এতটাই সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে যে, মানুষ অনেক কথাই বলতে দ্বিধা করে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের অনুপস্থিতে এমনটা হয়। দীর্ঘকালীন একই সরকার থাকার কারণে তাদের বহু আচরণে একনায়কসুলভ ভাব। এটা বোঝা যায় কিছু জিনিস দেখলে। যেমন, দুই দশজনে মিলে বামপন্থীরা যে ক্ষুদ্র মানববন্ধ করে সেখানেও সরকারদলীয় লোকজন বা পুলিশ অমানবিক মারধর করে। ঢাবির নতুন ভিপিকে সাধারণ ছাত্ররা গোপনে ভোট দিলেও তাঁর জনসভায় সবাই যেতে সাহস করে না, অল্প যেকজন মানুষকে নিয়ে তিনি প্রতিবাদসভা করেন সেখানেও ছাত্রলীগেরা হাজির হয় হাতুড়ি আর বাঁশ নিয়ে। 

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রে মানুষের অংশগ্রহণ না থাকলে একটা রাষ্ট্রে যা হয় বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। এসবের চর্চা না করলে অন্ধকারের শক্তি মাথাচাড়া দেয়। বিএনপি নিস্তেজ হয়ে পড়লেও উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠীর উত্থান ব্যাপক। সরকার যেমন অনুদার তাঁর সমালোচনাকারীদের প্রতি, তেমনি এই উগ্রবাদীরাও নৃশংস আচরণ করে যারা উদার আর ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলে। অর্থাৎ সব পক্ষ অসহিষ্ণু। আগে যা কোনদিন দেখিনি, এবার একটা জিনিস খুবই চোখে পড়লো। শীতকাল মানেই ধর্মসভা আগেও ছিল কিন্তু এখন যে স্থানে সভা হয়, মাইক লাগানো হয় কয়েক মাইল জুড়ে। এর মানে হল, বক্তব্য শোনার জন্য সভাতে উপস্থিত হলেই চলছে না, যারা নানা কারণে সেখানে যেতে পারে না, যারা অসুস্থ, শিশুদের নিয়ে যারা রাতভর ঘুমের কষ্ট করেন সবাইকে শুনতে বাধ্যকরার মধ্য দিয়ে তাঁরা ধর্মীয় আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেন। এসব নিয়ে কারো কিছু  বলার শক্তি নেই, কারণ সবার ধারণা এসবের বিরুদ্ধে বললে তা ধর্ম অবমাননা। কিন্তু পৃথিবীর কোন দেশে, এমনকি ইসলাম যেখান থেকে এসেছে সেখানেও, এভাবে সারারাত মাইক দিয়ে ধর্মপ্রচার করতে কেউ কোনদিন দেখেছে বলে জানিনা। এর অবশ্য একটা অর্থনৈতিক দিক আছে। শীতকাল মানেই এই ধর্মসভা একটা ব্যবসা। মানুষ যেহেতু এই ব্যবসা পছন্দ করে না তাই এর সাথে ধর্মটা জুড়ে দিলেই মানুষকে খাওয়ানো যায়।

বাংলাদেশের মানুষ সুখে থাকতে ভুলে গেছে। সবার মাঝে একটা কমন বৈশিষ্ট্য দেখলাম। সেটি হল লোভ। লোভ লালসা থেকে বাঙ্গালি কখনো বিরত ছিল তা দুগ্ধপোষ্য শিশুও বলবে না, কিন্তু ইদানীং যেন তা মহামারী। সবার মুখে টাকা টাকা আর টাকা। টাকা ভিন্ন কথা নাই। সবার ধারণা যত টাকা জীবনে তত সুখ তত সমৃদ্ধি। মানুষের উপরে উঠার মাপকাঠি সে কত বিত্ত বৈভবের মালিক। ছোট থেকে বড় সকলে তাদের প্রশংসায় ভাসিয়ে রাখে, এতে করে তাদের বিত্ত-ভাব ও ক্ষমতার দাম্ভিকতা দেখানো আরো সহজ হয়। মানুষও এসব দেখে তাদের আরো বেশি তোয়াজ করে চলে। আমরা জানি যে সমাজে যার কদর বেশি, সেটার বাড়বাড়ন্তও বেশি। আগামীকাল হতে যদি সব মানুষ মিলে সততা, বিনয়বোধ, শিক্ষা, জ্ঞানচর্চাকে প্রশংসা করা শুরু করে, তবে কাল হতেই সমাজের মানুষের ঝোঁক তৈরি এসবের প্রতি। 

এতদিন শুধু শুনতাম, এবারে দেশে গিয়ে দেখলাম মানুষের হাতে প্রচুর টাকা। দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের একটা সাধারণ আচরণ হল তাঁরা অধিক পয়সা খরচ করাকে আভিজাত্যের প্রতীক মনে করে। বাংলাদেশের মানুষও দেখলাম প্রচুর খরচ করছে। গ্রামের হাটে বাজারে পর্যন্ত কফির দোকান। সেসব কফিতে কতখানি দুধ-চিনি আর কতখানি কফি তা বিবেচ্য নয়, মানুষ প্রচুর কিনছে আর চুকচুক শব্দ করে পান করছে। বললাম মানুষের হাতে অনেক টাকা, কিন্তু কিছু মানুষের কাছে তা সীমাহীন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সাথে যারা জড়িত তাঁরা যেন ফুলে ফেঁপে বটগাছ। সামান্য ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাও লাখপতি নয়, একেকজন কোটিপতি। দীর্ঘদীন নিজেদের সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে তাদের ব্যবসা বাণিজ্যে ব্যাপক সুবিধা হয়েছে। এতে করে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। তাদের অর্থ ক্ষমতার দাপটে বহু মানুষ অতিষ্ট। কিশোর বয়সের ছেলেদের যে অহংকার আর দাম্ভিকতা নিয়ে মূল্যবান মটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়, সেটি চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। রাজনীতির সাথে জড়িতদের এভাবে বিত্তশালী হওয়া এবং বুক ফুলিয়ে চলা দেখে সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ আর হতাশা। এই বিভাজন, শ্রেণিগত পার্থক্য আর বৈষম্য মধ্যবিত্তকে ক্ষুব্ধ করে চলেছে। 

বহু খারাপ জিনিসের মাঝেও ভাল কিছু যে একেবারে চোখে পড়েনি তা নয়। বিদ্যুতের অভুতপূর্ব উন্নতি দেখলাম। সত্যিকথা বলতে ৩০ দিনে একবারও বিদ্যুৎ যেতে দেখিনি। সেটা হয়ত অনেকটা শীতকাল বলে। কিন্তু কট্টর সরকারবিরোধী মানুষও এটা স্বীকার করে এবং মানুষ এটা নিয়ে সন্তুষ্ট। জার্মানি আসার আগে এটা আমাদের কাছে ছিল অসম্ভব এক বিষয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। রাজধানীতে প্রচুর ফ্লাইওভার হয়েছে, কিছু কাজ চলমান আছে, একারণে ঢাকা ধূলার শহরে পরিণত হলেও আশা করা যায় কাজগুলো শেষ হলে আরো উন্নতি হবে। আমি মূলত উত্তরা শ্যামলী মিরপুর ঘুরেছি বেশি এবং যানজট খুবই কম মনে হল। শুনেছি মতিঝিলের দিকে যানজট বেড়েছে। উবার পাঠাও সরাসরি খোদার আরশ থেকে উপহার হিসেবে ঢাকা শহরে এসেছে যেন। 

একবিংশ শতাব্দীর নতুন অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও গ্রাম্য মোল্লাদের দৌরাত্ম্যে গ্রাম বাংলার প্রাচীনকাল হতে চলমান যাত্রা, মেলা, বাউল গানসহ নানাবিধ সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রায় উঠে গেলেও শহরে এসবের প্রচলন বেড়েছে। ঢাকার কিছু সুনির্দিষ্ট স্থানে ঘুরে দেখলাম বাংলা মাসের হিসেবে নানাবিধ নৃত্য, সঙ্গীত, পিঠামেলা, চিত্রকলা প্রদর্শন হচ্ছে। নির্বিঘ্নে এসব চলতে দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। 

ধর্মীয় সন্ত্রাস বলতে গেলে উধাও। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারীদের বাংলাদেশের মানুষ যখন ক্ষমতা দিয়েছিল তখন এই দেশের মানুষ খেয়াল করেছে ধর্মের নামে দেশকে ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঢাকার পথে তখন স্লোগান দেওয়া হত আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান। সেই সরকারের এক সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে এসব মিছিল হত। সারাদেশে খইয়ের মত বোমা ফুটত। অপরদিকে গত প্রায় অর্ধযুগ হতে বাংলাদেশে কোন হরতাল নেই, গাড়ী পোড়ানো নেই, এসব নিয়ে অতীতে যে অজানা আশঙ্কায় থাকত মানুষ, তা একেবারেই নেই। হরতাল ও বোমা শব্দটি এখন অভিধানে স্থান পেয়েছে। সেসবের কারণ যাই হোক, বহু সমস্যা থাকার পরেও মানুষ এইসব দিক দিয়ে স্বস্তিতে আছে।      

পরিশেষে বলতে চাই, ভালোর কোন শেষ নেই। যত গুড় তত মিঠা। নানাবিধ দুর্যোগ-দুর্গতি, অন্যায়-অনাচার, দুর্নীতির পরও ধীরে হলেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির দিকে। এর পেছনে অবদান প্রবাসী, পোশাকশিল্প, মেহনতি মানুষ, কৃষক শ্রমিকের। রাজনীতিকদেরও অবদান নেই সেটা বলা যাবে না। কিন্তু গণতন্ত্রে মানুষ যদি ইচ্ছেমত শাসক নির্বাচন করতে অক্ষম হয়, জনগণ যদি মনে করে তাঁরা গণতন্ত্রের সিলেবাসে ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত হচ্ছে, তবে দুই চারটা পদ্মাসেতু দিয়েও সে সমাজের সে রাষ্ট্রের সে জাতির অধঃপতন ঠেকিয়ে রাখা দুঃসাধ্য হবে।

ধন্যবাদান্তে 
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
১২ জানুয়ারী ২০২০

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

11 thoughts on “যেমন দেখে এলাম বাংলাদেশ”
  1. সঠিক মূল্যায়ন করেছ। তোমার পর্যবেক্ষণের সাথে আমি একমত। শুধু একটা জায়গায় আমি কিছু সংযোজন করতে চাই, তা হলো; দেশের ভাল মন্দ বুঝার জন্য মেজরিটি জনগণের মধ্যে যে শিক্ষাটুকু থাকা দরকার তার ধারেকাছেও নে। ফলে যেটা হয়, সামান্য লোভ লালসার কারণে রাতের আঁধারে ভোট বিক্রি হয়ে যায়। আগে দেখতাম এলাকার শিক্ষিত মুরুব্বীদেরকে জনগণ জোর করে প্রার্থী করে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতো। এখন চিত্রটা উল্টো। এখন ঐ ধরনের জনপ্রতিনিধিকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে একজন ভ্যান চালক অথবা দিন মজুর দাঁড়িয়ে যায়। ফল স্বরুপ ভদ্রলোক নির্বাচন থেকে মান সন্মান বাঁচাতে দূরে সরে যা। বিদ্যালয় গুলোর পরিচালনা কমিটিতে অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত লোকের ছড়াছড়ি। এগুলো সবই দরিদ্র দেশের অশিক্ষিত, নিরক্ষর জনগনের ভোটাধিকারের ফসল। তার চেয়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আরো কিছুদিন এভাবে চলুক। হয়তো জনগণের এটাই চাওয়া। জনগনের নিরবতা সেটারই ঈঙ্গিত হবে হয়তো।

    1. আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। তবে আপনার কাছে জানতে চাই, সেই কিছুদিন আসলে কতদিন। কত টার্ম বা কতবছর পর মনে করবেন যে বাংলাদেশের মানুষ এখন সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করতে সক্ষম?

    1. লেখাটি খুব ভালো লিখেছেন। লেখাটা পড়ে মনে হলো আমরা সাংবাদিকতা করছি নিদিষ্ট কোন বেড়াজালে।

Leave a Reply